‘মুক্তধারা' নাটকের মূল বক্তব্য মর্মকথা | 'মুক্তধারা' নাটকের মধ্যে দিয়ে লেখকের কোন বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে তা আলোচনা কর।

নাটক-গল্প-উপন্যাস-কবিতা বা যে কোনো শিল্পের মধ্যে দুটি রূপ নিহিত। একটি তার বাহ্যিক রূপ, অপরটি অন্তর্নিহিত রূপ। বাহ্যিক রূপের মধ্যে শিল্পের রসালঙ্কারাদি রূপভেদের ও বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। আর অন্তর্নিহিত রূপের মধ্যে ফুটে ওঠে শিল্পটির মূল বক্তব্য- মর্মকথা। শিল্পের কাহিনি, ঘটনা সংঘটন, রসাভাস প্রভৃতির সঙ্গে মর্মবস্তুটির কোনো মিল থাকতেও পারে আবার না থাকতেও পারে। কিন্তু শিল্পের আখ্যান বস্তু বা বাহ্যদৃশ্য যাই থাক না কেন, মর্মবস্তুটিই তার মুখ্য উপজীব্য হয়ে থাকে। উদাহরণ দিয়ে বলা যেতে পারে, কোনো সুদৃশ্য খাঁচায় পাখিকে যেমন রাখা হয় তেমনি সুদৃশ্য মোড়কে মর্মবস্তুর উপস্থাপনই শিল্পসৃষ্টির এক অন্যতম রীতি। আমাদের আলোচ্য ‘মুক্তধারা' রচনার ক্ষেত্রেও এই একই কথা বলা যেতে পারে।


রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমস্ত রচনার পশ্চাতেই কোনো না কোনো প্রেরণা বা বেদনা কাজ করেছে। সেই উৎস-ঘটনা বিষয়ে কবির বিশেষ বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচনাবলীর মধ্যে, বিশেষ করে পত্রাবলী ও ডায়েরীর মধ্যে, কখনও তা প্রত্যক্ষভাবে কখনও বা পরোক্ষে। সেই সমস্ত অভিজ্ঞতা, প্রেরণা বা বেদনা সঞ্জাত বক্তব্য সাংকেতিক পর্যায়ের নাটকগুলির মধ্যে রূপকাকারে ব্যক্ত হয়েছে। নাট্য ঘটনার আবেশে পাঠক ও শ্রোতারা সে দিকে প্রায়শই বিশেষ লক্ষ করেন না। ‘মুক্তধারা' নাটকের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটেছে। যার জন্যে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপের সঙ্গে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে এক পত্রে লিখেছিলেন, ‘বোধ হয় যাঁরা কেবল কানে শুনে গেছেন তাঁরা ভিতরের দিক থেকে এই চিরন্তন পথতত্ত্বটিকে একেবারে গ্রহণই করেন নি।’ কারণ তিনি চেয়েছিলেন ‘মুক্তধারা' নাটকের মধ্যে যে কথাটি অভিব্যঞ্জিত, তার তত্ত্ব পাঠক-সমাজ হৃদয়ঙ্গম করুক, নচেৎ তাঁর পথ প্রদর্শনের প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যাবে।


রবীন্দ্রনাথের এই আক্ষেপোক্তির পিছনে যে করণটি নিহিত তা হল, তিনি যখন নাটকটি পাঠ করে শুনিয়েছিলেন, তখন তাঁর স্বকণ্ঠে পাঠের আবেশে মোহিত হয়ে নাটকের অন্তনির্হিত বক্তব্যে শ্রোতারা মননিবেশ করতে পারেন নি। এতে শ্রোতাদের খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। কেন না, বই যতটা নিবিষ্ট হয়ে পড়া যায়, পাঠ ততটা নিবিষ্ট হয়ে শোনা সম্ভব হয় না। তাই রবীন্দ্রনাথের নাটকের চিরন্তন পথতত্ত্বটি শ্রোতাগণের অধরা থেকে গিয়েছিল।


একটু ইতিহাস চর্চা করে নিলে ‘মুক্তধারা' নাটকের মর্মকথাটি সহজে ধরতে পারা যাবে। আলোচ্য নাটকটি রচনার কিছুকাল আগে রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্ত্য ভ্রমণে গিয়েছিলেন। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলি তখন আপন আপন অর্থ ও শক্তিবল সংগ্রহ ও সঞ্চয়ের প্রতিযোগিতায় মেতেছিল। দুর্বলের ওপর প্রশাসনিক বল প্রয়োগে আপন স্বার্থ সিদ্ধি কায়েম করার নেশায় মেতে মানবতাকে বলি চড়িয়েছিল তারা। রবীন্দ্রনাথের মন ব্যথিত ও বিক্ষুব্ধ হয়েছিল। দেশে ফিরেও দেখলেন ইংল্যণ্ডের অধিকৃত ভারতবর্ষের জনগণকে জব্দ করার জন্যে খাদ্য-বাণিজ্য বেশভূষা ব্যবস্থা সমস্ত ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রনীতির নাম করে স্বৈরাচারের করাল প্রলম্ব থাবার আগ্রাসন। এমন কি, শিক্ষা ব্যবস্থাকে করে তুলেছিল গোলাম তৈরির কারখানা। বর্ণবৈষম্য যুক্ত ও বিযুক্ত শোষণ পীড়নের ঠেলায় শাসক ও শোষিতদের মনুষ্যত্ব হয়েছিল বিসর্জিত। শোষিতেরা তাই নির্জীব ক্লীবের মতো কেবল নিজেরটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তারও মধ্যে ইতস্তত যে মানবমুক্তির আন্দোলন চলেছিল, তা-ও আবেগ সর্বস্বতা ও সত্যনিষ্ঠার অভাবে হয়েছিল ব্যর্থপ্রায়। এমত অবস্থায় শাসন শোষণে শৃঙ্খলিত মানবাত্মার মুক্তির মার্গদর্শন অভিলাষে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন 'মুক্তধারা'।


প্রথমবার, এর মধ্যে যে কাহিনিটি ব্যক্ত তা পাঠ করে মনে হতে পারে-এটি রবীন্দ্রনাথের যন্ত্র বিরোধী আন্দোলনের আহ্বান। প্রায় দুশো বছর আগে ইংল্যণ্ডে যে যন্ত্র বিরোধী লুডাইট রায়ট সংঘটিত হয়েছিল তারই ছায়াপাত বুঝি ঘটেছে মুক্তধারা নাটকে। বিশেষ করে বর্তমান কালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সমগ্র মানবজাতির মনে যন্ত্রনির্ভর বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে যে অভিমত ধ্বনিত, তাতে এ কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে নাটকের মধ্যে সে কথা ব্যক্ত হয় নি। রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রের বিরোধী ছিলেন না, বিজ্ঞানের বিরোধী ছিলেন না। যদি থাকতেন, তবে শান্তিনিকেতনে জলের ব্যবস্থার জন্যে, কৃষির ব্যবস্থার জন্যে তিনি যন্ত্রের সাহায্য নিতেন না। যন্ত্র যে পর্যন্ত মানবকল্যাণের আশ্রয়, রবীন্দ্রনাথ সে পর্যন্তই তার কৃতিত্ব স্বীকার করতেন। কিন্তু যন্ত্রের নিষ্পেষণে মানবাত্মা পীড়িত, যন্ত্র যেখানে মানুষকে দাসে পরিণত করেছে, সেখানেই তিনি খড়ড়্গ হস্ত হতে চেয়েছেন। কারণ মনুষ্যত্বের অবমাননা তিনি সহ্য করতে পারেন নি। 'শিক্ষার মিলন' প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “যান্ত্রিকতাকে অন্তরে বাহিরে বড়ো করে তোলায় পশ্চিম সমাজে মানব-সম্বন্ধের বিশ্লিষ্টতা ঘটেছে। কেন না স্ক্রু দিয়ে আঁটা, আঠা দিয়ে জোড়ার বন্ধনকে ভাবনায় এবং চেষ্টায় প্রধান করে তুললে, অন্তরতম সে আত্মিক বন্ধনে মানুষ স্বতঃপ্রসারিত আকর্ষণে পরপর গভীরভাবে মিলে যায়, সেই সৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন বন্ধন শিথিল হতে থাকে।” তাই হানাহানি কাটাকাটির পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হবার উপায় নির্দেশ করেছেন ‘মুক্তধারা' নাটকের মধ্যে।


আলোচ্য নাটকের রাজা চেয়েছিলেন, পানীয় জলের সরবরাহ বন্ধ করে শিবতারাই-এর বিদ্রোহী প্রজাদের জব্দ করে আপন সিংহাসনের তলায় দাবিয়ে রাখবেন। সেই উদ্দেশ্যেই যন্ত্ররাজ বিভূতিকে দিয়ে মুক্তধারার স্বচ্ছন্দ প্রবাহকে বন্দী ও বদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কার্যত তাঁর সে সমস্ত প্রচেষ্টা, উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল। এই ব্যর্থতার একমাত্র কারণ হল, নির্মমতা, মানবতাহীনতা। বল প্রয়োগ করে, ভয় দেখিয়ে, অর্থ দিয়ে প্রজাদের কেবল মাত্র মাথাটাই কেনা যায়, হৃদয় কেনা যায় না। যন্ত্রের দাসত্ব করে শুধু রণজিৎ নয়, উত্তরকূটের প্রায় সমস্ত মানুষই এই হৃদয়হীনতার শিকার। তাদের মধ্যে হৃদয়বৃত্তির উৎসার ঘটাতে, শবের মধ্যে শিব স্থাপন করতে বাইরে থেকে একটা আঘাত করার প্রয়োজন ছিল। অভিজিৎ সেই আঘাতটি করেছেন আপন প্রাণ সমর্পণ করে। 'বিসর্জন' নাটকে যেমন জয়সিংহর প্রাণ সমর্পণ রঘুপতির মানবতাকে জাগিয়েছিল, ‘রক্তকরবী’র রঞ্জনের মৃত্যু যেমন জাগিয়েছিল রাজা সহ সমস্ত যক্ষপুরীর মনুষ্যত্ববোধ। তেমনি ‘মুক্তধারা' নাটকের মধ্যে অভিজিতের প্রাণ বিসর্জনে, প্রিয় বিরহের সুর সকল হৃদয়ে একসুরে বেজে ওঠার জন্যে সর্বত্র মানবতা উদ্বোধিত হয়েছে। ধনঞ্জয় তাই নিঃসন্দিগ্ধ হয়েই গণেশের কথার উত্তরে বলেছেন, 'চিরকালের মতো পেয়ে গেলি রে।”


অভিজিতের এই তিরোধানের মধ্যে দিয়ে সবার মাঝে পরিব্যাপ্ত হওয়ার যে তত্ত্বটি এখানে ব্যক্ত, সম্ভবত তাকেই নাট্যকার ‘চিরন্তন পথতত্ত্ব’বলতে চেয়েছেন। নাটকের কাহিনির মধ্যে তা প্রধানত পথ ও প্রবাহের ধারা মুক্তির প্রতীকরূপে প্রকাশ পেয়েছে। মুক্তধারার ঝর্না এবং মানবের জীবন উভয়ই প্রৈতীযুক্ত। বিজ্ঞানকে অবলম্বন করে লোহার বাঁধ বেঁধে ঝর্নার প্রবাহকে ঠেকানো যেমন সম্ভব নয়, শোষণ পীড়ন সংঘাতের চাপে মানুষের জীবন প্রবাহকেও তেমনি অবরুদ্ধ করে রাখা অসম্ভব। যুবরাজ অভিজিতের জন্ম রাজবাড়ির বিলাস ব্যাসনের চার দেওয়ালের গণ্ডীতে হয়নি। তিনি প্রকৃতির সন্তান, মহাকবি কালিদাসের শকুন্তলার মতোই তিনি কোমল চিত্তবৃত্তি যুক্ত। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে মানবমুক্তির জন্যে আপন প্রাণ বিসর্জন দিয়ে তিনি সকলের মধ্যে প্রাণ তথা প্রেম সঞ্চার করেছেন। শোষণের চাপে ক্লিষ্ট প্রাণের প্রবাহকে তিনি মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। সমগ্র নাটকের মধ্যে তাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই বাণী— ‘মরমে মরমে বেদনা ফুটে বাঁধন টুটে, বাঁধন টুটে।' মর্মে বেদনা ফুটে না উঠলে বন্ধনকে, পীড়নকে প্রতিরোধ করা যায় না। অভিজিতের মর্মবেদনাই বিস্তৃতির বাঁধকে আঘাত করে মুক্ত করেছে বদ্ধ প্রবাহকে। অচলতার শাসনরীতিকে ভেঙে মানবতা প্রতিষ্ঠার পন্থা নির্দ্ধারণই অবশেষে হয়ে উঠেছে আলোচ্য নাটকটির মর্মকথা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, “পথকে মুক্ত করা, মানবের মিলনের পথকে উন্মুক্ত করিয়া দেওয়াই যে সভ্যতার শেষ কথা, উহাই নাটকে বিশেষ ভাবে দেখান হইয়াছে।”