'একেই কি বলে সভ্যতা?' প্রহসনে অঙ্কিত ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা'র অন্যান্য সদস্যদের চরিত্র আলোচনা করো।

মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনের দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্কে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’র অন্যান্য সদস্যদের নাম ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যায়। মধুসূদন মাত্র কয়েকটি সংলাপ ও নাট্য অভিব্যক্তির সাহায্যে তাদের আংশিক রূপ তুলে ধরেছেন। অবশ্য তা খণ্ড হলেও সামাজিক প্রতিনিধিরূপে তারা অনেকখানি পূর্ণ। আলোচ্য প্রহসনের ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার সদস্যরা সকলেই প্রায় নবকুমার ও কালীনাথের মত। তারা ভোগাকাঙ্ক্ষী, লম্পট, মদ্যপ, বারবিলাসিনীদের সঙ্গ লোভাতুরা, ইংরাজি-বাংলা মিশ্রিত বুলিতে কথা বলে। তাদের আচরণও বেশ হাস্যকর; মদে-মাংসে তারা ডুবে থাকতে ভালোবাসে আর বঙ্গনটীদের সঙ্গসুখ চায়। পাশ্চাত্যপ্রথায় সভা পরিচালনায় এরা বেশ দক্ষ। উৎসাহসূচক সমর্থনের জন্য বলে, ‘ব্রাভো,’ ‘থ্রি চিয়ার্স', 'হিপ হিপ হুর রে' ইত্যাদি। চেয়ারম্যানের স্বাস্থ্যপান করে নৃত্য-গীত উপভোগের পর এরা টেবিলে খেতে বসে। সাহেবিয়ানার রীতিগুলি এরা বেশ আয়ত্ত করেছে।


প্রহসনে কালীনাথের চরিত্র বিস্তৃত হলেও, ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী' সভার অন্যান্য সদস্যদের চরিত্র যথেষ্ট স্বল্পায়তন। নাট্যকার কয়েকটি আঁচড়ের সাহায্যে তৎকালীন যুগ পরিবেশের পটভূমিকায় চৈতন, বলাই, শিবু, মহেশ প্রমুখ সভ্যের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। তারা সকলেই পাশ্চাত্য বিদ্যা-শিক্ষা, রীতি-নীতির সুফল আয়ত্ত না করে কুফল আয়ত্ত করেছে। যেমন— ইন্দ্রিয়বৃত্তির ও ভোগলালসার চরিতার্থতা, মদ্যাসক্তি, অপরকে অবজ্ঞা করা, আপন সভ্যতা-ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা ইত্যাদি।


আপনাপন ইন্দ্রিয়বৃত্তির চরিতার্থতার জন্যই এরা যেন ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা'র সভ্য হয়েছে। দোলাচল চিত্তবৃত্তির অধিকারী হলেও নবকুমারের নেতৃত্বে চৈতন আস্থাশীল। শিবু, কালী ও নবকুমারের বিদ্যাশিক্ষার উপর সে শ্রদ্ধাশীল। অথচ নবর আসতে দেরি হওয়াতে নবকে বাদ দিয়ে চৈতনকে সভাপতি করে সভার কাজ শুরু হয়েছে। নবকুমার তাদের দেরী হওয়ার কারণ জানিয়েছে; অথচ কিছুক্ষণ আগে নবকুমারের সমর্থক শিবু প্রমত্তভাবে নবকে বলে, ‘দ্যাটস্ এ লাই’। বলাই ও মহেশ চরিত্রটিও নবকুমারের প্রতি ঈর্ষাকাতর। ইংরেজের অনুকরণে সভা পরিচালনা করলেও বারবিলাসিনীদের নাচ-গান, আমোদ-প্রমোদই সেখানে মুখ্য। নবকুমারের বক্তৃতায় সভার উদ্দেশ্য ব্যক্ত হয়। ‘একেই কি বলে সভ্যতা? প্রহসনে সমাজচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। 'জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার সদস্যরা ইয়ংবেঙ্গলের চিত্রকেই এখানে ফুটিয়ে তুলেছে। প্রত্যেকটি চরিত্র যুগ ও সমাজের চিত্রকে স্পষ্ট করলেও আপনাপন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সৃষ্টিতেও তারা যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছে।