'পয়োমুখম্' গল্পটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।

সৃষ্টির বা শিল্পের নামকরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক বিষয়। নামহীন কিছুই হয় না। পরিচিতির জন্যে পরিচয় জ্ঞাপনের জন্যে একটা নাম থাকা চাই। সে নাম এমন কিছুকে কেন্দ্র করে হতে হয় যাতে শিল্পের লক্ষণী-অভিধা-ব্যঞ্ছনার বিচ্ছুরণ নামের সাথেও হতে পারে। বক্ষ্যমান গল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায়, চরিত্র নির্ভর গল্প হওয়া সত্ত্বেও এর নাম কোনো চরিত্রকে আশ্রয় করে দেওয়া হয় নি। পক্ষান্তরে একটি চরিত্রের স্বভাব বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে, উক্ত চরিত্রের স্বভাব চরিত্রের তুলনাত্মক একটি সংস্কৃত শ্লোকের অংশকে ব্যবহার করা হয়েছে। গল্পে চিত্রিত কৃষ্ণকান্ত কিম্বা ভূতনাথের নাম থেকেও গল্পের নামকরণ করা যেত, কিন্তু তাতে গল্পের ব্যঞ্জনা শিরোনাম থেকে যেমন আঁচ করা যেত না, তেমনি এর ব্যাপ্তিরও বেশ কিছুটা ঘাটতি হত এবং গল্প পাঠাতে নাম মাহাত্ম্য বিশেষ কাজে লাগত না। অপিচ, কোনো একটি নামের বা চরিত্রের নাম শিরোনামে ব্যবহার করলে কথাশিল্পীর গল্প কথনের মূল উদ্দেশ্য ও বক্তব্য চরিত্র নামের আড়ালে কিছুটা ঢাকা পড়ে যেতে পারতো।


‘পয়োমুখম্' গল্পটির নামকরণই একটি সংস্কৃত বাক্যের অংশ। বাক্যটি ‘বিষকুম্ভং পয়োমুখম্ অর্থাৎ কলস বিষে পূর্ণ কিন্তু তার মুখে ক্ষীর। যে সব মানুষ অন্তরে বিষপূর্ণ কিন্তু মুখের বাক্য মধুক্ষরা তাদের প্রতিই এই সংস্কৃত বাক্যটি প্রযুক্ত হয়।


আলোচ্য গল্পের প্রধান চরিত্র কৃষ্ণকান্ত, পেশায় কবিরাজ ও সংসারী মানুষ। দুই পুত্র ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে ভূতনাথকে কবিরাজী শিক্ষা দিয়ে, তার বিবাহ দিয়ে তার প্রতি স্নেহবর্ষণ করে কৃষ্ণকান্ত বাইরে থেকে আর পাঁচজন সংসারী মানুষের মত স্বাভাবিক আচরণ করে। সে এমন একটা ভান করে যেন পুত্রের একাধিকবার বিবাহ দিয়ে সংসারী করা তার দায়িত্ব ও কর্তব্য। সন্তানের প্রতি সেই দায়িত্বই যেন সে পালন করছে, -এই তার ভান।


কিন্তু কৃষ্ণকান্তের বাইরের ব্যবহারটা মুখোস মাত্র, অন্তরে সে অর্থলোলুপ নির্মম এক শয়তান, সামান্য টাকার লোভে শিশু বা কিশোরীর প্রাণহরণ করতে যে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না। চিকিৎসক হিসাবে মানুষের রোগ দূর করার প্রচেষ্টায়ই যেখানে তার ব্রত হওয়া উচিত, সেখানে সে অবলীলাক্রমে নির্দ্বিধায় বিষাক্ত ওষুধ প্রয়োগ করেই তার দুই পুত্রবধূকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। 'পয়োমুখম্' গল্পটিতে জগদীশ গুপ্ত নিরাসক্ত মনোভাব নিয়ে উন্মোচিত করেছেন স্নেহের ছদ্মবেশে কৃষ্ণকান্তের বিষপূর্ণ হৃদয়কে।


আলোচ্য গল্পটির সমাপ্তি ঘটেছে ভূতনাথের মস্তব্যে, “এ বোঁটার পরমায়ু আছে তাই কলেরায় মরল না, বাবা। পারেন তো নিজেই খেয়ে ফেলুন।" কথাগুলি বলে ওষুধের খলটি পিতার সামনে নামিয়ে রাখল। কৃষ্ণকান্তের সামনে ধরা খল এবং ভূতনাথের তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ কৃষ্ণকান্তের বাইরের ভদ্র নম্র মানবিক বহিরাবরণটুকু নিঃশেষে ছিন্ন করে তার গরলপূর্ণ অন্তরটি প্রকাশ করে দিয়েছে। সেইজন্যই স্বীকার করতে হয় ‘পয়োমুখম' নামটি বাস্তবিকই সার্থক একটি ব্যঞ্ছনাধর্মী নাম। এই নামটির মধ্যে দিয়ে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কুয়কান্তের স্বভাবটি যেমন ফুটেছে তেমনি ভূতনাথের জীবনের মূল ঘটনাকে সার্থকভাবে আভাসিত করেছে।