‘টিনের তলোয়ার' নাটকের সমসাময়িক সময় ও সমাজ সম্পর্কে যা জানো সংক্ষেপে লেখো।

টিনের তলোয়ার নাটকের পটভূমি ১৮৭৬-র কলকাতার চিৎপুর বৌবাজার এবং শোভাবাজার নাট্যশালা। এই ১৮৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে এদেশের থিয়েটারের কণ্ঠরোধ করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার তদনীস্তন বড়োেলাট লর্ড নর্থব্রুক-এর আমলে কুখ্যাত 'নাট্য নিয়ন্ত্রণ' আইন চালু করেন, অশ্লীলতার অজুহাতে। আসলে ব্রিটিশ বিরোধী বাংলা নাটকের রমরমা দেখে ব্রিটিশ সরকার শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। নাট্যকার উৎপল দত্ত আলোচ্য নাটকের মুখবন্ধে অকুণ্ঠ চিত্তে জানিয়েছেন—“উল্লসিত প্রতিভায় সৃষ্টি হইল বাঙালির নাট্যশালা, জাতির দর্পণ, বিদ্রোহের মুখপাত্র।” এইসব–“শৈলেন্দ্র সদৃশ পূর্বসূরীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই রচিত হয়েছে ‘টিনের তলোয়ার'। এখানে পূর্বসূরী বলতে বোঝানো হয়েছে যে সকল নাট্যব্যক্তিত্বের অকুণ্ঠ প্রচেষ্টায় বাংলা মঞ্চে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়েছিল। বোধকরি, ১৮৭৬-র নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিল ও ব্রিটিশ সরকারের নাটক নিয়ন্ত্রণ প্রয়াসের বিরুদ্ধে থিয়েটারের নিজস্ব প্রতিবাদকে উৎপল দত্ত নাট্যায়িত করেছেন 'টিনের তলোয়ার'-এ।


মূলত সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রাথমিক পর্বের পটভূমিতে টিনের তলোয়ার-এর নাট্যকাহিনি বিন্যস্ত। সেই সময়ের রঙ্গালয়ের মালিকরা পৃষ্ঠপোষক তথা ছিলেন মূর্খ কিন্তু ধনী ব্যবসায়ী বা মুৎসুদ্দি। সুদের কারবার, দালালি এবং ইউরোপীয় বণিকের সঙ্গে অংশীদারী ব্যবসায়ের উপার্জন থেকেই তাঁরা ইউরোপীয় সাহেবদের অনুকরণে রঙ্গালয়ের মালিকানা সূত্রে সমাজে একপ্রকার নতুন মর্যাদার প্রত্যাশী হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৮৯ সাল নাগাদ বাংলা থিয়েটারের ব্যবসা শুরু হয়। প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী প্রতাপচঁাদ জহুরিকেই অনেকে প্রথম থিয়েটার-ব্যবসাদার বলে আখ্যা দেন। অনেকটা এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে উৎপল দত্ত 'টিনের তলোয়ার’ নাটকের যবনিকা উত্তোলন করেছেন।


নাটকের শুরুতে একটি পোস্টারে দেখানো হল শোভাবাজারের দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরা মঞ্চস্থ করতে যাচ্ছে ‘ময়ূরবাহন’ নাটক। এই অপেরা কোম্পানির মালিক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দা সাহেবদের একজন মুৎসুদ্দি। ব্যবসায়ে তাঁর বাইশ লক্ষ টাকা খাটে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ধনী কিন্তু শিক্ষা দীক্ষার কোনো বালাই নেই। বহু রক্ষিতার বাবু হওয়াতেই প্রকাশ পায় তাঁর সামাজিক মর্যাদা। বাংলা নাট্যশালায় ভালো নাটকের অভাববোধ করায় তিনি নিজেই নাটক লিখতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। প্রয়োজনে বেতনভূক নাট্যকার রাখতে চান। এ ব্যাপারে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ নিজের ভাড়া করা নাট্যকার বানাতে চান। মাইকেল মধুসূদন দত্ত আর কালিদাসে কোনো প্রভেদ না রেখে মধুসূদনকেই তিনি 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম'-এর নাট্যকার ভাবেন। দীনবন্ধুকে নাট্যকার বলেই তিনি মনে করেন না। এমনকি দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী'কে ব্যঙ্গ করতেও তিনি পিছপা হন না।


ভয়ংকর ধরনের অশিক্ষিত মূর্খ এই মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ীর মন জুগিয়ে চলতে হয় গ্রেট বেঙ্গল অপেরার নির্দেশক, প্রধান অভিনেতা বেণীমাধব চট্টোপাধ্যায়কে। কন্যাসম শিষ্যা শংকরী ওরফে ময়নাকে বাবু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁর কাছে বাঁধা রেখে থিয়েটার চালাতে চান বেণীমাধব। প্রিয়নাথ প্রশ্ন তোলে—“আপনার কোনো মোরালিটি নেই। নীতিবোধ ন্যায়বোধ এসব আপনার ধাতেই নেই।” বেণীমাধব প্রত্যুত্তরে বলেন—“নীতিবোধ নিয়ে চললে আর থিয়েটার করতে হত না এদেশে। বীরকৃষ্ণ দায়েদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে থিয়েটার চালাতে হয়। তাই চালিয়ে আসছি বহু বৎসর। গলায় নীতির পৈতে ঝুলিয়ে ব্রহ্মজ্ঞানী সাজলে এই কলকাতায় না হত থিয়েটার, না হত নাচ-গান, না হত নাটক নভেল লেখা।"


বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ যখন বলেন উপেন্দ্রনাথ দাস, অমৃতলাল, ভুবন নিয়োগী, মহেন্দ্রবাবু, মতিসুর সব গ্রেপ্তার হয়েছেন, যখন জানা যায় ১৮৭৬-র নাট্যনিয়ন্ত্রণ অর্ডিন্যান্সের জন্য সুরেন্দ্র বিনোদিনী, সতী কি কলঙ্কিনী, গজদানন্দ নাটক, পুলিশ অফ পিপ এণ্ড শীপ প্রভৃতি নাটক নিষিদ্ধ হয়েছে, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যখন তিতুমীরের বদলে তাঁর একসময়ের অপছন্দের নাটক সধবার একাদশী মঞস্থ করতে বলেন তখন বেণীমাধব সে নির্দেশ মেনে নেন। তার কারণ দর্শিয়ে বেণীমাধব বলেন, “আমার একটা দায়িত্ব নেই ? দলের লোকগুলোর রুজি-রোজগারের দায়িত্বটা, আমার নয় ? আমি জেলে গিয়ে বসলে এদের কী হবে? থেটার উঠে গেলে দেশের খুব উপকার হবে? দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে ? ইংরেজ পালাবে?” বাংলা থিয়েটারে মধ্যবিত্ত চরিত্রের যথাযথ রূপায়ণ বেণীমাধবের এই স্বীকারোক্তি। বাস্তবে এই মধ্যবিত্ত-মধ্যচিত্তের থিয়েটারি মানুষজনদের পরিণতিতে যে বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটবেই তেমনটি হয়তো বলা যাবে না।


কিন্তু সচেতন নাট্যকার-নাট্যকর্মীর চোখে উত্তরণের স্বপ্ন তা থাকবেই। উৎপল দত্তের সৃষ্ট বেণীমাধব তাই আপাতদৃষ্টিতে একজন নিরীহ অভিনেতা ও নাট্যপরিচালক হয়েও অস্তরে একজন স্বদেশ সচেতন বিপ্লবী। সধবার একাদশী নাটকে নিমচাঁদের ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে দর্শকাসনে উপবিষ্ট ল্যাম্বার্ট সাহেবকে দেখে তাঁর স্বদেশপ্রেম জাগরিত হয়। নির্মচাদরূপী বেণীমাধব হয় ওঠেন বিদ্রোহী তিতুমীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, “মা, আমি তিতুমীর, দেশের মাটি মুঠিতে ধরে এই শপথ নিই”। দর্শক আসনে আসীন ল্যাম্বার্ট বলে ওঠে—'স্টপ দিস’ । বেণীমাধব তীব্র প্রতিক্রিয়ায় বলে ওঠেন “যতক্ষণ একটা ফিরিঙ্গি শয়তান দেশের পবিত্র বুকে পা রেইখে দাঁড়গে থাকবে ততক্ষণ এই ওয়াহারি তিতুমীরের, তলোয়ার কোষবদ্ধ হবে না কখনো।” উপেন্দ্রনাথের শরৎ-সরোজিনী নাটকের মুখ্য চরিত্র শরতের মুখেও তো প্রায় একই ধরনের বিপ্লব-সঞ্জাত বাণী শোনা যায়—“প্রণয়মত্ত হওয়ার এই কি সময় ? আমাদের ঘৃণা নাই। গরু গাধার মতো দিবারাতি শাসিত হচ্ছি, তা কি মনে থাকে না? পদে পদে ইংরাজদের বিজাতীয় অহংকার দেখেও কি রক্ত ধমনীতে বিদ্যুতের মতো ধাবিত হচ্ছে না? শরীর উম্মত্ত হয় না ? মনে ধিক্কার জন্মায় না ? এখন অন্য ইচ্ছা অন্য অভিলাষ।” (শরৎ সরোজিনী, ১/১ দৃশ্য) নাট্যকার এবং নাট্যশিক্ষক উপেন্দ্রনাথ দাসের নাট্যকর্মের মধ্যে যে জাতীয় উদ্দীপনার প্রেরণা ছিল সেই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উৎপল দত্ত ‘টিনের তলোয়ার' রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন।


তাই বলতে হয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ ও তৎপরবর্তী কালের বাংলার সমাজ-সময়, বিশেষ করে ১৮৭৬-র নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিল সংক্রান্ত নাটক ও রঙ্গমঞ্চের পরিবেশ—'টিনের তলোয়ার’ নাট্যকে উপযুক্তভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে।