'মেঘমল্লার' গল্পের অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা আলোচনা করো।

শিল্পী যখন শিল্প সৃষ্টি করেন তখন সেই শিল্পের মধ্যে বোনা থাকে শিল্পের বক্তব্য এবং গভীর কোনো ব্যঞ্জনাবোধ। সেই ব্যঞ্ছনার পর্দা সরালেই শিল্পের মূল বিষয়টা আমাদের সামনে ধরা দেয়। সাদা ক্যানভাসে চিত্রকরের রং ও তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে চিত্র। এই চিত্রের মধ্যে পরতে পরতে মিশে থাকে ব্যানার স্তর। সমঝদার দর্শক ব্যঞ্ছনার আস্তরণকে সরিয়ে খুঁজে নেন চিত্রের মূল বিষয়কে।


সাহিত্যও শিল্পের একটি পর্যায়। সাহিত্যও লেখকের কোনো মূল বক্তব্য ব্যঞ্জনা কিংবা রূপকের আশ্রয়ে গড়ে ওঠে। পাঠক সেই রূপকের আস্তরণ ভেদ করে মূল নির্যাসটিকে বার করে আনেন।


সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতা-নাটক এবং ছোটগল্পে ব্যগুনার আবহ বেশি থাকে। উপন্যাসেও থাকে তবে সবক্ষেত্রে নয়। বঙ্কিমের রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস, কমলকুমার মজুমদার, নবারুণ ভট্টাচার্য প্রমুখ লেখকের উপন্যাসে ব্যঞ্ছনার স্তর বেশি।


রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি' গল্পের রাত্রির ঘটনায় ব্যানার আবহ তৈরি হয়। এছাড়াও তাঁর 'লিপিকা' গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত ‘তোতাকাহিনী', 'সওগাত', 'সুয়োরানীর সাধ' প্রভৃতি গল্পে রূপক ও ব্যঞ্ছনার আশ্রয় আমাদের চোখে পড়ে বেশি। তাঁর কবিতা ও বিখ্যাত রূপক সাঙ্কেতিক নাটকগুলিতেও এর প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি।


আমাদের আলোচ্য বিষয় বিভূতিভূষণের ছোটগল্প ‘মেঘমল্লার'। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ 'মেঘমল্লার' (১৯৩১)। মোট দশটি ছোটগল্প দিয়ে এই গল্পগ্রন্থটি গড়ে উঠেছে। এটি তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ। ১৯২১-৩০ সালের মধ্যে গল্পগুলি রচিত হয়েছিল। এই গ্রন্থের তৃতীয় গল্পটিই ‘মেঘমল্লার'। এটি বিভূতিভূষণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প-ই নয়, বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য গল্প এটি।


বিভূতিভূষণের ‘পুইমাচা' গল্পটিও এই গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত। এই গল্পে যেমন পুঁইলতার চারা বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে গল্পের প্রধান চরিত্র ক্ষেন্তির বেড়ে ওঠা ও প্রাণোচ্ছলতাকে ব্যঙ্গিত করেছেন লেখক। সেইরকম ভাবে ‘মেঘমল্লার' গল্পেও ব্যানা প্রধান হয়ে উঠেছে।


‘মেঘমল্লার'-এর কাহিনী কল্পিত। এই কাহিনীর পটভূমিকা প্রাচীন যুগের ভারত। প্রাচীন বৌদ্ধযুগ ও তান্ত্রিকযুগের সন্ধিক্ষণের ‘কাল'-ই এই গল্পে মুখ্য হয়ে উঠেছে। কাশীনগরের বিখ্যাত সঙ্গীতসাধক ইন্দ্রদ্যুম্ন-র পুত্র প্রদ্যুম্ন প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে বিদিশা নগরীর কাছে একটি বৌদ্ধ বিহারে পাঠগ্রহণ করতে আসে। কিন্তু সে ছিল তার পিতার মতোই সুরসাধক। সে অসম্ভব সুন্দর বাঁশি বাজাতে পারত। বাঁশিতে মেঘমল্লারের তান তুলে সে তার প্রিয়া সুনন্দাকে মুগ্ধ করে দিত। এভাবেই সে ভাল বীণ বাজিয়ের সন্ধান করতে করতে গুণাঢ্য ওরফে সুরদাস নামে এক তন্ত্রসাধকের খপ্পরে পড়ে যায়। তান্ত্রিক তাকে দিয়ে মেঘমল্লার-এর সুর বাজিয়ে দেবী সরস্বতীকে বশীভূত করে। প্রদ্যুম্ন পরে সব জানতে পেরে বিহার ত্যাগ করে দেবীর সন্ধানে নানা দেশ ঘুরে বেড়ায়। এরপর একস্থানে দেবীর মানবীরূপ ও হতদরিদ্ররূপ দেখে তার কষ্ট হয়। সে তাকে মুক্তি দেবার জন্য উপায় খুঁজতে থাকে, এরপরই গুণাঢ্যের সঙ্গে তার দেখা হয়। গুণাঢ্য তাকে আবার ভুলিয়ে এক সাঙ্ঘাতিক প্রস্তাব করেন। প্রদ্যুম্ন তরুণ প্রাণ, চিরকাল তরুণেরা আত্মোৎসর্গের জন্য উন্মুখ। দেবীকে মুক্তির জন্য গুণাঢ্যের দেওয়া মন্ত্রপূত জল দেবীর গায়ে ছিটিয়ে দেয় প্রদ্যুম্ন কিন্তু নিজে সে পাথর হয়ে যায়। এক গভীর দুঃখের মধ্য দিয়ে গল্পের পরিসমাপ্তি।


বিভূতিভূষণের এই কাহিনী কল্পিত হলেও গল্পের মধ্যে তিনি এক তরুণ প্রাণের আত্মত্যাগকে দেখিয়েছেন আর আছে এক গভীর ব্যানা যার জন্য আমাদের এই গল্পটির বিশ্লেষণ প্রয়োজন।


প্রদ্যুম্ন সঙ্গীতসাধক। সে নিজে বাঁশি বাজাতে পারে। নব বর্ষার আগমনধ্বনি তার বাঁশিতে। বর্ষাকালের মেঘমল্লার রাগে তার বাঁশি চঞ্চল। এই রাগের সুমিষ্ট ধ্বনি শুনিয়ে সে তার প্রিয়া সুনন্দার হৃদয়ে প্রেমের দোলা লাগায়। আবার তান্ত্রিক বিদ্যার প্রভাবের ফলে এই বাঁশির তানেই মর্ত্যে নেমে আসেন দেবী সরস্বতী। তান্ত্রিকতায় বন্দী হন তিনি। আবার প্রদ্যুম্ন-র আত্মবলিদানেই দেবীর মুক্তি।


বিদ্যা-সঙ্গীত-শিল্পকলা প্রভৃতির দেবী সরস্বতী। আমাদের হিন্দু পুরাণে এমনভাবেই তা বর্ণিত আছে। আমাদের দেব-দেবী ভাবনা কল্পিত এবং এক একটি বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তাঁদের কল্পনা করা হয়েছে যেমন বরুণ, ইন্দ্র, পবন, লক্ষ্মী প্রভৃতি। এখানে কেউ ধন অধিষ্ঠাত্রী দেবী, কেউ মেঘ বৃষ্টি, কেউ বা বায়ুর দেবতা। তেমনি বিদ্যা, সঙ্গীত, শিল্পচর্চার দেবী সরস্বতী। প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগে সরস্বতী নদীর তীরে বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র গঠিত হয়ে উঠেছিল বলে সরস্বতী দেবীর কল্পনা এমন একটা ভাবনাও চালু আছে।


আর একটা কথা এখানে অতীব প্রাসঙ্গিক। প্রাচীন ভারতে শিক্ষাচর্চা, সঙ্গীতচর্চা কিংবা শিল্পকলার চর্চা সবেতেই মুক্ততার পরিবেশ ছিল। তক্ষশীলাসহ যে সমস্ত অঞ্চলে বৈদিক শিক্ষাকেন্দ্র ছিল সেখানে তপোবনকেন্দ্রিক শিক্ষাই প্রধান হয়ে উঠেছিল। বিদ্যাশিক্ষার পাশাপাশি মুক্ত প্রকৃতির সান্নিধ্যও লাভ করত শিক্ষার্থীরা। পড়াশুনার পাশাপাশি, জীবন গঠনের কাজেও শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তুলতেন আচার্যরা। সঙ্গীত এবং শিল্পকলার চর্চাও হত মুক্ত পরিবেশে। সত্যিই মুক্ত আবহাওয়াতেই শিক্ষালাভ সম্ভব।


কিন্তু বৌদ্ধযুগের শেষপাদে নানারকম তন্ত্রমন্ত্রের চর্চা আরম্ভ হল ভারতে। যদিও অথর্ববেদ থেকেই এর সূচনা। বৌদ্ধধর্মের ধীরে ধীরে অবলুপ্তি, কিংবা হিন্দুধর্মের মধ্যেও নানান আচার সর্বস্বতার বাড়বাড়ন্ত এই তান্ত্রিকতার চর্চার পালে হাওয়া লাগায়। নানানরকম বশীকরণ, ডাকিনীবিদ্যা, তন্ত্রবলে নানারূপধারণ এগুলি চলতে থাকে। এইভাবেই গল্পে আমরা পাই গুণাঢ্য মন্ত্রবলে দেবীকে বন্দী করে আবার মন্ত্রপূত জলে দেবীর মুক্তি ঘটে কিন্তু প্রদ্যুম্ন জড়তাপ্রাপ্ত হয়।


আসল কথা হল যে কোনো শিক্ষার চর্চাই মুক্তভাবে করা উচিত। বদ্ধতার চোরাস্রোত শিক্ষাজীবন বা বিদ্যাকে হয়ত বাঁধতে পারে কিন্তু তাতে সঠিক শেখা হয় না তাই এত আমাদের অধঃপতন। গল্পকার কল্পিত কাহিনীর মধ্য দিয়ে এই বক্তব্যটিই আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেছেন। দেবী সরস্বতী শিক্ষা-সঙ্গীত শিল্পকলা-সংস্কৃতির দেবী বা প্রতীক। সেই প্রতীক যদি তান্ত্রিক বা ঘোর জড়বাদীদের হাতে বন্দিনী হন, তাহলে আমাদের সমাজে অবক্ষয় নেমে আসতে বাধ্য।


গল্পটির ব্যঞ্জনা এখানেই। এই ব্যানার যবনিকা সরিয়েই আমাদের গল্পের মূল বক্তব্যটিকে খুঁজে বার করতে হয় আর এখানেই বিভূতিভূষণের এই গল্প কল্পিত হয়েও হয়ে যায় চিরকালীন ও অসাধারণ।