'বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' গ্রহসনের অগ্রধান নারী চরিত্রগুলি আলোচনা করো।

'বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' গ্রহসনে পুঁটি, পঞ্চী ও ভগী এই তিন জন হল অপ্রধান নারী চরিত্র। এই চরিত্রগুলি আলোচ্য গ্রহসনের স্বল্পপরিসরে নাট্যকারের লেখনীর দু-একটি আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।


পুঁটি :

পুঁটি কুটিনীর চরিত্রটি সরল হলেও জীবন্ত। ভক্তপ্রসাদের কামনা মেটাবার জন্য কুলবধূ ও কুমারী মেয়েদের ঘর ভেঙ্গে আনাই তার কাজ। কর্তার কাছ থেকে এর জন্য সে যে পারিতোষিক পায় তার চেয়েও কিছু বেশি সংগ্রহ করাই তার লক্ষ্য। সে লাঞ্ছিতা মেয়েটির টাকার অংশ কেটে রাখে। এর উপরে বিগত যৌবন হওয়ায় ভক্তপ্রসাদের মত লম্পটদের ভোগরাজ্যের অংশীদারী হওয়া থেকে সে বঞ্চিত বলে তার মনে যে দুঃখের ভাব তা এই উক্তিতে ধরা পড়েছে– “হায়, আমার কি এখন আর সে কাল আছে? তালশাস পেকে শক্ত হল্যে আর তাকে কে খেতে চায়?” তখন পুঁটির দীর্ঘশ্বাস আমাদের তার অন্তর্বেদনার সঙ্গেও পরিচিত করিয়ে দেয়। পরবর্তীকালে দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ' নাটকে পুঁটি পূর্ণতার রূপ পেয়েছে পদী ময়রানীর চরিত্রে।


পঞ্চী :

পীতাম্বর তেলী আর ভগীর মেয়ে পঞ্চী বা পাঁচি ভক্তপ্রসাদের ভাষায় ‘গোবরে পদ্মফুল'। কিন্তু তিনি পদ্মফুলের সৌন্দর্য অপেক্ষা পঞ্চীর সুউচ্চ বক্ষদেশ ও বিস্তৃত পশ্চাদভাগের গঠনভঙ্গিমায় মুগ্ধ। ভক্তপ্রসাদের কাছে দৈহিক সৌন্দর্য অপেক্ষা দেহজ আবেদন অনেক বেশি। ফলে ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর' কাব্যের বিদ্যার রূপবর্ণনাই তার কণ্ঠে একাধিকবার শোনা যায়। পঞ্চী ঈষৎ লজ্জা ও আঁখির কটাক্ষে ভক্তপ্রসাদকে বিমোহিত করে। তার চলন যেন 'মরালগামিনী'। কিন্তু শুধু দেখে ভক্তপ্রসাদের মন ভরে না; সে তাকে পেতে চায়। ভগী জেঠা বলে ভক্তপ্রসাদের পরিচয় দিলে সে তাকে প্রণাম করে। কিন্তু ভক্তপ্রসাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার দৃষ্টি এড়ায় না।


পীতাম্বর তেলী ধনী ব্যবসায়ী, তার লবণের ব্যবসা। পীতাম্বরের মেয়ে পঞ্চীর বিবাহ হয়েছে খানাকুল কৃষ্ণনগরের পালেদের বাড়িতে। জামাইটিও বেশ ভালো; সে লেখাপড়ায় এতই ভালো যে পুরস্কার পায় এবং কলকাতায় থেকে লেখাপড়া করে। পালেদের সমৃদ্ধ পরিবারে সে বেশ সুখেই থাকে। বাপের বাড়িতে সে খুব কম আসে। ঘটনাচক্রে পঞ্চীর সঙ্গে ভক্তপ্রসাদের আকস্মিকভাবে দেখা হলে ভক্তপ্রসাদ বিহ্বল হয়ে তাকে পেতে চায়। কিন্তু ভক্তপ্ৰসাদ শেষ পর্যন্ত তাকে পায় নি; বশ করতে পারে নি। টাকার প্রলোভন পঞ্চীর ব্যাপারে কাজে না লাগায় ভক্তপ্রসাদের লাম্পট্য পরাভূত হয়। আকাশের চাঁদ যেমন নাগালের বাইরে থাকে তেমনি পঞ্চীও ভক্তপ্রসাদের নাগালের বাইরে রয়ে গেল তার আর্থিক নিরাপত্তা ও রক্ষণশীল মানসিকতার জন্য। পঞ্চী চরিত্রটি লজ্জশীলা হলেও বলিষ্ঠ ও রুচিমতী। প্রহসনে পঞ্চী চরিত্রের কোনো পরিণতি দেখানো হয় নি। আসলে ভক্তপ্রসাদের লোলুপতা কোন্ স্তরে যেতে পারে তা দেখাবার জন্যই এই চরিত্রের অবতারণা।


ভগী :

পীতাম্বর তেলীর পত্নী এবং পঞ্চীর মা ভগী আলোচ্য গ্রহসনে বাংলাদেশের সাধারণ গ্রামীণ মেয়ে, সে গর্বিত; কেননা, তার জামাই সুদর্শন এবং লেখাপড়ায় ভালো বলে পুরস্কার পায়। কলকাতায় থেকে সে পড়াশোনা করে। তার গর্বের আরও একটি কারণ তার মেয়ে পঞ্চীর বিবাহ হয়েছে খানাকুল কৃষ্ণনগরের বর্ধিষ্ণু পালেদের বাড়িতে। তার স্বামীও লবণের ব্যবসায়ী রূপে বেশ ধনী ব্যক্তি। সম্পদশালী পরিবারে বিবাহ হওয়ার জন্য সে মেয়েকে আনতে পারে না বলে তার মনে দুঃখকষ্ট আছে। সামাজিক আচার-আচরণে তার কোনো কার্পণ্য নেই; মেয়েকেও যে ভালভাবে সামাজিক শিক্ষা দিয়েছে।