“মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথা' মানস সেতু ভঙ্গের উপন্যাস। (Break of Communication) " ব্যাখ্যা করো।

কেবলমাত্র উপকরণ থাকলেও উৎকৃষ্ট মানের প্রতিমা নির্মিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন উপকরণাদির সমন্বয় সাধন। ইট, সিমেন্ট, রড দিয়েই গড়ে ওঠে না বিশাল বিশাল প্রাসাদপ্রতিম অট্টালিকা। প্রয়োজন এগুলির সার্থক ব্যবহার। খড়, মাটি ও অন্যান্য উপকরণ দিয়েই গড়ে ওঠে প্রতিমা, কিন্তু নির্মাণকার্যে দক্ষ শিল্পীর প্রথমটাই আসল জিনিস। ঔপন্যাসিকের কৃতিত্ব নির্মাণের অপরিসীম কৃতিত্ব, তিনি কাহিনি, চরিত্র, নামকরণ ভাষারীতি সর্বোপরি চরিত্র এর মানসিক গতিবিধি প্রভৃতির দ্বারা উপন্যাস রূপ প্রতিমার সুবিন্যস্ত রূপ পরিবেশন করে থাকেন। অনুরূপ, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'য় দারিদ্র্য লাঞ্ছিত সাধারণ মানুষের বাস্তব জটিল জীবন এই উপন্যাসে অপূর্ব শিল্পরূপ লাভ করেছে। কথাকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একদা বলেছিলেন : “নিত্য আবিষ্কারে বিজ্ঞান বদলে দিয়ে চলে সমাজ ও জীবনকে, বদলে দিয়ে চলে মানুষের চেতনাকে। এই চেতনায় জাগে সাহিত্যের কাছে নতুন চাহিদা এবং এই চেতনা প্রতিফলিত হয় নতুন আঙ্গিকে উপন্যাস রচনায়।” মানিকের এ উপন্যাসে আছে এই নতুন চেতনা এবং নতুন আঙ্গিক। মানুষ তার নিজের ইচ্ছা শক্তির নিয়ামক। লেখক দেখালেন মানুষ আসলে একটা গভীরতর জৈবিক ষড়যন্ত্রের ক্রীড়নক মাত্র। মানুষ তা জেনে শুনেও তাকে চাপা দিতে চায়। তার জন্য কী হাস্যকর চেষ্টা, অথচ সকলে তাকে মেনে নেয়, স্বীকার করে আনন্দ পায়। এ উপন্যাসেই মানিকের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি শিল্পশৈলী এবং আগামী দিনের সম্ভাবনার ইঙ্গিতের পরিচয় পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে এর ভাষা, উপস্থাপনাভঙ্গি ও ঘটনা নিয়ন্ত্রণ রীতি বাংলা সাহিত্যে একজন শক্তিশালী লেখকের স্বাক্ষর বহন করে।


অতিকায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে শেষ পর্যন্ত এমনকি প্রথমাবধি কোনো হাসি নেই। এ উপন্যাসের প্রত্যেক চরিত্রই নিজ নিজ আত্ম দুর্গে বন্দি। শশী, গোপাল, পরাণ, কুসুম, যামিনী কবিরাজ, সেনদিদি, যাদব, পাগলাদিদি, নন্দলাল, বিন্দু, কুমুদ, বনবিহারী, জয়া—জীবনে কেউ সুখী নয়, জীবনে বেঁচে থেকে কেউ সন্তুষ্টিও নয়। পিতা ও পুত্র, স্বামী ও স্ত্রী, প্রেমিক ও প্রেমিকা, বন্ধু ও বন্ধু—প্রত্যেকের মধ্যে আকর্ষণ-বিকর্ষণের জোয়ারভাটা চলেছে। কিন্তু প্রত্যেকের থেকে সুদূর যে যার আত্মদ্বীপে নির্বাসিত, যেন এ বিপুল জলোচ্ছ্বাসে ভেসে চলেছে ওরা, অবলম্বন খসে গেছে, তখন অসহায় প্লাবিত, কারো সঙ্গে কারো যোগাযোগ ঘটছে না। এই Break of Communication বা মানস সেতু ভঙ্গ এ উপন্যাসের একটা প্রধান কুলক্ষণ। উভয় চরিত্রের মধ্যে মানস সেতুভঙ্গ জনিত যে সকল জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তা এমনভাবে পর্যালোচনা করা যেতে পারে—


পিতা ও পুত্র : গলায় ছুরি দেওয়া গোপাল, যার গভীর ও অপরূপ এক হীনতা থাকার জন্য কঠোর কর্মঠ প্রকৃতি শুধু নিষ্ঠুরতায় গড়া সেই গোপাল তিনটি কন্যার প্রতিও যার খুব মমতা নেই, একমাত্র পুত্র সন্তান শশীর প্রতি সে ভালোবাসায় অন্ধ। আর তো ছেলে নেই গোপালের, শুধু শশী, শশীর সঙ্গে সে কিছুতেই যেন স্বাভাবিক হতে পারে না, চলে মান অভিমানের পালা, প্রায়ই কথা বন্ধ থাকে। গোপাল ভাবে : “ছেলে বড়ো হইলে কী কঠিন হইয়া দাঁড়ায় তার সঙ্গে মেশা, সে বন্ধু নয়, ঘাতক নয়, উপরওয়ালা নয়, কী সে সম্পর্ক দাঁড়ায় বয়স্ক ছেলের সঙ্গে মানুষের ভগবান জানেন।” পিতা পুত্রের কিছুতেই যেন স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। শশী বাপকে অবজ্ঞা বা অশ্রদ্ধা করে না। শুধু গোপালের খেয়ালে জীবনে যারা দুঃখ পেয়েছে তাদের জন্য শশীর মনে একটা অতিরিক্ত মমতা আছে, এ থেকেই আসে বাপের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। গোপাল ছেলের উপরে কখনও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে, কখনও তার কণ্ঠ হয় কৃপাপ্রার্থীর মতো। এই দ্বন্দ্ব চূড়ান্তে ওঠে মৃতা সেনদিদির শিশুপুত্রকে নিয়ে। ওই শিশুপুত্র নিয়ে শশী এক আশ্চর্য জটিলতায় ভোগে। আর গোপাল পায় এক আশ্চর্য মমতার আস্বাদ, শেষপর্যন্ত শশীকে কৌশলে গ্রামে আটকে রাখার জন্যে গোপালের যে স্বার্থত্যাগ তারও কোনো তুলনা নেই, সংসারী গৃহস্থ মানুষ গোপাল সমস্ত জীবন ধরে ফলপুষ্প-শস্যদাত্রী ভূমিখণ্ড, সিন্দুক ভরা সোনা রুপা, কতকগুলি মানুষের সঙ্গে পারিবারিক ও আরও কতকগুলি মানুষের সঙ্গে মানসিক দায়িত্ব, সম্পর্ক, বাধ্যবাধকতা প্রভৃতি যত কিছু অর্জন করেছিল সব সে দিয়ে গেল শশীকে, মরে গেলে যে মন সে দিত। পিতা পুত্রের শেষ সাক্ষাৎকারই একমাত্র তাদের মধ্যেকার ক্ষণিক স্বাভাবিক আলোকোজ্জ্বল মুহূর্ত। লেখকের বর্ণনায়—“সকালবেলায় স্বচ্ছ আলোয় দুজনের মুখ দেখিয়া মনে হইল না পিতাপুত্রে কোনোদিন সামান্য বিষয়েও মতান্তর ছিল। জীবনের গতি দুজনের বিপরীতগামী।" অর্থাৎ পিতা ও পুত্র হলেও গোপাল ও শশীর কখনো মানসসেতু রচিত হয়নি।


স্বামী ও স্ত্রী : ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'য় যে সকল দম্পতির কথা বর্ণিত হয়েছে তাদের মধ্যে পরাণ ও কুসুম, এর মধ্যে মনে হয় না কোনো মানসসেতু রচিত হয়েছে—দুজনের মানসিক ধরন ভিন্ন রকমের বলেই মনে হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে যে অ সেতু সম্ভব নির্দ্বন্দ্ব দীপবর্তী সম্বন্ধ, তীব্র তিক্ত ঘৃণার—মৃত্যুকামী এবং শেষপর্যন্ত অনুমান করা চলে উভয়ের এই দ্বন্দ্ব জটিলতায় একজনের মৃত্যুতেই অসবান সম্ভব। এদিকে নন্দ ও বিন্দুর মধ্যে কিছুতেই সুস্থ স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ রচিত হয় না, বিন্দু যখন তাকে স্বাভাবিক স্বামীত্বে বরণ করে নিয়েছিল নন্দ তখন তাকে বিমুখ করেছে। পরে নন্দলাল অনুতপ্ত হয়ে যখন বিন্দুকে স্বাভাবিক স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাইল তখন কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে। অর্থাৎ বিন্দু তখন যে বিকারবন্দি, অস্বাভাবিকতা ছাড়া তার আর বাঁচার উপায় নেই। আবার সুখি দম্পতি কুমুদ মতির সংস্পর্শে এসে বনবিহারী ও জয়ার সম্পর্কে ধরে ফাটল। জয়ার নিজেকে মনে হয় অসুখী, অপ্রেমিকা, সুখী দম্পতির ছবি যে এ উপন্যাসে নেই তা নয়, আত্মহন্তারক যাদব ও পাগলাদিদির কথা স্মরণ করে যেতে পারে। কিংবা ক্রমাগত কুমুদের ছাঁচে ঢালা মতিকে মনে পড়তে পারে। তবে পরিসংখ্যাগত এ উপন্যাসে অধিকাংশই অসুখী দম্পতির চিত্র অঙ্কিত।


প্রেমিক ও প্রেমিকা : এ উপন্যাসে যেমন মতি কুমুদের তীব্র মধুর প্রেমের আখ্যান আছে, যেমন আছে জয়া-বনবিহারির প্রেমভঙ্গের কাহিনি, তেমনি আছে প্রেমের ক্ষেত্রেও যোগাযোগহীনতার এক বিপুল সর্বনাশার উদাহরণ। আর তা ঘটেছে নায়ক শশীর জীবনে। দীর্ঘ নয় বছর ধরে কুসুম নানাভাবে আত্মনিবেদন করে চলেছে শশীকে, এক বাদল ঘন উত্তল দুপুরে নির্জনে উপস্থিত হয়েছে শশীর ঘরে, কিন্তু কাশী তখন দায়িত্বশীল। বন্ধুপ্রীতি বিসর্জন দিতে নারাজ। আবার এই শশীই যখন আত্মধিক্কারে জর্জরিত হয়ে ভালোবাসার উন্মাদনায় বলে ওঠে—“যেখানে হোক, যেখানে হোক চলে যাই আজ রাতে।" তখন শশীর সমস্ত আহ্বান বিদীর্ণ করে কুসুম জানিয়ে দেয়—“বলতে বসেছি যখন কড়া করেই বলি, আজ হাত ধরে টানলেও আমি যাবো না।" এই দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা যাদের মধ্যে এক মুহূর্তের বিনিময় সম্ভব হল না, তাদের জন্য আমাদের বুক ভেঙে যায়, কেননা ওদের প্রেমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র আচরিত সামাজিক বাধা নয়, ওদেরই ব্যক্তিগত মন।


বন্ধু ও বন্ধু : কলকাতায় কলেজ জীবনে শশীকে প্রথম মুক্তির স্বাদ দিয়েছিল কুমুদ। লেখকের ভাষায়—“যে দুর্গের মধ্যে গোপাল তাহার মনকে পুরিয়া সিল করিয়া দিয়াছিল, কুমুদ তাহা একেবারে ভাঙিয়া ফেলিতে পারিল না বটে, কিন্তু অনেকগুলি জানালা দরজা কাটিয়া বাহিরের আলো বাতাস আনিয়াছিল।” সেই কুমুদ অনেকদিন পর শশীদের গাওদিয়া গ্রামে যাত্রার নায়ক হিসাবে হঠাৎ এসে পড়লে মনে মনে শশী ভারি খুশি হয়েছিল। এতকাল পরে কুমুদের সঙ্গে দেখা হয়েছে শুধু এই জন্য নয়, কুমুদ নিজেই এসেছে বলে। শেষপর্যন্ত সেই কুমুদের সঙ্গে চলে শশীর নানারকম অন্তর্গত দ্বন্দ্ব ও দ্বৈরথ। অর্থাৎ তাদের মধ্যে বন্ধুপ্রীতিও একদা বিনষ্ট হয়।


অতএব সব মিলিয়ে বলতে হবে মনস্তত্ত্বের আলোকেই মানিক এ উপন্যাসের অবতারণা করে বিশেষ সাফল্য অর্জন করলেও এক হিসাবে সমগ্র উপন্যাসটির সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কথামালা। এখানে কোনো সম্পর্কই অটুট নয়, যেমন কালের অমোঘ নিমেষে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সম্পর্ক। জীবনের তুচ্ছটানাপোড়েনে আবার তা ভেঙে গেছে। চরিত্রের মধ্যেকার যে সূক্ষ্ম মানসিক হেতু তা তাদের অজান্তেই ভেঙে গেছে।