'অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসের ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচনা করো।

'অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসটি একটি ঐতিহাসিক পটভূমিতে রচিত। এই উপন্যাসের নায়কও ঐতিহাসিক ব্যক্তি। ঔপন্যাসিক বস্তুবাদী ঐতিহাসিকের দায়-দায়িত্ব নিয়ে মুণ্ডা-অভ্যুত্থান ও তার নায়ক-কেন্দ্রিক আখ্যানটি বর্ণনা করেছেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বীরসা মুণ্ডার গুরুত্ব অবিস্মরণীয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় ভূমিকায় লেখিকা জানিয়েছেন - “ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বীরসা মুণ্ডার নাম ও বিদ্রোহ সকল অর্থেই স্মরণীয় ও তাৎপর্যময়। এ দেশের যে সামাজিক ও অর্থনীতিক পটভূমিকায় তার জন্ম ও অভ্যুত্থান, তা কেবলমাত্র বিদেশী সরকার ও তার শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নয়, একই সঙ্গে এ বিদ্রোহ সমকালীন ফিউডাল ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও। এ সমুদয় ইতিহাসের বিবেচনা বীরসা মুণ্ডা ও তার অভ্যুত্থানের যথার্থ বিবেচনা অসম্ভব।”


এখানে ইতিহাসের বিবেচনা'র গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। বীরসার জীবনকে অবলম্বন করে মুণ্ডাদের উলগুলানের যে বর্ণনা লেখক এখানে দিয়েছেন, তা ঐতিহাসিক দিক থেকেই স্মরণীয়।


লেখিকা ইতিহাস চেতনায় বিশ্বাসী, তাই শিল্পের জন্য শিল্প এই নীতিতে বিশ্বাসী না হয়ে লেখিকা সরাসরি ঐতিহাসিক পটভূমিতে জীবন আখ্যানকে স্বাধিষ্ঠিত করেছেন। সামাজিক মানুষ হিসেবে লেখিকা অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই তাঁর লেখার বক্তব্যকে প্রণিধান করতে হলে ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচ্য।


বীরসার সংগ্রামকে বলা হয়েছে 'উলগুলান'। এর কালপর্ব ছিল ১৮৯৫-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ছোটনাগপুরের অন্তর্গত সিংভূম, রাঁচি, পালামৌ ইত্যাদি জেলার অধিবাসী ওরাও, হো, মুণ্ডা, কোল প্রভৃতি আদিবাসীদের জীবনের নানা অত্যাচার, শোষণ ও বহিরাগত অরণ্যলোভী ও মৃত্তিকালোভী মানুষের দখলদারির ফলে আদিবাসীদের সমাজ জীবন ও গ্রাম-ব্যবস্থা কেমনভাবে ভেঙে পড়েছিল, তার বর্ণনা এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু। ‘দিকু’দের সঙ্গে একটা কঠিন সংঘাতের ফলে 'উলগুলানের' জন্ম হয়। বিদ্রোহ থেকে জন্ম নেয় বিপ্লবের। বিদ্রোহ সমকালীন ফিউডাল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তাই এর ঐতিহাসিক পটভূমি অন্বেষণ করে নানা তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে জনবৃত্তের ইতিহাসকে অন্বেষণ করা। ১৯৮৩ সালে ডিসেম্বরে 'আমার প্রথম বই' রচনায় মহাশ্বেতা নিজেই জানিয়েছেন—“কোনো ব্যাপারের যথার্থ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত পেতে হলে, কাগজ ও নথিপত্রগত গবেষণা যথেষ্ট নয়। লোকগাথা-গীতি-কবিতায় অর্থাৎ লোকবৃত্তে সে ব্যাপারটার যতটা পরিচয় মেলে, তাকেও মর্যাদা দিতে হবে।” ‘আঁধার মাণিক’ উপন্যাসের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন– “ইতিহাসের মুখ্য কাজই হচ্ছে একই সঙ্গে বাইরের গোলমাল, সংগ্রাম ও সমারোহের আবর্জনা এবং ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে জনবৃত্তকে অন্বেষণ করা, অর্থ ও তাৎপর্য দেওয়া। আর তখনই এই ভিতরপানে চোখ মেলার দরুনই অনিবার্যভাবে রেরিয়ে আসে সমাজনীতি ও অর্থনীতি, বেরিয়ে আসতে বাধ্য। কেননা সমাজনীতি ও অর্থনীতি শেষ পর্যন্ত রাজনীতির পটভূমি তৈরি করে। তার সিদ্ধি ও সাফল্য এনে দেয়। এই সমাজনীতি ও অর্থনীতির মানে হল লোকাচার, লোকসংস্কৃতি, লৌকিক জীবনব্যবস্থা।”


লোকায়ত অর্থনীতির সূত্র ধরে লোকজীবনবৃত্তের কাহিনীর মধ্যে দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় রাজনীতির পটভূমি। সেখান থেকে আসে স্বাধীনতার কথা। অরণ্য বীরসার জননী, জঙ্গল ত’ মুণ্ডার মা। বীরসা অনুভব করেছিল "ওর অরণ্যজননী কাদছে"। "দিকু দের হাতে অরণ্য বন্দিনী। তাই জননী অরণ্য বলেছিল, মোরে বাঁচা বীরসা। আমি শুদ্ধ শুচি নিষ্কলঙ্ক হব।” –এই মুক্তিসংগ্রামের কাহিনী নির্ভর করেছে ঐতিহাসিক পটভূমির ওপর।


ভারতে অরণ্যের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষের জীবন। আদিবাসী উপজাতিদের সংস্কৃতি, ধর্মাচার ও বিশ্বাস দিয়ে অরণাকে গ্রহণ করা হয়েছিল। ঊনিশ শতকের মধ্যপর্বে এসে এই অধিকার প্রতিহত হল। ছোটনাগপুরে এই শতকে উপজাতি বিদ্রোহ হয়েছিল। ১৮৫০ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহ, এ-সব কথা চিন্তা করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকার অরণ্যের ওপর আনুষ্ঠানিক কর্তৃক কায়েম করতে চেয়েছিল। তার ফলে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারি অরণ্য আইন প্রবর্তিত হল। ১৮৭৮ সালে হল ভারতীয় অরণ্য আইন। উপজাতিদের অরণ্যপ্রীতি চলে গেল ব্রিটিশ সরকারের কর্তৃত্বে। এরই ফলশ্রুতি আদিবাসীদের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের স্থায়ী সংঘাত। ‘অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসে মুণ্ডাবিদ্রোহ এই পটভূমি দ্বারা সম্যক প্রণিধান করা যাবে। মহাশ্বেতা দেবী এক —জায়গায় লিখেছেন, “বীরসার আগেও সে অঞ্চলে বার বার হয়েছে আন্দোলন।” এই বারবার আন্দোলন'-ই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।


১৮৫৮ সাল থেকে খ্রিস্টান আদিবাসীরা সর্দার আন্দোলনের সূত্রপাত করে। এই পটভূমিতে গড়ে ওঠে বীরসার উলগুলান। ১৭৮৯ সাল থেকে বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৮২০ পর্যন্ত অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদ্রোহ করে মুণ্ডারা। ভূমিজ বিদ্রোহ, কোলবিদ্রোহ শুরু হয়। ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত বীরসাকে কেন্দ্র করে কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠে নি, কিন্তু তিলে তিলে তার প্রস্তুতি হয়েছিল। বীরসা জনতার কাছে জানতে চেয়েছিল তারা যুদ্ধ না শান্তি কোনটা চায়? জনগণের জবাবের উত্তরে বীরসা যুদ্ধের আয়োজন করেছিল। বীরসা মুণ্ডাদের জীবনকে প্রাচীন প্রথা থেকে, কুসংস্কার থেকে মুক্তি দিতে চায়। এই ব্রত দুঃসাধ্য ব্রত, এক নতুন ধরনের উলগুলান। অন্যায়ের প্রতিরোধে বীরসাইতরা লড়াইতে নেমে পড়ে, ফিরে পেতে চায় মানুষের অধিকার। এই আন্দোলন পরম্পরার ঐতিহাসিক পটভূমি তাই ফিউডাল বা সামন্ততান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কেবল অরণ্যের অধিকার নয়, জমির জন্য সংগ্রামই এই বিদ্রোহের মূল “However, it was not forest, but land that was the main issue in the Sardar Movement as Birsa's uprising"


বীরসা স্বাধীনতাসংগ্রামী, দেশপ্রেমিক। বীরসা একজন ঐতিহাসিক চরিত্র। আখ্যানকে ঐতিহাসিক প্রামাণিকতা দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। ইতিহাসের তথ্য দিয়ে বীরসাকে নির্মাণ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক সন তারিখ দিয়ে বিশ্বস্ততা সৃষ্টি করা হয়েছে— ১৮৮৬ সালে চারটি ছেলে চাইবাসা গিয়েছিল সুগানা মুণ্ডার সঙ্গে।”—এর একজনের নাম বিরসা, জন্ম ১৮৭৪ এবং প্রয়াণ ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ৯ই জুন।


বীরসা হল ‘ধরতি-আবা’, মুণ্ডা বিদ্রোহের নায়ক। জেলে বসে ধানী মুণ্ডা বলেছিল, অনেক অনেক চাঁদ আগে বীরসার তিনপুরুষ আগের মানুষ জমিতে শাবল দিয়ে খুট গাড়ত, পত্তন করত খুটকাট্টি গ্রামের, গ্রামের পর গ্রাম এইভাবেই তৈরি হত। এরা জঙ্গলে শিকার করত। গাই চরাত, জঙ্গল কেটে জমি আবাদ করত, সিংরোঙার পূজা দিত। ছোটনাগপুরের পত্তন হল, রাজা হল অন্যজন। 'দিকু'রা বহিরাগত, এরা এসে জমি দখল করল। মুণ্ডারা জমিহারা, সর্বহারা হল, বেঠবেগারীতে বাধ্য হল। এই হল মুণ্ডাদের ইতিহাসের পটভূমি ধানী মুণ্ডা এই পটভূমির কথা বলেছে।


ঐতিহাসিক পটভূমিকে স্মরণ করে মুণ্ডাদের লড়াই তার সাফল্য ও ব্যর্থতাকে জানা যায় লোকগীতিতে ‘বোলোপে বোলোপে হেগা মিসি হোন্ কো।' ‘হোইও ডুডুগার হিজু তানা।' ‘বোলোপে।' এই লোকগীতিতে বিদ্রোহের পরিচয় ধরা আছে।


বীরসার জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুণ্ডাজাতির স্বপ্ন, সব দলিত বর্গের স্বপ্ন বিজয়ের কাহিনী হয়ে রূপ নিয়েছে। এইখানেই তার উপন্যাসের ঐতিহাসিক পটভূমি।