‘পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে কুসুম চরিত্র বিশ্লেষণ করে নারী চরিত্রসৃষ্টিতে মানিকের অসাধারণত্ব ব্যাখ্যা করো।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে নানাশ্রেণীর নারী চরিত্র সৃষ্টির সার্থকতা নানাভাবে লক্ষ্য করা যায়। 'দিবারাত্রির কাব্য'র সুপ্রিয়া বা ‘পদ্মানদীর মাঝি'র কপিলা নারীচরিত্রের নানা বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। কিন্তু ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'র কুসুম সত্যই অনন্য। কুসুম চরিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব, নানা জটিলতাকে উপস্থাপিত করেছেন। সব কিছু অতিক্রম করে কুসুম শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত নারী যার গভীর আসক্তি তার ব্যর্থতা ও বিষণ্ণতা দিয়ে পাঠককে আর্দ্র করে তোলে।


কুসুম পরানের বৌ। পরিবারের বন্ধু হিসেবে সে শাশুরি বা ননদের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে বনিবনা করে থাকতে পারে নি। সে খেয়ালী ও চঞ্চল, সন্ধ্যার সময় সে বড়িতে প্রদীপ জ্বালে নি। তাই দেখে মোক্ষদা তাকে নিন্দা করে, তিরস্কার করে। “বাড়িতে একটা বৌ আছে। অথচ সন্ধ্যাদীপ জ্বলে নাই। গলায় দড়ি দিয়া বৌটা মরিয়া যায় না কেন।” কুসুম এই ধিক্কারে হেসে ওঠে। কুসুম মোক্ষদার গাল শোনে নির্বিকার চিত্তে। তারপর উনুন থেকে জ্বলন্ত কাঠ এনে পিলসুজের দীপটা জ্বালায়। “কুসুমকে এ বাড়ির সকেল ভয় করে।” কুসুমের বাবার কাছে সাতবছর ধরে হারু ঘোষের সর্বস্ব বাঁধা পড়ে আছে। কিছু হলেই কুসুমের বাবা হয়ত নালিশ করে দেবে। কুসুম নিরীহ হয়ে থাকে। সে কাজ করে আপন মনে। কাজ করতে ভালো না লাগলে খিড়কির দরজা দিয়ে তালপুকুরের ধারে মাটিতে লুটোনো তাল গাছের গুঁড়িতে চুপচাপ বসে থাকে। এই একান্ত নির্জনপ্রিয়তা কুসুমের চরিত্রের একটি লক্ষণীয় দিক। পাড়ার লোকে তাকে একটু পাগলাটে ভাবে। মোক্ষদা জোর দিয়ে বলে, “বেশ পাগল পাগলের বংশ যে।” কুসুমের কথায় তীব্র ধার। শশী জ্বরগ্রস্ত মতিকে সন্ধ্যাবেলায় দেখতে এলে কুসুম ব্যঙ্গ করে। “সন্ধ্যাদীপ জ্বালাতে না জ্বালাতে দেখতে এসেছে দরদ কত?" কুসুম মতির প্রতি শশীর স্নেহকে নিয়ে ঈর্ষা করে। শশী স্টেথোস্কোপ দিয়ে মতির বুক পরীক্ষা করলে, কুসুম মন্তব্য করে—“এত পরীক্ষা কিসের।" কুসুমের এই সব ব্যবহার স্বাভাবিক নয়। বেগুনক্ষেতের বেড়ার ওপার থেকে কুসুম শশীকে ডাক দেয়, শশী অবাক হয়ে বলে যে তাকে সাপে কামড়াতে পারে। কুসুম বলে “সাপে আমাকে কামড়াবে না ছোটবাবু, আমার অদেষ্টে মরণ নেই।” শশীকে তোষামোদের কথা বলে, "পূজ্য মানুষ আপনি, আপনাকে পুজো করে আমাদের পুণ্যি হয়।" মতিকে আগামীকাল আবার দেখতে আসতে বলে, দেখে যাওয়া যে শশীর উচিত, সেকথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। কুসুম শশীকে বলে যে “মতি কি বললে জানেন? ছোটবাবুর অহংকার হয়েছে।” শশী তাকে এড়িয়ে চলে যেতে চায়। বেগুন ক্ষেতে দাঁড়িয়ে কুসুম হাসে। সামনে গাছের মাথার ওপর আলো হয়। কুসুম জানে ওখানে চাঁদ উঠবে। চাঁদ ওঠার আভাস দেখলে কুসুম যেন শুনতে পায়—“ভিনদেশি পুরুষ দেখি চাঁদের মতন/লাজরক্ত হইলা কন্যা পরথম্ যৌবন।” এই গানের মধ্যে কুসুমের হৃদয়ানুভূতি জেগে ওঠে।


কুসুমের হৃদয়ানুরাগকে সে প্রকাশ করে নানা ভাবে, নানা ভঙ্গীতে। প্রত্যেকটি ভঙ্গীই মাধুর্যে পূর্ণ হয়ে ওঠে। রাগের মাথায় ডালের হাঁড়িটা উঠোনে ছুঁড়ে দেয়, শশীর সামনে এসে দাঁড়ায়। ছোটবাবুকে জ্বর এল কিনা দেখতে বলে। পরে ঘরে শুতে চলে যায়। কিন্তু খানিক পরে সে উঠে আসে। সুদেবের সঙ্গে মতির বিয়ের প্রস্তাবে শশীর মত নেই শুনে সে যুক্তি দিয়ে শশীকে বোঝাতে চায়। শশী হারু কাকার অমতের কথাটা বলে। সে নানাভাবে শশীর কাছাকাছি আসতে চায়। কিন্তু সে চঞ্চলা, সে ছলনাময়ী। তার মধ্যে অবৈধ ভালবাসার দহনজ্বালা শুরু হয়। সে মতিকেও ঈর্ষা করে। বলে সুদেবের সঙ্গে তার নিকে হয়ে গেলে ছোটবাবু তালপুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করবে। কুসুম বাক্যপটীয়সী। সে কথা দিয়ে মতিকে নাজেহাল করে দেয়। মতি কুসুমের কথা শুনে তার হাত কামড়ে দেয়। মতির ভয় হয় যদি ছোটবাবু রাগ করে। মতির চোখে বৌ হয়ে ওঠে ভীষণ মেয়ে। অথচ যাত্রা শুনতে যাবার আগে ননদের সঙ্গে এক থালায় বসে খায়। এমনই তাদের সম্পর্ক।


কুসুমের এই কলহ-রেষারেষি ভরা গ্রাম্যজীবনে আসে নতুন মুক্তির সুর-তালপুকুরের ধারে শশীর সঙ্গে যখন তার দেখা হয়। পরাণ সব বিষয়ে উদাসীন। সন্ধ্যার পর সে ঝিমিয়ে পড়ে। কুসুম পরানকে ভর্ৎসনা করে যে মেয়ে মানুষের আঁচল ধরা পুরুষকে সে দুচোখে দেখতে পারে না। কুসুমের ভর্ৎসনা তার স্বভাবের অঙ্গ। সে যাত্রা শুনতে গিয়ে চরণ দত্তের গৃহিণীকে তীব্র ভর্ৎসনা করে। তখন আবার মতির কুসুমকে বড় ভাললাগে।

শশী কুসুমের মনকে বুঝতে পারে না। কুসুম শশীর কাছে অগাধ রহস্য। শশীর অহঙ্কারকে কুসুম প্রয়োজনে আঘাত করতে দ্বিধা করে না। কুসুম একদিন একা একা শশীর ঘর দেখতে আসে। বাবা দাওয়ায় এসে বসেছেন, শশীর খবরে কুসুম বিচলিত হয় না।


তালপুকুরের ধারে কুসুম শশীকে ডেকে নিয়ে আসে। উপলক্ষ্য হয়ত বিন্দুর কথা। শশীর গোপন কথা কুসুমকে না বলে পারে না। শশী আবিষ্কার করে যে কুসুমের মধ্যে একটা বালিকা আছে। সে সংসারের সব দায়িত্ব যখন ভুলে যায়, তখন এই বালিকাটা আত্মপ্রকাশ করে। কুসুম ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে ওঠে, কিন্তু তার পাগলামি শশী যা দেখেছে, তাকে তার গম্ভীর ও সহিষ্ণু প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে নি। কুসুমের ব্যবহার খাপছাড়া, রমণীর রমণীয় ব্যবহার তার মন ভুলোবার জন্য। শশী কিন্তু কুসুমের এই নীরব ভালবাসাকে বুঝতে পারে না। “একটি নারী মন ভুলাইতে চাহিতেছে এটুকু বুঝিতে কি সাত বছর সময় লাগে মানুষের? এই কুসুমের মধ্যে যে কুসুম কিশোরী বয়সী, সে শুধু খেলা করিত শশীর সঙ্গে। শশী তো চিনিত না, তাই ভাবিত, এত বয়সে পাগলামী গেল না কুসুমের।”


কুসুমের নীরব অনুভূতি নানা আকারে ইঙ্গিতে সরব হলেও শশীর অন্তর তাতে সঠিকভাবে জাগে নি। কুসুম-শশীর সম্পর্কের পরিণতি এইভাবে গভীরতা মণ্ডিত হয়ে ওঠে। হাস্য-লাস্যের মধ্যে দিয়ে যার শুরু, তা শেষ পর্যন্ত এক গভীর অন্তর্দ্বন্দু ও বেদনার্ত পরিণতিতে এসে পড়ে। কুসুমের দ্বন্দ্ব ছিল সমাজসত্তার সঙ্গে ব্যক্তিসত্তার। সে বুঝেছিল যে এই আসত্তি অবৈধ। এই বোধের ফলে তার মনে এসেছিল দ্বিধা সংকোচ। এক্ষেত্রে তার মধ্যে কোন সামাস্য গড়ে ওঠেনি বলে তার আচাবে-আচরণে এসেছে অসঙ্গতি। শশীর চোখে কুসুম ‘সরলা বালিকা’, মতির চেয়েও নির্বোধ।' আবার কখনও 'কুটিলা কৌশলী' নারী—“নিখুঁত কৌশলে মতির বিবাহ সম্বন্ধে মনের মোড় ঘুরাইয়া দেয়।”


কুসুম রহস্যময়ী নারী। বিচিত্ররূপিণী নারী। তার খাপছাড়া প্রকৃতির কথা শশী বার বার বলেছে, তার কথাবার্তা অনেকখানি অসঙ্গতিতে পূর্ণ। শশীর জন্য তার “উন্মাদ ভালবাসা।" এই ভালবাসা শরীরী আকর্ষণের বিন্দুতে তন্ময়—'আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটবাবু?" উম্মত্ত ভালবাসার এই শিহরণ কুসুম বহন করে বেড়ায়। সে শশীর জন্য প্রতীক্ষা করে, কিন্তু শশীর নির্লিপ্ত-নির্বিকার মনে এই ভালবাসার ডাক যে কোন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে না, তাতে সে দুঃখ পায়। তার ক্লিষ্ট মন শেষ পর্যন্ত নিজের মধ্যেই নিজেকে মেরে ফেলে। কুসুম তার এই প্রতীক্ষা, তার মর্মযন্ত্রণা, তার মানসিক মৃত্যুর কথা উপন্যাসের শেষে শশীকে বলে: “লাল টকটকে করে তাতানো লোহা ফেলে রাখলে তাও আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে যায়, যায় না? কাকে ডাকছেন ছোটবাবু? কে যাবে আপনার সঙ্গে? কুসুম কি বেঁচে আছে? সে মরে গেছে?” কুসুমের এই উত্তি, এই স্বীকৃতি, এই অসহযোগ শশীকে বিপর্যস্ত করে দিল। নারীহৃদয়ের গভীর রহস্যকে জানার পর শশীর জীবনে আসে এক অবিশ্বাস্য পরিবর্তন। তার নিকটতম সত্তার আত্মিক মৃত্যু তারই সামনে ধীরে ধীরে হয়েছে, একথা সে বুঝতে পারে নি, এই কথা ভেবে শশীর মন আর্তনাদ করে ওঠে।” নারীচরিত্র যে রহস্যময়ী কতখানি ভঙ্গুর তা ছিল শশীর অভিজ্ঞতার বাইরে। এত বড় বড় কল্পনা শশীর এত বিরাট ও ব্যাপক সব মনোবাসনা, একদিনে সব যেন পৃথক অনাবশ্যক হইয়া গেল।" এইভাবে কুসুমের বিচ্ছেদ শশীকে বিপর্যস্ত করে দেয়। কুসুম শশীকে বলে, “যা মুখে আসে বলতে দিন আজ। বলতে কি চেয়েছিলাম আজ। কে আপনাকে জানতে বলেছিল গাঁ ছেড়ে চলে যাব? কে বলেছিল এখানে ডেকে আনতে? জানেন আমার মাথা খারাপ, পাগলাটে মানুষ আমি, তবু যাওয়ার দুদিন আগে আমাকে ডেকে আনা চাই, আজে-বাজে কথা বলে কান ঝালাপালা করা চাই। দশ বছর খেলা করেও সাধ মেটে নি। আমরা মুখ্যু গেঁয়ো মেয়ে, এসব খেলার মর্ম তো বুঝি না, কষ্টে মরে যাই।”—শশী অবাক হয়ে যায় কুসুমের শেষবেলার অভিযোগ শুনে। শশীর মুখে প্রতিবাদের ভাষা নেই। সাশ্রু নয়নে কুসুম শশীর কাছে হৃদয় উন্মোচন করে। তার কণ্ঠে ফুটে ওঠে অসহায় আত্মসমর্পণের সুর। কুসুম বলে “এমন হবে ভাবিনি, ছোটবাবু, তাহলে কোনকালে গাঁ ছেড়ে চলে যেতাম।” কুসুমের নালিশের জবাব দিতে শশী পারেনি। “কী বলা যায় কুসুমকে কী করা যায়। কে জানিত মোটে দুদিনের নোটিশে কুসুম তাকে এমন বিপদে ফেলিবে, তার গুছোনো মনের মধ্যে এমন ওলটপালট আনিয়া দিবে।” কুসুমের অপার্থিব শরীরকে শশী আলিঙ্গন করতে পারে নি, কিন্তু হাত ধরে তাকে কাছে টেনেছে শশী। কুসুম তাকে কৃত্রিম রাগের কথা প্রকাশ করে “রেগে টেগে উঠতে পারি তো আমি? বড়ো বেয়াড়া রাগ আমার?” শশী এতদিন পরে তাকে প্রস্তাব দেয় “আমার সঙ্গে চলে যাবে, বোঁ।” কুসুম উত্তরে বলে, “আপনি বুঝি ভেবেছিলেন যেদিন আপনার সুবিধে হবে ডাকবেন, আমি অমনি সুড়সুড় করে আপনার সঙ্গে চলে যাব? কেউ তা যায়?” কুসুমের এই উক্তি রহস্যময়ী নারীর উক্তি, অভিমানী নারীর উক্তি। আত্মসম্মানে দৃপ্তা নারীর কণ্ঠে এই চ্যালেঞ্জের সুর জেগে ওঠে। কুসুম তার পরিবর্তনশীলতা স্বীকার করে। সে বলে, “চিরদিন কি এক রকম যায়? মানুষ কি লোহায় গড়া, চিরকাল সে এক রকম থাকবে, বদলাবে না? বলতে বসেছি যখন কড়া করেই বলি, আজ হাত ধরে টানলেও আমি যাব না।" এই উক্তির মধ্যে কুসুমের তেজ ও অভিমান একই সঙ্গে আত্মপ্রকাশ করে। শশীর অসহায় দৈন্য কুসুমকে কোমল করে তোলে। সে বলে যে তার জন্য কি ছোটবাবুর মন কাঁদবে? তার কাছে সে কত তুচ্ছ, দুদিন পরে হয়ত তাকে মনেও পড়বে না। এই অভিমান নিয়ে কুসুম শশীর কাছ থেকে বিদায় নেয়। যে কুসুম শশীর জন্য ঘর ছাড়তে পাগল ছিল, সে আজ বিরূপ হল কেন?—শশীর এই প্রশ্নের উত্তরে কুসুমের তাকে তার দীর্ঘপ্রতীক্ষার ব্যর্থতার কথা বলে। “কুসুম মরিয়া গিয়াছে। সেই চপল রহস্যময়ী, আধো-বালিকা, আধো-রমণী, জীবনীশক্তিতে ভরপুর, অদম্য অধ্যবসায়ী কুসুম।”—কুসুমের এই পরিণতি দুঃখবহ, কিন্তু শশী-কুসুমের সম্পর্কের বিবর্তনে তা যথাযথ। এই দিক থেকে বিচার করলে বোঝা যায়, কুসুম এক অসামান্য চরিত্র।