নাট্যশিল্প ও রঙ্গমঞ্চ

ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র থেকে জানা যায় ঋকবেদের ‘পাঠ' শ্রব্য, সামবেদের ‘গান' শ্রব্য, যজুর্বেদের ক্রিয়াকাণ্ড বা অভিনয় দৃশ্য, অথর্ববেদের 'রস' দৃশ্য-শ্রব্য সংবেদ্য ভাব – এই চারটি উপাদানকে সংযুক্ত করে 'নাট্য'-এর উৎপত্তি। ভরতের ‘নাট্যশাস্ত্র' গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে–

ত্রৈলোক্যস্যাম্য সর্বস্য নাট্যং ভাবানুকীর্তনম্। 

নানা ভাবোসম্পন্নং নানাবস্থান্তরাত্মকম্।।

লোকবৃত্তানুকরণং নাট্যমেতন্মায়া কৃতম্।

•••••••             •••••••              •••••••

যোহয়ং স্বভাবো লোকস্য দুঃখদুঃখসমন্বিতঃ

সোহঙ্গাদ্যভিনয়োপোতে নাট্যমিত্যভিষ্ঠীয়তে।।


নাটক হচ্ছে সুখদুঃখ সমন্বিত লোকস্বভাবের অভিনয়-উপযোগী রূপ এবং রসভোক্তা সামাজিক ব্যক্তিগণের উপযোগ্য ‘ক্রীড়নীয়ক'। নাটক সাধারণ লক্ষণে ‘লোকবৃত্তানুকরণ', বিশেষ লক্ষণে অভিনয়যোগ্য শিল্পসৃষ্টি। শ্রব্যত্ব ও দৃশ্যত্ব— এ দুয়ের সমবায়ে গঠিত শিল্পরূপ – দৃশ্যত্ব বা অভিনয়ত্বের মধ্যেই তার প্রধান বিশেষত্ব।


কবিতা, গল্প উপন্যাস প্রভৃতি বিভিন্ন প্রজাতির মতই নাটকও সাহিত্যশিল্পের অন্যতম প্রজাতি। কিন্তু তবুও অন্যান্য সাহিত্য প্রজাতির সঙ্গে নাটকের কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে, এবং এই পার্থক্য ‘প্রয়োগগত পার্থক্য'। যে কোন সাহিত্যশিল্পই অনুভববেদ্য, আস্বাদকের অন্তরে রসানুভূতিই তার শেষ কথা—নাটকও এথেকে ভিন্ন নয়। কিন্তু তবুও অন্যান্য সাহিত্য থেকে নাটকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে।


প্রাচীন সাহিত্য বিচারে কাব্যকে দুভাবে ভাগ করা হয়েছে শ্রব্যকাব্য এবং দৃশ্যকাব্য। নাটক ব্যতীত অন্যান্য সৃষ্টিকে বলা হয়েছে ‘শ্ৰব্য (পাঠ্য) কাব্য’ আর নাটককে ভিন্ন গোষ্ঠীতে নির্দেশ করে বলা হয়েছে ‘দৃশ্যকাব্য'। অন্যান্য কাব্য শুনতে হয় বা পাঠ করতে হয় কিন্তু নাটক কেবলমাত্র শুনলেই বা পাঠ করলেই হয় না দেখতেও হয়—শোনা এবং দেখা একই সঙ্গে চলে। নাটকের এই দৃশ্যত্বের পথ ধরেই নাট্যশিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয় রঙ্গমঞ্চ। নাট্যশিল্প হল ‘ফলিত শিল্প' (applied art) এবং ‘যৌথ-শিল্প(collective art)। অন্যান্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে যেমন রচয়িতা এবং শ্রোতা অথবা পাঠকের প্রয়োজন, নাটকের ক্ষেত্রে কিন্তু তেমন নয়। এখানে রচয়িতা, অভিনেতা-অভিনেত্রীবৃদ্ধ, নেপথ্য কলাকুশলীবৃন্দ এবং সর্বশেষে সমবেত সামাজিক দর্শক-শ্রোতৃবৃন্দ—এই সকলের সমবেত ভূমিকা গ্রহণের মাধ্যমেই নাট্যশিল্পের ফলশ্রুতি ঘটে। এদের কোন একটির ভূমিকার গুরুত্বও কম নয়। নাটকের যেমন একদিকে রচনা ব্যাপারটি থাকে, তেমনি তার প্রয়োগের ব্যাপারটিও। আর নাট্যশিল্পের এই প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন রঙ্গমঞ্চের। রচনা এবং প্রয়োগ, দুটি দিকের সার্ধকতার উপরই নির্ভর করে নাট্যশিল্পের পরিপূর্ণতা। অর্থাৎ নাটক বিচারের ক্ষেত্রে 'Literary value' এবং 'stage value' এই দুয়ের সম্পর্কেই সচেতন থাকা প্রয়োজন। অবশ্য এই ‘সাহিত্যমূল্য' এবং অভিনয়মূল্য' পরস্পর সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, বরং এই দুয়ের সার্বিক সমন্বয়ের মাধ্যমেই নাট্যশিল্প পরিপূর্ণতা লাভ করে। সেই কারণেই নাটক রচনার সময় নাট্যকারকে অভিনেতা অভিনেত্রীবৃন্দ, যাঁরা বিভিন্ন চরিত্রের রূপদান করবেন এবং রঙ্গমঞ্চ, যেখানে তাঁরা অভিনয় করবেন, এই সবকিছুই মনে রাখতে হবে এবং সেইভাবেই চরিত্রাঙ্কন, ঘটনা সন্নিবেশ, সংলাপ রচনা করবেন। সুতরাং নাট্যশিল্পের পরিপূর্ণ রসাস্বাদনের জন্য রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজন অবশ্যস্বীকার্য।


এরিষ্টটল নাটকের দৃশ্যধর্মিতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। তাঁর বক্তব্যের সার কথা নাটক হল 'imitation of an action.... in the form of action, not of narrative | বিশ শতকের নাট্যতত্ত্ববিদ এলারডাইস নিকল নাট্যধর্মিতার সারবস্তু সংকলন করে লিখেছেন, "Drama is the art of expressing ideas about life in such a manner as to render that expression capable of interpretation by actors and likely to interest an audience assembled to hear the words and witness the action."নাট্যশিল্পেরও মূল লক্ষ্য রসসৃষ্টি; নাট্যকার রসসৃষ্টির লক্ষ্যকে সম্মুখে স্থাপন করে নাট্যকাহিনীকে দৃশ্যগুণমণ্ডিত করে তোলেন এবং এইভাবেই নাট্য-আঙ্গিকের চমৎকারিত্ব প্রকাশিত হয়।