যে আবহমণ্ডল তথা পরিবেশ ‘মুক্তধারা' নাটকখানিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে তা সবিস্তারের বর্ণনা করো।

সমালোচক প্রমথনাথ বিশী মন্তব্য করেছেন—“মুক্তধারায় আবহাওয়ার গুরুত্ব বেশি, কবির বক্তব্যের অধিকাংশই আবহাওয়ার দ্বারা প্রকাশিত। বাঁধের লৌহযন্ত্র ও ভৈরবমন্দিরের চূড়া বৃহত্তর আবহাওয়ার অংশমাত্র।" মূলত এ নাটকে রবীন্দ্রনাথ যে তাত্ত্বিক ভাবটি প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন তা প্রকাশিত হয়েছে তার পরিবেশ বা আবহমণ্ডল রচনায়। আর তা হল মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ বা আবহমণ্ডল। নাট্যকার মনে করতেন, মানুষের অস্তিত্বের, ব্যক্তিত্বের সংকট হল একজাতীয় উগ্রজাতীয়তাবাদী রাজনীতি। এই জাতীয় রাজনীতি অর্থনৈতিক অবস্থার নিয়ন্ত্রক শক্তি বিশেষ একটি ভৌগোলিক পরিবেশ থেকে তা জাত। এখানে দুটি স্থানের কথা আছে—উত্তরকূট পার্বত্য প্রদেশ আর শিবতরাই সমভূমি। স্থানগত পরিবেশের পার্থক্য দুটি জাতির মধ্য অবাঞ্ছিত সম্পর্ক গড়ে সংকট সৃষ্টিতে সহায়তা করে।


নাট্যকাহিনি উপস্থাপনায় নাট্যকার মঞসজ্জায় যে পথের স্থিতিশীলতার স্থানিক পরিবেশ কল্পনা করেছেন তার প্রভাব দর্শক মনে, অভিনয় চলাকালীন মুহূর্ত থেকে শেষপর্যন্ত ক্রিয়াশীল থাকে। দর্শক দেখতে থাকে, নাটকের সমস্ত পাত্রপাত্রী পথে চলতে চলতেই কথা বলছে, কেউ স্থির নয়। চরিত্রগুলির এই গতিশীলতার মধ্য দিয়ে মুক্ত জীবনের গতিশীলতাই প্রতিফলিত হয়। এছাড়া নাটকে বিভিন্ন চরিত্রের মুখে পথ শব্দটি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে। পথের স্থানিক পরিবেশটি যে তত্ত্বকে তুলে ধরেছে তা হল—স্বভাবত গতিশীল মানব জীবনের গতিকে রুদ্ধ করলে তা বিকৃত রূপ ধারণ করে এবং মানবতার অস্তিত্বের ক্ষেত্রে সংকটের সৃষ্টি করে। অর্থাৎ 'মুক্তধারায়' তত্ত্বগত দিক থেকে স্থানিক পরিবেশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।


এ নাটকের ঘটনাগুলি যে কালগত পটভূমিকায় উপস্থাপিত তত্ত্বোপস্থাপনে তার তাৎপর্যবহ ভূমিকাও স্মরণীয়। সময় বিভাজনের প্রচলিত রীতিটি সূর্যকেন্দ্রিক এবং তিথিকেন্দ্রিক। নাট্যকাহিনি নির্মাণে লেখক এই দুই রীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। সমগ্র কাহিনিটি সংঘটিত হয়েছে এক 'অমাবস্যা' তিথিতে, যাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় মনে ‘সংস্কারগত কারণে এক অজানা আশঙ্কার মনস্তাত্ত্বিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। কারণ, অমাবস্যার সঙ্গে সমীভূত হয়ে থাকে অপ্রতিরোধ্য অনিবার্য দৈবশক্তির এক ভয়ংকর রূপ। নাট্যকার এই তিথি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কাহিনি চলাকালে দর্শকমনে এই আশঙ্কাও আতঙ্কজনিত মনস্তাত্ত্বিক আবহ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন—যা বিশেষ কালগত সীমা অতিক্রম করে মানবতার সংকট সৃষ্টি জনিত এক সর্বজনীন আতঙ্ককর অনুভূতির দ্যোতক হয়ে উঠেছে।


নাটকের সমগ্র কাহিনিটি একদিনেই সংঘটিত হয়েছে—পড়ন্ত বিকেল থেকে মধ্যরাতের অন্ধকারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। সময়ের এই উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চরিত্রের উক্তিতে। কালগত পটভূমিকায় কাহিনি উপস্থাপনার এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রতীকীভাবে তুলে ধরেছে, মানবসভ্যতার ক্ষেত্রে সংকটজনক পরিস্থিতির চরম কালাত্তক মুহূর্তটিকে। এইরকম মুহূর্তে মানব মনে সবসময়েই একটা অজানা ভাবের আশঙ্কা জাগরিত হয়। ঘটনাকালের এই সংক্ষিপ্ত রূপটি বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে। সূর্যাস্তের পর আলো চলে যায় এবং পৃথিবীর যতকিছু অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। সূর্যকে মনে হয় মানবজাতির আদর্শ এবং সেই আদর্শই তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে তুলে ধরে। কিন্তু সেই আদর্শ যখন ডুবে যায় তখন মানব জাতির ভবিষ্যও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এমনই একটি ভাবাদর্শ প্রতিস্থাপিত হয়েছে এ নাটকের কাহিনি সংঘটনের সময়সীমায়।


যন্ত্রের ব্যবহার যে সংকটের সৃষ্টি করেছে সেই সংকট-কাল থেকেই ক হিনির শুরু—যখন সকলের মনে মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা আশঙ্কা দেখা দিতে শুরু করেছে। অভিজিৎ সঞ্জয়ের কথোপকথনের প্রথম দিকেও তাই সূর্যাস্তের প্রসঙ্গ এসেছে। তখন সূর্য গৌরীশিখরের ওপরে ডুবে গেছে, কিন্তু সূর্যাস্তের আলো তখনও রয়েছে। সূর্যাস্তের পর সময়টা যে গোধূলি তা সঞ্জয়ের উদ্ভিতে ধরা পড়েছে— “গোধূলির আলোটি ওই নীল পাহাড়ের ওপরে মূর্ছিত হয়ে রয়েছে।” এরপর উত্তরকূটের নাগরিক দলের তৃতীয়জনকে যখন বলতে শোনা যায়—“সূর্য অস্ত গেছে, আকাশ অন্ধকার হয়ে এলো।” তখন বোঝা যায় মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে সামান্য আশার আলোটুকু ছিল তাও যেন নির্বাপিত। যখন বর্তমান অগ্রহণীয় অথচ ভবিষ্যত্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন তখনই তো মানবসভ্যতার সংকট।


অতঃপর ঘনায়মান অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, শুরু হয় রাত্রির প্রহর, কিন্তু মানুষ জানে যে, প্রকৃতির নিয়মেই সূর্য অস্ত যায়, রাত্রি আসে— কিন্তু সেই রাত্রি কখনোই চিরস্থায়ী নয়, পরের দিন আবার সূর্য উঠবে। রাত্রি তার অন্ধকার আবরণের মধ্যে সেই তপস্যাই করে—–সূর্যোদয়ের তপস্যা। অন্ধকারেই শুরু হয় তাদের তপস্যা, যারা মানবসভ্যতাকে, সংকট থেকে উদ্ধারে ব্রতী হয়। মানুষের মুক্তির সেই সম্ভাবনাময় উল্লাসকেই যেন বাঁধভাঙা মুক্তধারার জলকল্লোলের মধ্যে ধ্বনিত হতে শুনেছে ধনঞ্জয়। নাট্যকাহিনিতে ঘটনা গ্রহণে এইভাবে কালগত পটভূমিকার পরিকল্পনা করেই নাট্যকার তার নাটকে আবহমণ্ডলকে তত্ত্বউপস্থাপনা ও তত্ত্বপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সার্থক করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।