সাংকেতিক নাটকের স্বরূপ বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে যে কোন একটি বাঙলা সাঙ্কেতিক নাটক সম্বন্ধে আলোচনা কর।

রূপক ও সাঙ্কেতিক নাটকের পার্থক্য আলোচনা কর।


সাঙ্কেতিক নাটকের (symbolic drama) স্বরূপবৈশিষ্ট্য অনুধাবন করার আগে প্রতীক (symbol) সম্বন্ধে আলোচনার প্রয়োজন। প্রতীক বা সংকেত বলতে কি বোঝায় তা বুঝে নিলেই সাঙ্কেতিক নাটকের বৈশিষ্ট্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। Symbol শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে গ্রীক ক্রিয়া (Symbollein) থেকে অর্থাৎ তার অর্থ, কোনও কিছু একত্রিত করা, তার বিশেষ্য রূপ (Symbelon), তার অর্থ চিহ্ন, নিদর্শন (token) ইত্যাদি। চুক্তিকারী দুটি দলের মধ্যে প্রত্যেকটি দল প্রতিশ্রুতি হিসেবে মুদ্রার অর্ধাংশগুলি নিয়ে যেত, সেই অর্থেই Symbelon প্রযুক্ত হত। সুতরাং Symbol-এর মূল অর্থ, যোগ করা বা সমন্বিত করা, যুক্ত বা সমন্বিত জিনিসটি নিজেই একটি সমগ্র কিছুকে প্রকাশ করে। তার থেকে সাহিত্যে Symbol-এর অর্থ দাঁড়ায়, কোনও কিছুকে এমনভাবে উপস্থাপিত করা, যায় বস্তুরূপ অনুষঙ্গের (association) সূত্রে অন্য কিছুকে বোঝায়, যা সাধারণতঃ বস্তুগত নয়, এবং বৃহত্তর বা গভীরতর। সাংকেতিক নাটকে দৃশ্য, ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিগ্রাহ্যরূপে অদৃশ্য, অতীন্দ্রিয় ও রহস্যময় জগৎ ব্যঞ্জিত হয়। সাংকেতিক নাটকে কবিত্বপূর্ণ ভাষায়, ব্যঞ্জনায়, নানা সূক্ষ্ম আভাসে ইংগিতে গোধুলির মত ঈষৎ অন্ধকারে মিশ্রিত কুহেলিকাময় বিচিত্র পরিবেশ বা আবহে, বস্তুরূপের মধ্য দিয়েই অতীন্দ্রিয় জগতের সত্য আভাসিত হয়। এই প্রসঙ্গে রূপক ও সাংকেতিক নাটকের পার্থক্য সম্বন্ধে আলোচনা করা দরকার। রূপক নাটকে প্রধান অবলম্বন মূর্তিস্বরূপতা (personification)। আমরা সেখানে বস্তুরূপ ও রূপকার্যকে আলাদাভাবে চিনে নিতে পারি, বস্তুরূপের মধ্যে নিহিত তত্ত্ব বা নীতি প্রত্যক্ষ ও সুস্পষ্টভাবে ধরা দেয়। সাংকেতিক নাটকে বস্তুরূপেই সংকেত বা প্রতীক হয়ে ওঠে, তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় না। নাটকে আমরা যা দেখি ও শুনি সবই অতীন্দ্রিয় রহস্যময় জগৎ বা সত্তার দ্যোতনাময়, তাকে দিবালোকের মত প্রত্যক্ষ সত্যরূপে নয়, রহস্যময় রূপেই অনুভব করি।


সংকেত বা প্রতীক গভীর, রূপক অপেক্ষাকৃত স্থূল ও অগভীর। বিখ্যাত আইরিশ নাট্যকার ও কবি ইয়েট্স সেই সম্পর্কে বলেছেনঃ “A symbol is the possible expression of some invisible essence, a transparent lamp about a spiritual flame while allegory is one of many possible representations of an embodied thing, of familiar principle and belongs to fancy and not imagination. The one is a revelation, the other an amusement." সাংকেতিক নাটকে জীবন চিত্রণ বা দৃশ্যাবলী কিংবা চরিত্রের নাটকীয় বিকাশ নয়, নাট্য বিষয়ের ব্যঞ্জনাময় রূপায়ণই প্রধান লক্ষ্য।


অগাস্ট স্ক্রীন্ডবার্গের (১৮৪৯-১৯১২) Easter, Dance of Death, The Dream Play 3 The Spook Sonata প্রভৃতি নাটকগুলিতে শীতের অন্ধকার ও শীতল আবহাওয়ার মত প্রকৃতির পটভূমি, অলৌকিক জগতের চরিত্রগুলির মত লৌকিক চরিত্রগুলিও অস্পষ্ট, ছায়াময় স্বপ্নদৃশ্যের দুর্ভেয়তা ও রহস্যময়তা উপস্থাপিত হয়েছে। মরিস মেটারলিংকের (১৮৬২-১৯৪৯) The Blind, The Blue Bird প্রভৃতি সাংকেতিক নাটকগুলির রূপবৈশিষ্ট্য স্কীন্ডবার্গের মতই, কিন্তু এই রচনাগুলির সাংকেতিকতা আরও গভীর ও সার্থক।


রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাংকেতিক নাটক রচনায় এই বিদেশী নাট্যকারদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে সমালোচকেরা অনুমান করে থাকেন। মেটারলিংকের The Blue Bird প্রধান দুটি চরিত্রের নীলপাখির সন্ধানে অভিযান-যাত্রা জগতের নিগূঢ় আনন্দ ও সত্য অন্বেষণে মানুষের চিরকাল প্রয়াসের সংকেতই বহন করে।


হাউপ্টম্যানের The Sunken Bell সাংকেতিক নাটকে আমরা দেখি, হইনরিখ পর্বতচূড়ায় ঘণ্টা ঝোলাতে গিয়েছিল, কিন্তু অদৃষ্টের বিড়ম্বনায় সেই ঘণ্টা কর্দমাক্ত জলাশয়ে পড়ে গেল, সে নৈরাশ্য ভেঙ্গে পরে বলে ওঠে, এটি উপত্যকার জন্যেই ছিল, পর্বতচূড়ায় জন্য নয়। তার এই ব্যর্থ প্রয়াস এবং নৈরাশ্য বেদনা প্রতিকূল প্রকৃতির নির্মমতায় মানুষের আশাস্বপ্নসাধ ও প্রয়াসের নিষ্ফলতার সাংকেতিক দ্যোতনায় অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইয়েট্স এর নাটকগুলিও এই ধরনের সাংকেতিক ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ।


রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটক 'অচলায়তন' ও সাংকেতিক নাটক 'রাজা'র তুলনামূলক আলোচনায়ও রূপক ও সাংকেতিক নাটকের পার্থক্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়। ‘অচলায়তনে' অচলায়তন সমাজের অন্ধ সংস্কার-বিশ্বাস আচার-বিচার নিয়মের রূপক, মহাপঞ্চক তাদের মূর্তিস্বরূপ, পঞ্চক মুক্তিপিপাসু, মানবহৃদয়ে প্রতিভূ শোনপাংশুরা গতিশীল, কর্মপ্রিয়, বৈষয়িক উন্নতি সাধনে লক্ষ্যবদ্ধ ইয়োরোপীয় জাতির মূর্তিস্বরূপ, দর্ভকরা অস্পৃশ্য, অন্ত্যজ, আদিম জাতি এবং সহজ সরল ধর্মবিশ্বাসী ও অনাবিল ভক্তির মূর্তিস্বরূপ। নাটকের কেন্দ্রীয় শক্তি যিনি গুরু গোঁসাই ও দাদাঠাকুররূপে প্রতিভাত, তিনি বা ধর্মের মূর্তিস্বরূপ। নাটকটিতে কোথাও কোনও অতীন্দ্রিয় রহস্যের ব্যঞ্জনা নেই, রূপকার্থ এবং রবীন্দ্রনাথের সমাজ সমালোচনার নৈতিক উদ্দেশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট।


এবার রবীন্দ্রনাথের 'রাজা' নাটক সম্বন্ধে আমরা আলোচনা করতে পারি। ‘রাজা’ নাটকের নায়িকা সুদর্শনা বাইরের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ ও সৌন্দর্যের মধ্যে অরূপকে সন্ধান করেছিল। সেই পরমপুরুষকে যে কোনও বিশেষ রূপে ও স্থানে পাওয়া যায় না, নিজের অহংবোধপ্রসূত মোহে সে উপলব্ধির চেষ্টা করে নি। মঞ্চে রাজাকে কোনও সময়েই দেখা না গেলেও সমগ্র নাটকে তার অদৃশ্য উপস্থিতি আমরা সকল সময়েই অনুভব করি। নাটকের বাতাবরণ বা আবহ থেকে আমরা অনুভব করি, বিশ্বের সমস্ত রূপেই অন্তরালবর্তী পরম সত্তাকে ঈশ্বর বা অন্য যে কোনও নামেই অভিহিত করা হোক, তাঁকে কোনও নামে বা রূপের নিজের ব্যক্তিগত সম্পদের বা অধিকারের মত ধরা যায় না। 'রাজা' নাটকে দুটি ব্যঞ্জনাময় বাতাবরণ চিত্রিত হয়েছে, অন্ধকার ঘর ও বসন্তপ্রকৃতি। অন্ধকার ঘরে রাজার অধিষ্ঠান, সুদর্শনা তার মধ্য থেকে শুধু তার রাজার কণ্ঠস্বরই শুনতে পেয়েছে আর তাঁর আলোকের দ্যুতিময় আকণ্ঠ জ্বালাময় তৃষ্ণায় অস্থির হয়েছে, সেই তৃষ্ণার অগ্নিবলয় তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। বসন্ত প্রকৃতির আলোকোজ্জ্বল উৎসব মুখর রমণীর রূপেও রাজা বিরাজমান, তিনি একদিকে রুদ্র ও ভয়ংকর, অন্যদিকে প্রসন্ন, অরূপ হলেও নিত্যলীলায় তাঁর মধুর প্রকাশ।


সুদর্শনার বিভ্রান্তি ও মোহের সুযোগ নিয়ে সুবর্ণ ও কাঞ্চীরাজ তার জীবনে অশুভ দুষ্টগ্রহের মত আবির্ভূত হয়। পরমপুরুষকে অনুভব করতে হয় নিজের অন্তরে, সুদর্শনার অন্তর্দৃষ্টি উন্মীলিত না হওয়ায় সে বাইরের রূপের জগতে তাঁকে পেতে চেয়েছে। রাজা তার আসন্ন সর্বনাশের মুহূর্তে তার কাছে ধরা দিয়েছেন, সুদর্শনাও দুঃখের আগুনে পুড়ে সর্বময় রাজাকে অন্তরের মধ্যে অনুভব করার শক্তি অর্জন করেছে।