'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে গ্রাম ও শহরের দ্বন্দ্বময়তার সঙ্গে মিশেছে মানবমনের নিগূঢ় প্রেমের সংরাগ। উপন্যাসটি বিশ্লেষণ করে তোমার অভিমত দাও।

গ্রাম ও শহরের সম্পর্কসূত্র তার দ্বন্দ্ব ও পরিণাম নিয়ে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যে কটি প্রধান উপন্যাস লেখা হয়, তার মধ্যে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা' অন্যতম। তারাশঙ্করের ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘গণদেবতা’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' প্রভৃতি উপন্যাসে বাংলা সাহিত্যে ক্ষয়িষ্ণু গ্রাম বাংলার শহরমুখী যাত্রার কথা বর্ণিত হয়েছে। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-তে এই ধরনের ভাবনা লিপিবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু তা চিত্রিত হয়েছে একটু স্বতন্ত্র দৃষ্টির আলোকে।


‘পুতুল নাচের ইতিকথা'-গ্রামের নাম গাওদিয়া। নদী আর খাল মিলে গ্রামটির আসা যাওয়ার পথ। নৌকায় খাল পার হলেই গাওদিয়ার সড়ক। বাজিতপুর থেকে মাঠ ভেঙে এসে ঘাসের নীচে অদৃশ্য প্রায় রেখা দিয়ে পথ সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। বটগাছের শাখায় পাখি উড়ে আসে। বুঁদি গাছের ডালে একটা গিরগিটি অনেক পোকা গ্রাস করেছে। হারু ঘোষের মৃতদেহ নিয়ে যে পথ দিয়ে যায় সে পথ কাটা পথ। বর্ষাকালে একহাঁটু কাদা হয়। এঁটেল মাটিতে বিপজ্জনক রকমের পেছল হয়ে যায়। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বাতাসে ধূলো ওড়ে, গাছগুলিকে বিবর্ণ বলে মনে হয়। এই হল গাওদিয়া গ্রামের ছবি।


উপন্যাসের শুরু গাওদিয়া গ্রামের বটগাছের চিত্র দিয়ে। বৃষ্টি পড়েছিল সেদিন সশব্দে, বটগাছের ঘন পাতাতে বৃষ্টি আটকায়নি। এখানে মানুষের বসতি কম। গ্রামের মানুষ এদিকে আসে না, ভয় পায়। “গ্রামের লোক ভয় করিতে ভালবাসে”। এই ভয়ের ভালোবাসা গ্রামের মানুষের কুসংস্কার। ভিনগাঁয়ের সাপুড়ে এদিকে আসে। যামিনী কবিরাজের চেলা গুল্মলতা কুড়াইয়া লইয়া যায়। গ্রামীণ পরিবেশের চিহ্ন পাওয়া যায় গোবর্ধনের ভূত দেখার ভয়ে। কিন্তু শশী শহর থেকে পাশ করা ডাক্তার। সে ভূতে বিশ্বাস করে না। সে বলেছিল, 'ভূত যদি হয় তো বেঁধে এনে পোষ মানাব গোবর্ধন, নৌকা ফেরা।' কাছে গিয়ে সে হারুকে চিনতে পারে। “এ যে আমাদের হারু”। হারু বাজ পড়ে মারা গেছে। শশী তাকে চিনতে পারে। শশী গ্রামের ডাক্তার। সে সকলের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িত। সকলের পরিবারের সঙ্গে যুক্ত। এইভাবে গ্রাম ও শহরের টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে উপন্যাসের সূত্রপাত।


গ্রাম ও শহরের দ্বন্দ্ব প্রধানত প্রতিফলিত হয়েছে নায়ক-চরিত্র শশীর অন্তরে। শশী গ্রামের মানুষ, গ্রামের পরিবেশে সে বড়ো হয়ে উঠেছে। গ্রামীণ মানুষদের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মিক যোগ। তারপর লেখাপড়ার জন্য শশী কলিকাতার মেডিকেল কলেজে যায়। “তাহার হৃদয় ছিল সংকীর্ণ, চিন্তাশক্তি ছিল ভোতা, রসবোধ ছিল স্থূল। গ্রাম্য গৃহস্থের স্বকেন্দ্রীয় সঙ্কীর্ণ জীবনযাপনের মোটামুটি একটা ছবিই ছিল ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে তাহার কল্পনার সীমা।” 'গ্রাম্য গৃহস্থ' হবার স্বপ্ন ছিল যার চোখে তার জীবনে পরিবর্তন এল কলকাতা বাসকালে “কলিকাতায় থাকিবার সময় তাহার অনুভূতির জগতে মার্জনা আনিয়া দেয় বই এবং বন্ধু”। বন্ধুটির নাম কুমুদ। বাড়ি বরিশালে লম্বা কালো চেহারা। বেপরোয়া খ্যাপাটে স্বভাব। ...এই একটিমাত্র বন্ধুর প্রভাবে শশী একেবারে বদলাইয়া গেল।” শশীর জীবনে বাইরের আলো-বাতাস এল তার মধ্যে গ্রাম্য কুসংস্কার অনেকখানি ফিকে হয়ে গেল, তবু সে এই কুসংস্কার থেকে মুক্তি পায়নি। গ্রামে ফিরে এসে ডাক্তারি করতে গিয়ে তার মনে ‘কলকাতাবাসের স্মৃতি’ “বন্ধুর বিবাহের বাজনার মতো বাজিতেছিল, সহসা স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে।” তারপর গ্রামে ডাক্তারি করিতে বসিয়া প্রথমে সে যেন হাঁপাইয়া উঠিল।...এই সব অশিক্ষিত নরনারী, ডোবা, পুকুর, বনজঙ্গল, মাঠ, বাকি জীবনটা তাহাকে এইখানেই কাটাইতে হইবে নাকি? ও, ভগবান, একটা লাইব্রেরী পর্যন্ত যে এখানে নাই। সে তো গ্রামেরই সন্তান। গ্রাম্য নরনারীর মধ্যে গ্রামের মাটি মাখিয়া গ্রামে জলবায়ু শুষিয়া সে বড়ো হইয়াছে। হৃদয় ও মনের গড়ন আসলে তাহার গ্রাম্য। শহর তাহার মনে যে ছাপ দিয়াছিল তাহা মুছিবার নয়। কিন্তু সে শুধু ছাপ, দাগা নয়। শহরের অভ্যাস যতটা পারে বজায় রাখিয়া বাকিটা সে বিসর্জন করিতে পারিল। কুমুদ ও বইয়ের কল্যাণে পাওয়া বহু বৃহত্তর আশা-আকাঙ্ক্ষাও ক্রমে ক্রমে সে চিন্তা ও কল্পনাতে পর্যবসিত করিয়া ফেলিতে পারিল।” শশী চরিত্রের এই দ্বন্দ্ব তার সমস্ত জীবনকে চালিত করেছিল। শশীর গ্রামের মানুষদের প্রতি অশ্রান্ত ভালোবাসা কোথাও হ্রাস হয় নি। সে যথাসময়ে মতির বাড়িতে তার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করতে যেত, যত্ন করে পরীক্ষা করতে গিয়ে সে রহস্যময়ী কুসুমের খোঁটা শুনত, তবু তার কর্তব্যে ক্লান্তি নাই। মতির চোখে ডাক্তারবাবু আদর্শ মানুষ, তার মনের জগতে এই সুরের আসা-যাওয়া তাকে প্রবীর নামক রাজপুত্রের কল্পনায় প্রাণিত করেছিল। সে কলকাতা থেকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আহরণ করে এসেছে। কিন্তু গ্রামে সূর্যবিজ্ঞানে বিশ্বাসী যাদবের মত মানুষ এখনও আছে যার কাছে একালের ডাক্তার, কবিরাজ ‘দৃষ্টিহীন অন্ধ সব’। যাদব শশীকে বলে, “সূর্যবিজ্ঞান যে জানে সে শেকড়-পাতা খোঁজে না শশী। একখানি আতশ কাচের জোরে সূর্যরশ্মিকে তেজস্কর ওষুধে পরিণত করে রোগীর দেহে নিক্ষেপ করে—মুহূর্তে নিরাময়। মোটা মোটা বই পড়ে ছুরি-কাঁচি চালাতে শিখে কি হয়?” যাদবের এই উক্তি শশীকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। “গ্রাম্য মনের অপরিত্যাজ্য সংস্কারে সেও যাদবকে ভক্তি কম করে না, তাই সায় না দিলেও তর্ক সে করিতে পারে না।" যাদব শশীকে স্নেহ করেন। পাগলদিদি শশীকে দেখে স্নেহে-ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয়। দিনভর শশীর ব্যস্ততার মধ্যে সে বুড়োবুড়ির নীড়ে এসে শান্তি পায়। এখানে এসে তার মন জুড়িয়ে যায়। তার মনে গ্রাম-নগরের দ্বন্দ্ব আছে, একথা সত্য। কিন্তু সে এই বুড়োবুড়ির সংসারে এসে শান্তি পায়—“দিন ভরিয়ে তাহার শুধু মাটি-ছোঁয়ায় বাস্তবতা। শ্রান্ত মনে সন্ধ্যার জনহীন মন্দিরে বসার মত বুড়োবুড়ির এই নীড়ে সে শান্তি বোধ করে।” এখানে এসে মনের সপ্তাপ জুড়িয়ে আসে।


গাওদিয়া গ্রামে কেবল শশীর নয়, অনেকের ছিল উচ্চাশা। এমন একজন মানুষ হারু। “গাওদিয়া গোপসমাজ পরিহাস করিয়া তাহাকে বলিত ভদ্দরলোক। বাজিতপুরের ম্যাট্রিকুলেশন পাশ পাত্রটি দেখিতে গিয়া তাই না হারু অকালে স্বর্গে গেল।” মতি গাঁয়ের মেয়ে "গাঁয়ের মেয়ে গায়ে থাকাই তো ঠিক।” কিন্তু সুদেবের ঘরে মতির বিবাহ দিতে পরাণের দ্বিধা। মতির চোখে স্বপ্ন। মতির ভারি ইচ্ছা, বড়োলোকের বাড়িতে শশীর মতো বরের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। মতির এই ইচ্ছার বেগে সে চলে যায় কুমুদের হাত ধরে সুদূর প্রান্তে। উচ্চাশা গাওদিয়া গ্রামের গণ্ডী ছেড়ে এদের পার করে দিয়েছে। শহরের আকর্ষণে চঞ্চল অনুরূপ এক চরিত্র বিন্দু। “জীবনের অজ্ঞাত রহস্য গাওদিয়ার বিন্দুকে গ্রাস করিয়াছে। কলিকাতার অনামী রহস্য। কলিকাতায় থাকিয়া পড়িবার সময়ও শশী যাহা ভেদ করিতে পারে নাই।” বিন্দু সমৃদ্ধ জীবনের উচ্চাশায় নন্দলালের সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে উঠল। সেখানে নন্দলাল-বিন্দুর দাম্পত্য জীবনে অপমান, অমর্যাদা এসেছে। বিন্দুর এই উচ্ছৃঙ্খল আকাঙ্ক্ষার শাস্তি বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক লুপ্ত করার শাস্তি। বিন্দুর বাড়িতে গিয়ে শশী দেখেছে বিন্দুর ভাব অমায়িক। আবার কতদিন গিয়ে দেখে, বিন্দু প্রসাধনরতা। সে রহস্যময়ী। শহরে জীবনের চাকচিক্য দেখে বিন্দু পথ হারিয়েছে।


শশীর জীবনে গ্রাম্য মানসিকতার সঙ্গে নাগরিক মানসিকতার দ্বন্দ্ব অহরহ জাগ্রত ছিল। সে গ্রামের ভেতরে নিহিত, কিন্তু গ্রাম্যজীবন থেকে মুক্তির জন্য সে আবার চঞ্চল। “গ্রাম্য জীবনে আবার শশীর বিতৃয়া আসিয়াছে। মাঝখানে কিছুদিন সে যেন এখানে বাস করিয়াছিল অন্যমনস্কের মতো। আধখানা মন দিয়া সব সময় সে তাহার কাম্য জীবনের কথা ভাবিত–শিক্ষা, সত্যতা ও আভিজাত্যের আবেষ্টনীতে উজ্জ্বল কোলাহল মুখর উপভোগ্য জীবন। এখানকার মশকদষ্ট মৃত্তিকাহীন জীবন এই সান্ত্বনার জন্য শশীর সহ্য হইয়া আসিয়াছিল যে যখন খুশি গ্রাম ছাড়িয়া যেখানে খুশি গিয়া মনের মতন করিয়া জীবনটা সে আরম্ভ করিতে পারে। শশীর স্বাধীনতাও হরণ করে নাই কেহ। তবু শশীর মনে হয় চিরকালের জন্য সে মার্কামারা গ্রাম্য ডাক্তার হইয়া গিয়াছে এই গ্রাম ছাড়িয়া কোথাও যাইবার শক্তি নাই।” পরে সে বুঝছে “নিঃসন্দেহে এজন্য দায়ী কুসুম।" গ্রাম-বিতৃয় জীবনে বিন্দু আর মতি দুই বোন ছাড়া কারো সঙ্গ তার ভাল লাগে না। গ্রাম-শহরের দ্বন্দ্বের মূলে আছে তার উচ্চাশা, তার উত্তরণের প্রয়াস।


গ্রাম-শহরের দ্বন্দ্বের সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠেছে মাবনমনের সংরাগ। শশীর মধ্যে ছিল নীড়প্রেম। তার কল্পনার কেন্দ্রে ছিল কুসুম। “বিদ্যুতের আলোর মতো উজ্জ্বল যে জীবন শশী কল্পনা করিত সে জীবন যাযাবরের জীবন নয়, শশীর নীড়প্রেম সীমাহীন। কল্পনার তাই আর একটি কেন্দ্র ছিল শশীর—এক অত্যাশ্চর্য অস্তিত্বহীন মানবী, কিন্তু অবাস্তব নয়।”—এই মানবীই কুসুম, যার প্রতি তার হৃদয় সংরাগ ছিল অসীম। শশীর কাহিনী তাই বলা চলে শশী কুসুমের হৃদয় সম্পর্কের কাহিনী। শশীর এই প্রেম সোচ্চার নয়। কর্মে-কর্তব্যের মাঝে যন্ত্রস্রোতের মত এই প্রেমের ধারা বয়ে চলেছে। কুসুম যখন তাকে ত্যাগ করে দূরে চলে গেছে, তখন শশীর জগৎ অন্ধকার হয়ে যায়। “ভয়ানক মন কাঁদবে বৌ, জীবনে আমি কখনো তা হলে সুখী হতে পারব না।”—শশীর এই উক্তি তার দুঃখক্লিষ্ট প্রেমের প্রকাশ। কুসুম শশীর জন্য ঘর ছাড়তে পাগল ছিল, “আজ হঠাৎ বিরূপ হলে কেন?” এই প্রশ্ন শশীকে উদ্ভ্রান্ত করে দেয়। কুসুমকে গ্রামে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে শশী, ব্যর্থতার মুহূর্তে দীন শশীর মূর্তি সকলকে বিমূঢ় করে তোলে। সেনদিদির প্রতি সেবা, কুসুমের প্রতি প্রণয়, সবই তার হৃদয়সংরাগের প্রকাশ। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে শশীর মনে গ্রাম ছাড়ার বাসনা জাগে। “গ্রাম ও গ্রাম্য জীবনের প্রতি মাঝে মাঝে শশী গভীর বিতৃন্না বোধ করিয়াছে ধরিতে গেলে আজ কত বছর এখানে তার মন টিকিতেছে না। তবু ক্ষতের বেদনার মত স্থায়ী একটা কষ্ট শশীর মধ্যে আসিয়াছে, গ্রাম ছাড়িবার কথা ভাবিলে কেমন করিয়া উঠে মনটা।” সকলের ভালোবাসা পেয়ে শশী আজ পরিপূর্ণ। তাই গ্রাম ছাড়তে গিয়ে শশীর চোখে জল আসে “বওনা হওয়ার সময় চোখের কোণে জল পর্যন্ত আসিবে শশীর।” গাওদিয়া গ্রামে হাসপাতাল গড়ার মধ্যে শশীর গ্রাম ছাড়ার স্বপ্ন সার্থক হয়ে উঠেছিল। গোপালের হৃদয়ের যুক্তির সে উত্তর দিয়ে গ্রাম ছাড়ার পথে পা বাড়িয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর সফল হল না। “নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়া পথে কি মানুষের জীবনের স্রোত বহিতে পারে।” গ্রাম-শহরে স্বপ্নের মধ্যে হৃদয়-সংরাগ গভীরতর হয়ে তাকে গ্রামস্থ করে রাখল।