ফসিল গল্পের মধ্যে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্র এবং উদীয়মান ধনতন্ত্রের সংঘাত দেখানো হলেও কাহিনির পরিসমাপ্তিতে শোষক শোষিতের দ্বন্দ্বই চিত্রিত—এরূপ মন্তব্য কতদূর যথাযথ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ আঘাত বাংলা সমাজ ও বাঙালির সামাজিক অবস্থানে যে পালাবদল সূচিত করেছিল 'ফসিল' গল্পটি সেই পালাবদলের পটভূমিকায় রচিত। শোষণজীবী সামন্ততন্ত্র ও অমানবিক ধনতন্ত্রের যুগপৎ নির্মমতা, তাদের অশুভ আঁতাত ও মিলিত চক্রান্তে, শ্রেণিদ্বন্দ্বের চরম সংকট, মধ্যবিত্তের বিবেকবর্জিত আপোষ সর্বোপরি শোষণের যাঁতাকালে পিষ্ট কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর নির্মম পরিণতি ফসিল গল্পে আশ্চর্য কুশলতায় চিত্রিত।


গল্পটির কাহিনি অংশ খুব দীর্ঘ নয়। নেটিভস্টেট অঞ্জনগড়ের মহারাজা সামন্ততন্ত্রের প্রতিনিধি। সাড়ে ৬৮ বর্গমাইল সাম্রাজ্যের মধ্যে আছে কেবল ‘ঘোড়ানিম আর ফণীমনসায় ছাওয়া রুক্ষ কাঁকুরে মাটির ভাঙা আর নেড়া নেড়া পাহাড়’ চায় আবাদ প্রায় হয় না। চাষ বলতে সামান্য ভুট্টা যব আর জনার কুর্মী আর ভীল প্রজারা বহুদূরে পাহাড়ের গায়ে লুকোনো জলকুণ্ডু থেকে জল বয়ে এনে চাষ করে। আর সেই পরিশ্রমের ফসলের অর্ধেক চলে যায় রাজভাণ্ডারের রাজার পোলোটিমের ঘোড়াদের খাদ্যভাণ্ডার পূর্ণ করতে। প্রত্যেক বছর ফসলের ভাগ নিয়ে ‘স্টেটের তসীল বিভাগ আর ভীল ও কুর্মী প্রজাদের মধ্যে একটা সংঘর্ষ, বাঁধে। প্রজারা রাজভাণ্ডারে তাদের শ্রমের ফসল দিতে চায় না। ফলে তির, বল্লম আর লাঠির ঘায়ে তাদের ক্ষতবিক্ষত হতে চায়। রাজার শোষণে, অত্যাচারে উত্যক্ত হয়ে প্রজারা রাজ্য ছেড়ে পালায়। প্রায় অর্ধেক ভীল প্রজা চলে যায় মরিসালের চিনির কারখানায় কুলির কাজ করতে। কেবল যেতে পারে না সাতপুরুষের বাসিন্দা কুর্মী প্রজারা।


সামন্ততন্ত্রের শোষণ থাকলেও রাজা- জাত্য প্রকাশের জন্য প্রজাদের ওপর মাঝে মাঝে করুণ ধারাও বর্ষিত হয়। অঞ্জনগড় রাজ্যও এর ব্যতিক্রম নয়। এখান থেকে দুঃস্থ প্রজাদের চিঁড়ে আর গুড় বিতরণ করা হয়। সংক্রান্তির দিনে রাজা হাতির পিঠে চেপে প্রজাদের আশীর্বাদ করতে করতে পথ পরিক্রমা করেন। রাজার জন্মদিনেও প্রজারা খাবার নিমন্ত্রণ পায় তবে সব কিছুই চলে লাঠির অভিজাত্যে। অর্থাৎ অভাবী মানুষ খাদ্যের লোভে বিশৃঙ্খল হলেই লাঠি চলে। 'চিড়ে আশীর্বাদ বা রামলীলা—সবই লাঠির সহযোগে পরিবেশন করা হয়; প্রজারা সেই ভাবেই উপভোগ করতে অভ্যস্ত।


এদিকে ক্রমাগত শাসন শোষণ চালিয়েও রাজকোষ শূন্য হতে থাকে। রাজবাড়ির গদির গৌরবটুকু বজায় রাখতে পিতৃপুরুষের সঞ্চিত রুপো আর সোনাভাণ্ডারে হাত দিতে হয়। সেই সঞ্চয় ভাণ্ডারও শূন্য হতে থাকে। রাজদরবারের এই ভগ্নদশায় স্টেটের ল' এজেন্ট রূপে নিযুক্ত হয় আদর্শবাদী, ইংরেজি শিক্ষিত আইননবিশ জনৈক মুখার্জি। সে প্রথমেই দরবারের শ্রী ফেরাতে সচেষ্ট হয়। 'মুখার্জি তার প্রতিভার কণা উজাড় করে দিল স্টেটের উন্নতি সাধনায়। মূলত তার নির্দেশে প্রজাদের ওপর লাঠিবাজী বন্ধ হয়। সমস্ত দপ্তরে অডিট করা শুরু হয়। গোটা রাজত্বটায় নতুন করে জরীপ ও সেন্সাস করা হয়। এমনকি বহুদিনের মরচেপড়া কামান দুটোরও সংস্কার করা হয়।


মুখার্জির উদ্যোগেই অঞ্জনগড়ের ভূ-প্রকৃতির নীচে লুকানো অভ্র আর অ্যাসবেস্টসের খনির সন্ধান পাওয়া যায়। কলকাতা থেকে মার্চেন্ট ডাকিয়ে মুখার্জি অঞ্জনগড়ের পতিত জমিগুলিকে লাখ টাকায় উজারা দিয়ে দেয়। রাজকোষের আয় বাড়ে। অঞ্জনগড়ের শ্রী ফিরে আসে। নতুন প্রাণের জোয়ার লাগে রাজত্বে। খনি মার্চেন্টরা একজোট হয়ে প্রতিষ্ঠা করে ‘মাইনিং সিন্ডিকেট’। কুর্মী প্রজারা নগদ মজুরির বিনিময় খনিতে কাজ পায়। তারা 'নগদ মজুরি পায়, মুরগি বলি দেয়, হাড়িয়া খায় আর নিত্য সন্ধ্যায় মাদল ঢোলক পিটিয়ে খনি অঞ্চল সরগরম করে রাখে।


রাজত্বের শ্রী ফিরতেই এবং রাজকোষে অর্থাগম হতেই মহারাজা নতুন দুটো পোলো গ্রাউন্ড তৈরির কথা ভাবতে থাকেন। তাছাড়া নহবতের জন্য একজন মাইনে করা ইটালিয়ান ব্যান্ডমাস্টার নিয়োগের ফলপ্রসূ ইচ্ছাও তার মনে আসে। ওদিকে ল-এজেন্ট, মুখার্জির ভাবনায় তখন ‘ইরিগেশন স্ক্রীভকে ফলপ্রসু করার প্রয়াস। তাছাড়াও ‘একটা ব্যাংক’, ক্রমে একটা ট্যানারীয আর কাগজের মিল করার চিন্তাও মুখার্জির মনে উদয় হয়।


ইতিমধ্যে রাজদরবারে দুটি চিঠি এসে পৌঁছায়। প্রথম পত্রে কুর্মী প্রজাদের পক্ষ থেকে দুলাল মাহাতো জানিয়েছে যে, প্রজারা এবার থেকে মহারাজকে আইননুগ নগদ পয়সার খাজনা দেবে এবং বিনিময় রসিদ নেবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্যে দুলাল মাহাতো মরিসাসে চিনি কলে কাজ করতে গিয়েছিল। সেখান থেকে বাতিল হয়ে “বাকি জীনবটা উপভোগ করার জন্য সে সঙ্গে নগদ সাতটি টাকা এবং বুকভরা হাঁপানি নিয়ে ফিরেছে।” অন্য একটি পত্রে সিন্ডিকেটের চেয়ারম্যান গিবসন রাজাকে জানিয়েছে যে মহারাজের পেয়াদারা খনির মধ্যে থেকে চারজন কুর্মী কলিকে ধরে নিয়ে গেছে। সিন্ডিকেট মহারাজের এই কাজ অধিকার বিরুদ্ধে মনে করে এবং শীঘ্র মহারাজের পক্ষ থেকে সু-মীমাংসা দাবি করে। চিঠি দুটি মহারাজকে উত্তেজিত করে তোলো। তিনি পত্রদুটি মুখার্জির হাতে তুলে দেন।


প্রথম পত্রের লেখক দুলাল অসুস্থ তবু সে কুর্মীদের পক্ষে দাবি আদায়ের জন্য সচেষ্ট। তাই 'তার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে কুর্মীদের জীবনেও যেন একটা চঞ্চলতা একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। সিন্ডিকেটের সাহেবদের সঙ্গে দুলাল শ্রমিক পক্ষ নিয়ে কথা চালায়।


দুলালের আমন্ত্রণ পেয়ে কুর্মী প্রজারা একত্রিত হয় ঘোড়ানিমের জঙ্গলে। দুলালকে তারা মণ্ডলের নেতা রূপে মেনে নিল। হাজার জনতা ঢাক ঢোল পিটিয়ে নিশান উড়িয়ে দিল। কুর্মী প্রজাদের একজোট বাঁধার খবর গিয়ে পৌঁছায় মুখার্জির কানে। এদিকে কুর্মী প্রজারা মহারাজার নব নির্মিত পোলো লনের জন্য বেগার শ্রম দিতে অস্বীকার করে। দুলাল মহাতোর স্বাক্ষরিত পত্র এসে পৌঁছায় মহারাজের দরবারে। প্রজারা খনি সাহেবদের কাছ থেকে যেহেতু নগদ মজুরি পায় তাই তারা সাহেবদের কথা মেনে চলতে বাধ্য। তারা আশা করে মহারাজ এতে বাধা দেবেন না। পত্র মারফৎ তারা আরও জানায় যে তাদের নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য যেন রাজদরবার হাজার টাকা মঞ্জুর করে এবং প্রজাদের বিনা টিকিটে জঙ্গলের ঝুরি। আর লকড়ি কাটবার অনুমতি দেয়। অন্যদিকে রাজা সিন্ডিকেটকে জানিয়েছিলেন যে তাঁর সুপারিশ ছাড়া যেন কোনও প্রজাকে কুলির কাজ না দেওয়া হয়। সিন্ডিকেট মহারাজার নোটিশের শর্ত প্রত্যাখ্যান করে সুতরাং রাজদরবার—প্রজাপক্ষ সিন্ডিকেটের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। মুখার্জি বিরোধের মীমাংসার জন্য সিন্ডিকেট ও দুলাল মাহাতো উভয়পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।


ইতিমধ্যে মহারাজা খনি দুর্ঘটনার খবর পান। পেয়াদা খবর দেয় ১৪ নং পীট ধসে নব্বই জন পুরুষ আর মহিলা কুর্মী কুলি চাপা পড়েছে। সিন্ডিকেটকে জব্দ করার সংকল্পে মহারাজ যখন উৎফুল্ল তখন দ্বিতীয় দুঃসংবাদটি তার কানে আসে মহারাজের জমিদারির জঙ্গলে প্রজারা বিনা টিকিটে লকড়ি কাটছিল। ফৌজদারের গুলি চালনায় তাদের বাইশ জন মরেছে, পঞ্চাশজন ঘায়েল। জঙ্গলেই সব লাশ এখনো পড়ে আছে। অতঃপর ডাক পড়ল মুখার্জির। মুখার্জির পরামর্শে মহারাজের লোকরা আটক করল দুলাল মাহাতোকে।


তারপর “ঝাড়ের আলো জ্বলে উঠল প্যালেসের একটি প্রকোষ্ঠে। আবার ডাক পড়ল মুখার্জির। অভূতপূর্ব দৃশ্য। মহারাজা, সচিবোত্তম আর ফৌজদার—গিবসন, ম্যাককেনা, মূর আর প্যাটার্সন। সুদীর্ঘ মেহগনি টেবিলে গেলাস আর ডিকেন্টারের ঠাসাঠাসি !” মুখার্জির পরামর্শেই মাহাতো ধরা পড়েছে। তাই মহারাজা ও গিবসন তার কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ তারা উভয়পক্ষই ঝামেলা থেকে বেঁচে গেছে। অতপর বৈঠকের সিদ্ধান্ত ও করণীয় কাজ ফৌজদার মুখার্জির কানে কানে শুনিয়ে দেয়। মুখার্জি চমকে ওঠে, ফ্যাকাশে হয়ে যায় তার মুখ।


গল্পের শেষে মুখার্জির চমকে ওঠার কারণ স্পষ্ট হয়ে যায়। রাত দুপুরে অন্ধকারে ১৪নং পীটের কাছে থেমে যাওয়া একটা মোটরগাড়ির ভিতর থেকে দারোয়ানের কম্বলে মোড়া দুলাল মাহাতোকে টেনে নামায়। ঘোড়ানিমের জঙ্গল থেকে ট্রাক বোঝাই হয়ে আসে আরো লাশ। তারপর সব লাশ নামিয়ে দেওয়া হয় খনির গহ্বরে।


গল্পের কাহিনি এখানেই শেষ। কিন্তু গল্পকার এরপর মুখার্জির ভাবনার জগতে পরিস্ফুট করলেন ঘটনার অন্তরালবর্তী সভ্যতার নিরক্ত নির্মম অর্থহীনতাকে। মুখার্জির ভাবনার স্রোতে ভেসে আসা অনেকদিন পরের একটা কথা'র মধ্য দিয়েই গল্পটিকে চিরকালের পটভূমিতে উপস্থাপিত করলেন।


“লক্ষ বছর পরে, এই পৃথিবীর কোনও এক জাদুঘরে, জ্ঞানবৃদ্ধ প্রত্নতাত্বিকের দল উগ্র কৌতূহলে স্থির দৃষ্টি মেলে, দেখছে কতগুলি ফসিল। অর্ধপশুগঠন, অপরিণত মস্তিষ্ক ও আত্মহত্যা প্রবণ তাদের সাব-হিউম্যান শ্রেণির পিতৃপুরুষের শিল্পীভূত অস্থিকঙ্কাল, তার ছেনি, হাতুড়ী, গাঁইতা, কতগুলি লোহার ক্রুড কিম্ভুত হাতিয়ার। অনুমান করছে তারা, প্রাচীন পৃথিবীর একদল হতভাগ্য মানুষ বোধ হয় একদিন আকস্মিক কোনো ভূ-বিপর্যয়ে কোয়ার্টস আরপ গ্রানিটের গহ্বরে সমাধিস্থ হয়ে গিয়েছিল। তারা দেখছে, শুধু কতগুলি সাদা ফসিল ; তাতে আজকের এই এত লাল রক্তের দাগ নেই।”


গল্পের কাহিনির এখানেই যবনিকা। সুবোধ ঘোষের গল্পে প্রথম দিকে শ্রেণি সচেতনতার সুরটিই স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। ফসিল গল্পটি শ্রেণি সচেতনতার প্রতিক্রিয়ার রচিত। সমালোচক অরিন্দম গোস্বামীর ভাষায়—“এই গল্পে পরাধীন ভারতবর্ষের ওপর ঔপনিবেশিক শাসন ও তার ফলে সৃষ্ট তিনটি শ্রেণির সংঘর্ষের আখ্যান রচিত হয়েছে। এই তিন শ্রেণিতে একদিকে যেমন আছে সাম্রাজ্যবাদী ধনতান্ত্রিক বৃটিশ পক্ষ, অন্যদিকে তেমনি আছে দেশীয় সামস্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ধারক বাহক জমিদার শ্রেণি-আর এদেরই মাঝে রয়েছে সর্বহারা শোষিত শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণি, প্রথম দুই তীব্র শক্তিশালী নিষ্পেষক শক্তির পীড়নে শেষোক্ত শ্রেণির পরিণামের নিখুঁত আলোচ্য এই গল্পটি।" (সুবোধ ঘোষ : কথাসাহিত্যে)