'মহানগরের বিশাল অরণ্যে কত মানুষ আসে কত কিছুর খোঁজে—কেউ অর্থ, কেউ যশ, কেউ উত্তেজনা, কেউ বা বিস্মৃতি।'—উদ্ধৃত অংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

'এ-মহানগরের সংগীত রচনা করা উচিত—ভয়াবহ, বিস্ময়কর সংগীত।'- ব্যাখ্যা করো।


উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মহানগর' গল্প থেকে গৃহীত। 

আলোচ্য গল্পের সূচনায় লেখক তাঁর সঙ্গে সেই মহানগরে যাওয়ার জন্য পাঠককে আহ্বান জানাচ্ছেন, যে-মহানগর আকাশের তলায় পৃথিবীর ক্ষতের মতো ছড়িয়ে আছে, আবার যে-মহানগর উঠেছে মিনারে মন্দির চূড়ায়, আর অভ্রভেদী প্রাসাদ শিখরে তারাদের দিকে, মানবাত্মার প্রার্থনার মতো। অপরদিকে, যে-মহানগরের পথ জটিল, দুর্বল মানুষের জীবনধারার মতো, মানুষের মনের অরণ্যের মতো যে-পথ অন্ধকার, আর যে-পথ প্রশস্ত আলোকোজ্জ্বল মানুষের বুদ্ধি ও উৎসাহের মতো—সেই মহানগরের পথেও লেখক তাঁর নিজের সঙ্গে পাঠককে আসতে আহ্বান করেন। মহানগরের পটভূমিতে যন্ত্রের শব্দ, উঁচু কলের শঙ্খধ্বনি, রাস্তার যানবাহনের চাকার ঘর্ঘর, শিকলের ঝংকার শব্দের এই পটভূমির ওপর দিয়ে বিসর্পিল সুরের পথ চলেছে বলে লেখক মনে করেন। নদীর সুর, বয়ে চলা হাওয়া, প্রেমিকদের অর্ধস্ফুট কথা, উত্তেজিত জনতার সম্মিলিত পদধ্বনি, অনির্দিষ্ট আশ্রয়ের খোঁজে মাঝরাতে পথ-চলা ক্লান্ত পথিকের পায়ের শব্দ—মহানগরের সংগীতের মাঝে এই সবকিছুর ধ্বনি ও সুর মিশে থাকবে বলে লেখকের অভিমত। কেবল তাই নয়, কঠিন ধাতু ও ইটের ফ্রেমে লক্ষ জীবনের সুতো নিয়ে মহানগর যে বিশাল সূচিচিত্র বুনে চলেছে, সেই বিশাল দুর্বোধ চিত্রের অনুবাদও মহানগরের সেই ভয়াবহ ও বিস্ময়কর সংগীতের মধ্যে থাকা উচিত বলে লেখক মত প্রকাশ করেছেন। কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের অনবদ্য বাক্য নির্মাণ-কৌশলে গল্পের এই অংশের মধ্যে লিরিক কবিতার আমেজ খুঁজে পাওয়া যায়।



'মেঘলা আকাশ ছেড়ে তারাগুলিই তো নেমেছে নদীর ওপর।'—উদ্ধৃত অংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

উপরিউক্ত লাইনটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘মহানগর’ গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে। 

আষাঢ় মাসের ভোরবেলায় বৃষ্টি না পড়লেও আকাশ মেঘে ঢেকে রয়েছে। সূর্য হয়তো উঠেছে পূর্বদিকের বাঁকা নগরের ইমারতগুলির পেছনে, কিন্তু মেঘলা আকাশে মেঘ থেকে চোয়ানো স্তিমিত একটু আলো পৃথিবীর ওপর সবেমাত্র এসে পড়েছে। এসময় জোয়ারের টানে রতনদের নৌকো ভেসে চলেছে মহানগর কলকাতার দিকে। ক্লান্ত মাঝিরা ছইয়ের ভেতর যখন একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে, তখন হাল ধরে বসে আছে মুকুন্দ। সবার অজান্তে রতন রাত না পোহাতেই চুপটি করে গিয়ে বাবার পাশে বসেছে। তাদের নৌকো তখন মাঝনদীতে। বর্ষার রাতে আকাশে তারা ছিল না। নদী সেসময় মহানগরের নাগাল পেয়েছে। দুধারে জাহাজ আর স্টিমার, গাধাবোট এবং বড় বড় কারখানার সব জেটি। রতন অন্ধকারে তাদের স্পষ্ট করে দেখতে পায় না, নদীর কালো জলের এপার থেকে ওপারে তাদের গায়ে কেবল অসংখ্য আলোর ফোঁটা দেখতে পায়। রতনের কল্পনাপ্রবণ শিশুমনে সেই দৃশ্য দেখে এই ধারণা জন্মায় যে, মেঘলা আকাশ ছেড়ে সব তারা যেন নদীর জলের ওপরে নেমে এসেছে। স্বপ্নবিভোর বালক রতন দু চোখ দিয়ে পান করেছে আলো-ছেটানো মহানগরের এই অন্ধকার। জাহাজ, স্টিমার, গাধাবোট আর জেটিতে জ্বলে থাকা আলোর সঙ্গে আকাশের তারার এই সম্পর্কস্থাপন প্রেমেন্দ্র মিত্রের রোমান্টিক কবি-কল্পনার অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন। মেঘলা আকাশ ছেড়ে তারাদের নদীর জলের ওপর নেমে আসা বিষয়ক বাক্যটি এক অপূর্ব সুন্দর সমাসোপ্তি অলংকার হয়ে উঠেছে।



'বড়ো নদীতে মহানগরের রূপ দেখে রতন সত্যি ভয় পেয়েছিল, হতাশ হয়েছিল আরো বেশি। কিন্তু এই পুরনো জীর্ণ শহরতলি দেখে তার যেন একটু আশা হয়। রতনের ভয় পাওয়া ও হতাশ হওয়ার কারণ কী? সে কীভাবে আশার আলো দেখেছিল?

প্রশ্নোধৃত অংশটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মহানগর' গল্পের অন্তর্ভুক্ত। 

প্রথমদিকে রতনের বাবা মুকুন্দ রতনকে বাড়ি থেকে মহানগরে আনতে চায়নি। অল্পবয়সি রতনের পক্ষে নৌকোয় এতটা পথ আসা সহজ কথা নয়। তারপর রতন অনেক কাকুতি-মিনতি করে, কান্নার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত বাবাকে নিমরাজি করিয়েছে। সে শুধু একবার শহর দেখতে চায়—'রূপকথার গল্পের চেয়ে অদ্ভুত সেই শহর'। কিন্তু কেবল এই একটামাত্র কারণেই মহানগরে আসবার জন্য রতনের ব্যাকুলতা নয় বলে লেখক আমাদের জানিয়েছেন। আষাঢ় মাসের ভোরবেলায় নৌকো মহানগরে প্রবেশ করলে রতন নিঃসাড়ে বসে থাকে, তার সমস্ত দেহের রেখায় ফুটে ওঠে ব্যগ্রতার প্রখরতা। 

ধীরে ধীরে সকাল হলে জাহাজ, স্টিমার আর কলকারখানা অধ্যুষিত মহানগরের রূপ দেখে ভয়ে-বিস্ময়ে ব্যাকুলতায় রতন অভিভূত হয়ে যায়। তাদের নৌকো ক্রমশ বাঁক নিয়ে নদীর শাখাপথে ঢোকে, পুরনো শহরতলির ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে। গল্পের এই অংশে রতনের মহানগরে আসবার প্রকৃত উদ্দেশ্য-সম্পর্কে লেখক কিছু না জানিয়ে পাঠকের উৎকণ্ঠাকে বাড়িয়ে তুলেছেন। গল্পের সামগ্রিক পাঠে জানা যায়, রতনের মাতৃসম দিদি চপলাকে গ্রামের শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু লোক ধরে নিয়ে গিয়ে শহরে চালান করে। দেয়। ব্যথিত রতন একদিন জানতে পারে যে, তার দিদি মহানগর কলকাতার উল্টোডিঙি নামক স্থানে রয়েছে। এই প্রাণপ্রিয় দিদিকে খুঁজে বার করার উদ্দেশ্যেই রতন প্রাণপণ চেষ্টা করে বাবার সঙ্গে শহরে আসে। কিন্তু গ্রামের ছেলে রতন বড়ো নদীতে মহানগরের বিশাল রূপ দেখে ভয় পেয়ে যায়। এত বড়ো শহরে কোথায় তার দিদির খোঁজ করবে—এই ভেবে সে সাময়িকভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

এরপর তাদের নৌকো যখন নদীর শাখাপথে ঢোকে, তখন নদী তীরবর্তী পুরনো জীর্ণ শহরতলির অপেক্ষাকৃত ছোটো রূপ দেখে রতনের মনে আশার সঞ্চার হয়। সে তার দিদিকে এই শহর থেকে খুঁজে বার করবার আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়।



'তার চাপা দুটি পাতলা ছোটো ঠোঁটের নীচে কি সংকল্প আছে, জানে কি কেউ? বড়ো বড়ো দুটি চোখে তার কিসের ব্যগ্রতা? শুধু শহর দেখার কৌতূহল তো এ নয়। এখানে কার কথা বলা হয়েছে? উদ্ধৃত অংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

আলোচ্য অংশটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘মহানগর’ গল্প থেকে গৃহীত। এখানে রতনের কথা বলা হয়েছে।

অল্পবয়সি রতন তার বাবা মুকুন্দের কাছে অনেক কাকুতি-মিনতি করে, কান্নার মধ্য দিয়ে অবশেষে বাবার সঙ্গে নৌকোয় চেপে শহরে আসে। সে শুধু একবার শহর দেখতে চায়—'রূপকথার গল্পের চেয়ে অদ্ভুত সেই শহর'। কিন্তু কেবল এই একটামাত্র কারণেই মহানগরে আসবার জন্য রতন ব্যাকুল হয়নি বলে লেখক আমাদের জানিয়েছেন। আষাঢ় মাসের ভোরবেলায় নৌকো মহানগরে প্রবেশ করলে রতন নিঃসাড়ে বসে থাকে, তার সমস্ত দেহের রেখায় ব্যগ্রতার প্রখরতা ফুটে ওঠে। ধীরে ধীরে সকাল হলে জাহাজ, স্টিমার আর কলকারখানা-অধ্যুষিত মহানগরের রূপ দেখে ভয়ে-বিস্ময়ে ব্যাকুলতায় রতন অভিভূত হয়ে যায়। বড়ো নদীতে মহানগরের এই বিশাল চেহারা দেখে সে যুগপৎ হতাশ হয় ও ভয় পায়। তারপর তাদের নৌকো নদীর শাখাপথে ঢুকলে নদী তীরবর্তী পুরনো, জীর্ণ শহরতলির ছোটো রূপ দেখে রতনের মনে আবার আশা জেগে ওঠে। নদীর আর-একটা বাঁক ঘুরে নৌকো পোনাঘাটে পৌঁছলে রতনের বাবা মুকুন্দ হাঁক দিয়ে সবাইকে জাগিয়ে তোলে। এ সময় রতন উত্তেজনায় উদগ্রীব হয়ে বসে থাকে। তার চাপা দুটি পাতলা ছোটো ঠোঁট সংকল্পে দৃঢ় হয়ে থাকে, বড়ো বড়ো দুটি চোখে একধরনের ব্যগ্রতা প্রকাশ পায়। রতনের এই শরীর-মনের ভাষাকে নিছক শহর দেখার কৌতূহল বলে মনে করা যায় না বলে লেখক মন্তব্য করেছেন। আবার, গল্পের এই অংশে তিনি রতনের মহানগরে আসবার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু না জানিয়ে পাঠকের উৎকণ্ঠাকে বাড়িয়ে তুলেছেন। গল্পের সামগ্রিক পাঠে জানা যায়, রতন তার হারিয়ে যাওয়া দিদিকে খুঁজে বার করবার উদ্দেশ্যেই শহরে এসেছিল। এ কারণেই তাদের নৌকো পোনাঘাটে এসে পৌঁছলে রতন তার দিদি চপলাকে খুঁজে বের করতে নিজের মনে সংকল্পবদ্ধ ও ব্যগ্র হয়ে ওঠে।



'নদীর ধারের কাদায় মরা মাছ আর কদম-রেণু মিশে গেছে।'—ব্যাখ্যা করো।

উদ্ধৃত অংশটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মহানগর' গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে।

রতন তার হারিয়ে যাওয়া দিদিকে খুঁজতে বাবার সঙ্গে নৌকোয় চেপে শহরে এসেছিল। রতনদের নৌকো পোনাঘাটে এসে পৌঁছনোর পর বাবার কথামতো রতন একটি কদম গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ায়। গল্পের এই স্থানে এসে প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেন যে, সেই কদম গাছ থেকে অসংখ্য ফোটা ফুল মাটিতে ঝরে পড়েছে। কাদায় মানুষের পায়ের চাপে রেগুগুলো থেঁতলে নোংরা হয়ে গেছে। পোনা চারা বিক্রি করার হাটে কদম ফুলের কোনো মূল্য নেই। বিক্রেতারা হাঁড়ির জল চাপড়ায় আর মরা মাছ ছেঁকে ফেলে। নদীর ধারের কাদায় মরা মাছ আর কদম রেণু মিশে গেছে। আপাতভাবে দেখলে এই বাক্য ক'টিকে নিতান্ত সাধারণ বর্ণনা বলে মনে হয়। কিন্তু গল্পের সামগ্রিক পাঠে রতনের দিদি চপলার জীবনের মর্মান্তিক পরিণতির সঙ্গে এটিকে মিলিয়ে দেখলে এর ব্যঙ্খিত অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। মহানগরের বিকিকিনির হাটে হস্তান্তরিত হয়েছিল ফুলের মতন এক গ্রাম্যবধূ। কদম ফুলের মতোই গ্রাম-বাংলার স্নিগ্ধ-শ্যামল, পারিবারিক আবেষ্টন থেকে চপলা ঝরে পড়ে ঠাঁই নিয়েছে মহানগরের রুক্ষ উষর মাটিতে। হৃদয়হীন মানুষের পাশবিক পীড়নে প্রেম-প্রীতিপূর্ণ চপলার জীবন পদপিষ্ট কদমের রেণুর মতন থেঁতলে নোংরা হয়ে গেছে। মহানগরের পণ্যদ্রব্যের বাজারে চপলার নারীমনের আবেগ-অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। পতিতাপল্লীর অন্ধকারে, ক্লেদাক্ত পরিবেশে তাকে বিলাস-সামগ্রীতে সাজানো মেটে ঘরে জীবন্ত পণ্যদ্রব্য হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। শহরের পঙ্কিল আবহাওয়ায় চপলার আগেকার সুস্থ-সুন্দর-স্বাভাবিক জীবনের অপমৃত্যু ঘটে গেছে। নদীর ধারের মহানগরের কাদায় চপলার অতীত জীবনকে যেন মরা মাছের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে আর তার হৃদয়ের সূক্ষ্ম, মানবিক অনুভূতিগুলোও কদম-রেণুর মতো স্ব-স্থানচ্যুত হয়ে সেই কাদায় যেন মিশে গেছে।



'মহানগরের বিশাল অরণ্যে কত মানুষ আসে কত কিছুর খোঁজে—কেউ অর্থ, কেউ যশ, কেউ উত্তেজনা, কেউ বা বিস্মৃতি।'—উদ্ধৃত অংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

উপরিউক্ত অংশটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মহানগর' গল্পের অন্তর্ভুক্ত। রতন তার মাতৃসমা দিদি চপলাকে খুঁজে বের করার কথা বলা হয়েছে।

মহানগর কলকাতার বহুমাত্রিক পরিচয় দেওয়ার পরে লেখক শৈশবে মাতৃহীন গ্রাম্যবালক রতনকে মহানগরের পটভূমিতে স্থাপন করেছেন। অনেক কাকুতি-মিনতি করার পর বাবাকে রাজি করিয়ে সে বাবার সঙ্গে নৌকোয় চেপে শহরে আসে। পোনাঘাটে নৌকো এসে পৌঁছলে রতন বাবার কথামতো একটি কদমগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেখানে সে বেশিক্ষণ থাকে না। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকবার জন্য সে কাকুতি-মিনতি করে মহানগরে আসেনি। সমস্ত পথ সে মনের কথা মনেই গোপন করে এসেছে। শুধু একবার সে নৌকোর লক্ষ্মণকাকাকে উল্টোডিঙি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছে। কদমতলায় দাঁড়িয়ে রতন তার বাবাকে কাজে ব্যস্ত দেখে একসময় রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে একটা দিক খেয়ালমতো ধরে সে এগিয়ে যায়। -গল্পের এই অংশে এসে লেখক বলেছেন যে, মহানগরের বিশাল অরণ্যে কত মানুষ কত কিছুর খোঁজে আসে। অর্থ, যশ, উত্তেজনা, বিস্মৃতি—একেকজনের সন্ধান একেকরকম। কিন্তু মৃত্তিকার স্নেহের মতো শ্যামল অসহায় ছেলে রতনের শহরে আসবার প্রকৃত উদ্দেশ্য কী—সে বিষয়ে লেখক কিছু না বলে পাঠককে কৌতূহলী করে তোলেন। ইট-কাঠ-পাথর দিয়ে নির্মিত বহু অট্টালিকা, কলকারখানা-সমাকীর্ণ এবং অসংখ্য জনতা-পরিবৃত মহানগরকে লেখক 'অরণ্য' বলে অভিহিত করেছেন। অরণ্যে যেমন বহুসংখ্যক বৃক্ষ-লতা-উদ্ভিদের এবং বিভিন্ন জীবের একত্র সমাবেশ ঘটে, লেখকের মতে, মহানগরও তেমনি বহু ইমারত-পরিকীর্ণ ও বিচিত্র মানসিকতার মানুষ দ্বারা পরিবেষ্টিত একপ্রকার অরণ্য বিশেষ। আরণ্যক মাংসাশী শ্বাপদের নৃশংস আচরণ মহানগরের মানুষের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে নানান মানুষ শুভ-অশুভ নানান স্বার্থ নিয়ে সদাসর্বদা চলাফেরা করছে। লেখক এরপর রতন যে তার হারিয়ে যাওয়া দিদিকে খুঁজতে মহানগরে এসেছে, সে-কথা জানিয়ে মন্তব্য করেন যে, যেখানে মানুষ নিজের আত্মাকে হারিয়ে খুঁজে পায় না, সেই মহানগর থেকে রতন তার দিদিকে খুঁজে বার করবে। লেখকের বলার ধরনে আপাতভাবে বালক রতনের প্রতি তাঁর একরকম বিরূপ প্রকাশ পায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে লেখকের এই বিদ্রূপ মহানগরের প্রতি। শহুরে লোভ আর অর্থের হাতছানির সাঁড়াশি আক্রমণে মানুষ তার মনুষ্যত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে, নিজের অন্তরাত্মার আবেগ-অনুভূতিকে অজান্তে হারিয়ে ফেলে সঙ্কীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য নাগরিক যন্ত্রমানবে পরিণত হয়। তারপর কোনো একসময় সম্বিত ফিরলে জীবনের সেই গভীরতম সম্পদকে ফিরে পাওয়ার তীব্র আকুতি নিয়ে সে দূষণ-জর্জরিত মহানগরের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে থাকে, কিন্তু শত প্রচেষ্টাও বিফলে যায়। মানুষের একান্ত প্রিয়জনও এই শহুরে কলুষতার অসহায় শিকার হয়ে ইট-কাঠ-পাথরের অরণ্যে হারিয়ে যায়।



'অনুচ্চারিত কোনো নিষেধ তার শিশুমনের ব্যাকুলতাকে মৃক করে রেখে দেয়।'—এখানে কার কথা বলা হয়েছে? অংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

উপরিউক্ত অংশটি প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মহানগর' গল্প থেকে গৃহীত।

অংশটিতে বালক রতনের কথা বলা হয়েছে। মাতৃহারা বালক রতনের কাছে দিদিই ছিল তার মায়ের মতো। একসময় দিদির বিয়ে হয় পাশের গাঁয়ে। রতন মাঝেমধ্যেই দিদির কাছে গিয়ে থাকত। প্রাণপ্রিয় দিদিকে ছেড়ে সে বাড়ি ফিরতে চাইত না। তার বাবা গিয়ে তাকে জোর করে নিয়ে আসত। একদিন খবর এল, দিদির বাড়িতে গোলমাল। কেন গোলমাল, তা রতন জানতে পারে না। একদিন রতনদের বাড়িতে দিদির শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক এসেছিল, থানা থেকে চৌকিদারও এসেছিল। রতন শুনতে পেল, তার দিদিকে কারা নাকি ধরে নিয়ে গেছে। ছেলেমানুষ বলে তাকে এসব ব্যাপারে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। এ সংবাদে রতন খুব কেঁদেছিল। মাতৃসম দিদির প্রতি তার প্রগাঢ় ভালোবাসা চোখের জল হয়ে ঝরে পড়েছিল। তার সংবেদী শিশুমন কল্পনা করে, যারা দিদিকে ধরে নিয়ে গেছে, তারা হয়তো তাকে খুব মারছে, হয়তো দিদিকে খেতে দিচ্ছে না। দিদিও হয়তো প্রিয় ভাই রতনকে দেখবার জন্য কাঁদছে। বাবাকে দিদির সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেও সে কোনো প্রত্যুত্তর পায়নি। রতন বুঝতে পারে, কিছু একটা ঘটেছে, যা বাবা তার কাছে লুকোতে চায়। দারোগা-পুলিশের আবির্ভাব এবং দিদির সম্পর্কে বাবার নীরবতায় রতনের মনে সংশয়ের বোধটি দৃঢ় হতে থাকে। শোকাতুর রতন একদিন শোনে যে, তার দিদিকে পাওয়া গেছে। কিন্তু দিনের পর দিন কেটে গেলেও দিদি কেন বাড়ি আসে না, রতন বুঝতে পারে না। অবশেষে একদিন রতন কোথা থেকে জানতে পারে, তার দিদি থাকে শহরে, জায়গাটার নাম উল্টোডিঙি। অতঃপর সে দিদিকে খুঁজে বার করবার সঙ্কল্প করে। এবং অনেক কাকুতি-মিনতি করার পর বাবার সঙ্গে নৌকোয় চেপে মহানগরে আসে। কিন্তু দিদিকে খোঁজার ব্যাপারে রতন কাউকে কিছু বলে না। বাড়িতে তার বাবার কাছে দিদিকে আনবার কথা বলে সে ধমক খেয়েছে। বালক হলেও রতন বোঝে যে, দিদির নাম করা বাড়িতে নিষেধ। তাই সে তার দিদির জন্য আন্তরিক ব্যাকুলতাকে নিজের মনেই চেপে রেখে দেয়। রতনকে কেউ কখনও তার দিদির নাম করতে বাড়িতে প্রত্যক্ষভাবে নিষেধ করেনি। তবু তার ধারণা হয় যে, বাড়িতে তার দিদি এখন অবাঞ্ছনীয়। তাই একান্ত ভালোবাসার দিদির জন্য অনুচ্চারিত কোনো নিষেধ রতনের শিশুমনের ব্যাকুলতাকে বোবা করে রেখে দেয়।