গৌরবিষয়ক পদের প্রধান পদকতাদের পরিচয় দিয়ে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে তা নিরূপণ করো।

গৌরাঙ্গবিষয়ক পদকতাদের মধ্যে যাঁরা প্রধান তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই চৈতন্য সমসাময়িক বা তাঁর ঈষৎ পরবর্তীকালের পদকর্তা। চৈতন্যদেবের জীবন, তাঁর লৌকিক রূপ ও অলৌকিক ভাবসম্পদ তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন বা যাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের জীবন্ত স্মৃতি থেকে তা শুনে ও তাঁদের কবিমন সাক্ষাৎ-দর্শনের দিব্য উন্মাদনায় উদীপ্ত হয়ে উঠেছেন। মহাপ্রভু চৈতন্যের এই প্রত্যক্ষতাই ছিল তাঁদের কাব্য প্রেরণা।


গৌরাঙ্গবিষয়ক পদকতাদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই গোবিন্দদাসের কথা বলতে হয়। তিনি চৈতন্যদেবের মহাপ্রয়াণের অব্যবহিত পরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শ্রীখণ্ডের মহাকবি দামোদর কবিরাজের দৌহিত্র। প্রথম জীবনে শাক্ত হলেও শ্রীনিবাস আচার্য তাঁকে বৈষ্ণবমতে দীক্ষিত করেন। তিনি পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। শ্রীজীব গোস্বামী তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। এঁদের স্মৃতি কথাই তাঁর কাছে চৈতন্য মূর্তি প্রত্যক্ষবৎ উদ্বোধিত করেছিল। গৌরপদ রচনায় এই ছিল তাঁর প্রেরণা। অলঙ্কার চাতুর্য, ছন্দ নিপুণতা ও শব্দ লালিত্যে ছিল তাঁর কবি স্বভাবের সহজ অধিকার। গৌরপদে তাঁর এই স্বাভাবিক শক্তির সঙ্গে মিশেছিল প্রত্যক্ষবৎ অনুভবের ভাবগভীর অনুভূতি। তাঁর গৌরপদের আর এক বৈশিষ্ট্য হল তাঁর অঙ্কিত চৈতন্য ভাবোন্মত্ত রূপের সঙ্গে গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্বভাষ্যের অঙ্গাঙ্গি সম্মেলন। এ কারণেই তাঁকে বৈষ্ণব মহাজনদের মধ্যে গৌরপদের শ্রেষ্ঠ কবি বলা হয়।


বৈষ্ণব পদকর্তাদের মধ্যে গৌরপদের রচনায় গোবিন্দদাসের পরে যাদের নাম করতে হবে তাঁরা হলেন গোবিন্দ ঘোষ, মাধব ঘোষ ও বাসুদেব ঘোষ। এঁরা তিন ভাই ছিলেন এবং ছিলেন কবি ও পদকর্তা। এঁরা সকলেই চৈতন্য প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। নবদ্বীপে এঁরা শ্রীচৈতন্যের কৃপাও লাভ করেন। ফলতঃ এঁদের অন্তরে ছিল প্রত্যক্ষ দর্শনের প্রেরণা।


লক্ষ্য করবার কথা এই যে গোবিন্দদাসের পদে ভাবের সঙ্গে, রূপের সঙ্গে চৈতন্যতত্ত্বের যে অঙ্গাঙ্গি অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়, তা এঁদের গৌরপদে নেই। এর প্রথম কারণ এই যে তখনও বৈষ্ণব দর্শনশাস্ত্র গড়ে ওঠেনি। তাই তার অস্তিত্বের কোনও সম্ভাবনা ওঁদের কাব্যে ছিল না। দ্বিতীয়ত প্রত্যক্ষ দর্শনের চিত্রগুলি তাঁদের বুকে এত সজীব ও স্পষ্ট ছিল যে তা অবিকল রূপই গ্রহণ করেছে তাঁদের কাব্যে। সে ছবি আমাদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁদের পদ পাঠে বা গানে। সেখানে তত্ত্ব সম্ভব নয়।


এঁদের পদের আন্তরিকতা অভূতপূর্ব। চৈতন্য জীবনের নানা পর্বই তাঁদের রচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। গোবিন্দ ঘোষ নিমাই-এর পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ নিয়েও পদ লিখেছেন। চৈতন্যদেব সন্ন্যাস গ্রহণে উদ্যত দেখে কবি নদীয়াবাসীদের সম্বোধন করে বলছেন-

হেদেরে নদীয়াবাসী কার মুখ চাও।

বাহু পসারিয়া গোরাচান্দেরে ফিরাও।।


বাসু ঘোষ গৃহত্যাগের পর শচীমাতার স্বপ্নদর্শনের করুণ বিবরণ দিয়েছেন।

আজিকার স্বপনের কথা    শুনলো মালিনী সই

নিমাই আসিয়াছিল ঘরে

আঙ্গিনাতে দাঁড়াইয়া    গৃহপানে নেহারিয়া 

মা বলিয়া ডাকিল আমারে।।


এ সব কবিতায় এঁদের ব্যক্তি বেদনারও স্পর্শ ঘটেছে। এই তিন ভাই-এর রচনায় এই আন্তরিকতা চিত্রধর্মিতা ও তৎকালীন পরিস্থিতির বিবরণ পদগুলিকে অনেকটা যাত্রার গানে পরিণত করেছে। এগুলি কখনই গৌরচন্দ্রিকা হবার যোগ্য নয়। তবে বাসুদেবের পদাবলীর প্রধান অংশ চৈতন্যলীলা বিষয়ক পদ হলেও তার মধ্যে অনেকগুলি 'গৌরচন্দ্রিকা' হবার যোগ্য পদও আছে। তাঁর গৌরচন্দ্রিকার পদ সেকালে সমাদৃতও ছিল। দীনবন্ধু দাস ‘সংকীর্তনামতে’ তাঁর গৌরচন্দ্রিকার পদ বিষয়ে লিখেছেন,—

বাসুদেব ঠাকুরের বিচিত্র বর্ণন

শুনিতে জুড়ায় শ্রোতার কর্ণ মন।।

কীর্ত্তনের আরম্ভে রসের অনুসারে।

গৌরচন্দ্র-সেই পদ গাও সমাদরে।


গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদে আর একজন উল্লেখ্য পদকর্তা হলেন কবি পরমানন্দ। ইনিই সম্ভবতঃ কৃষ্ণযাত্রার পদকর্তা, গায়ক ও অধিকারী ছিলেন। তিনি যেমন রাধাকৃষ্ণ লীলাবিষয়ক পদ রচনা করেছেন, তেমনি পদ রচনা করেছেন গৌরাঙ্গ বিষয়ে। কিন্তু এসব গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ আদৌ রাধাকৃষ্ণলীলা প্রবেশক সম্বন্ধীয় নয়। চৈতন্যদেব সম্পর্কে কবির প্রগাঢ় অনুভূতি তুলনাহীন বাগভঙ্গিতে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর এক বিখ্যাত পদে তিনি চৈতন্যদেবের সঙ্গে পরশমণির তুলনা করে তাঁকে পরশমণি থেকেও শ্রেয় বলে প্রতিষ্ঠা করেছেন। পরশমণিকেও স্পর্শ করতে বা করাতে হয়, কিন্তু চৈতন্য নিজেই এসে পতিতোদ্ধার করেন। শুধু তাঁর নামোচ্চারণেই কতজন রত্নে পরিণত হয়েছেন—

পরশমণির সাথে   কি দিব তুলনারে

পরশ ছোঁয়াইলে হয় সোনা। 

আমার গৌরাঙ্গ গুণে    নাচিয়া গাহিয়ারে

রতন হইল কত জনা।।


গৌরাঙ্গবিষয়ক পদের আর একজন বিশিষ্ট কবি রাধামোহন ঠাকুর। তিনি অষ্টাদশ শতকের কবি। তিনি পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। তিনি এক বিচার সভায় পরকীয়াবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি সংস্কৃত ও ব্রজবুলিতে পদ রচনা করেছেন। তাঁর বাংলাপদও বিখ্যাত যেহেতু রাধামোহন পণ্ডিত এবং চৈতন্য তথা যড় গোস্বামীর পরবর্তী কালের কবি তাই তার কাব্যে বৈষ্ণব রস-তত্ত্বের ছায়া পড়েছে। তাঁর বেশির ভাগ গৌরাঙ্গবিষয়ক পদে রাধাভাবে ভাবিত শ্রীচৈতন্যের ছবি। সমালোচকেরা আবিষ্কার করেছেন চণ্ডীদাস ও অন্যান্য বহু কবির রাধাবিষয়ক পদের ছায়া পড়েছে তাঁর চৈতন্য-বিষয়ক (গৌরাঙ্গ বিষয়ক) পদে। যেমন 'আজু হাম কি পেখলু নবদ্বীপচন্দ’ পদ পড়লেই চণ্ডীদাসের ‘ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার' পদটি মনে পড়ে যায়। তাঁর ‘পুনঃপুন গতাগতি করু ঘরপন্থ’ পদের সঙ্গে 'মন উচাটন নিশ্বাস সঘন, কদম্ব কাননে চায়’ সাজুয্য দেখা যায়। এগুলি স্বতঃই গৌরচন্দ্রিকার মর্যাদা লাভ করেছে।


গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ রচনার বিশিষ্ট কবি এঁরাই। এঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি গোবিন্দদাস। তিনি শুধু গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ নয়, গৌরচন্দ্রিকারও শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর কাব্যে গোবিন্দ ঘোষ বা বাসু ঘোষের গৌরপদের মত আন্তরিক আবেগ বা প্রত্যক্ষতা নেই, পরমানন্দের পদের মত অতিনাটকীয়তা নেই আবার রাধামোহনের পদের মত অতি-তাত্ত্বিকতা নেই। কিন্তু কবির স্বভাবসিদ্ধ মণ্ডনকলা, ছন্দলালিত্য, অলঙ্কারনৈপুণ্য ও বাক্-নির্মিতির যথার্থতা ভক্তি বিগলিত ও তদ্‌গতভাব সমৃদ্ধ হয়ে যে বাণীরূপ পরিগ্রহণ করেছে তা অতুলনীয়। গৌরাঙ্গকে তিনি স্বচক্ষে দেখেননি। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ ও বৈষ্ণব রসতত্ত্ব তাঁর মনকে এমন কবি কল্পনায় উদ্বোধিত করেছে যে তার কাব্যে চৈতন্যের দিব্য মূর্তিতে এক অলৌকিক মহিমা সঞ্চার করেছে, সম্ভবতঃ ঐ দিব্যমূর্তি অঙ্কন মণ্ডনকলা, ছন্দবোধ বাক্ নির্মিতি ভিন্ন অন্য কোনও বাণীরীতিতে তা সিদ্ধ হত না। কবির পদ পড়তে পড়তে চৈতন্যের সর্বদেহে বিকশিত ভাব কদম্ব ও নীরদনয়নে নীরঘন সিঞ্চনে যে পুলক মুকুল ফুটে ওঠে, তা কবির মত পাঠক শ্রোতকেও বলতে হয়,

কি পেখলু নটবর গৌরকিশোর।


গোবিন্দ দাসের মধ্যে ভক্তের শ্রদ্ধা, শিল্পীর রূপদক্ষতা এবং ভাবতন্ময়তার অপূর্ব সম্মেলন ঘটেছে। যেহেতু গোবিন্দদাস তত্ত্বজ্ঞ তাই তাঁর গৌরপদে চৈতন্যরূপের মধ্যে প্রেম বিমুগ্ধ রাধার তগতভাবও অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই ছবি পাঠক শ্রোতার মনে দুরকম তাৎপর্য এনে দেয়। আবার তিনি একই অঙ্গে রাধাকৃষ্ণ। তিনি রাধাভাবেও ভাবিত কৃষ্ণভাবেও। শ্রীচৈতন্যের এটাই অস্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গের সম্মিলিত রূপ। গোবিন্দ দাস ছাড়া গৌরপদ বা গৌরচন্দ্রিকা রচনায় অন্য কোনও পদকতার রচনায় এত বৈভবের আস্বাদ মেলে না।