‘কালকেতুর বিবাহের অনুবন্ধ' ও 'কালকেতুর বিবাহ অবলম্বনে সে কালের সমাজের বিবাহ পদ্ধতি ও স্ত্রী আচারের পরিচয় দাও।

সমগ্র মধ্যযুগে যে সকল কারণে কবিকঙ্কণ অন্যতম শ্রেষ্ট কবি হিসাবে চিহ্নিত তাঁর মধ্যে তার সমাজচেতনার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য। 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যে আমরা কবির বাস্তববোধ, তৎকালীন সমাজের জীবন যাত্রার একটা স্বচ্ছ ধারণা লাভ করতে পারি। ভারতীয় হিন্দুদের দশবিধ সংস্কারের মধ্যে বিবাহ সংস্কার প্রধান। বিবাহ ব্যাপারে স্ত্রীআচার প্রাধান্য পেয়েছে বরাবর। কবিকঙ্কন ষোড়শ শতকের কাব্যে যে বিবাহের বর্ণনা দিয়েছেন বর্তমান নিষ্ঠাবান গৃহস্থের ঘরে সেই বিবাহ লক্ষিত হয়।


প্রসঙ্গক্রমে, কালকেতুর কাহিনিতে কবি দুটি বিবাহের বিবরণ দিয়েছেন– (১) উমা মহেশ্বরের বিবাহ। (২) কালকেতু ফুল্লরার বিবাহ। প্রথমটি দেবসমাজের, দ্বিতীয়টি ব্যাধ সমাজের। কিন্তু কবির ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিতে ও দুটিতে হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণের বিবাহ-চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।


উমা-মহেশ্বরের বিবাহে সেকালে বাল্যবিবাহের প্রচলন প্রতিভাত। বিবাহকালে উমার বয়স ছিল মাত্র আট বৎসর। বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপনে ঘটকেরও উপস্থিতি ছিল, নারদমুনিই ঘটক। বিবাহ-দিনে পার্বতী হলুদশাড়ী পরে বসলেন। মুনিরা বেদ ধ্বনি করে গদ্ধাধিবাস শুরু করলেন। মহী-গন্ধ-দূর্বা-পুষ্পমালা নানা উপাচার অধিকারের ডালা সাজান। মুনিরা যোজনা করে সূত্র বন্ধন করে মস্তকে দীপ পাত্র ছোঁয়ালেন এবং সিঁথিতে অঙ্গুরী দিয়ে আশিস্ করা হল। প্রচুর নৈবেদ্য সহযোগে বসু পূজা হয়। বসু পূজার অস্তে হিমালয় নান্দীমুখ শ্রাদ্ধ করলেন। পুরনারীরা জড়ো হলেন মঙ্গলাচরণে। গৌরী-জননী মেনকা পুরনারীদের সঙ্গে কাঁধে কলসী নিয়ে ঘরে ঘরে জ্বল সইয়ে এলেন। এয়োগণ উলুধ্বনি দিয়ে উমার হাতে সুমঙ্গল সূত্র বেঁধে দিলেন।


অন্যদিকে দেখা যায় মহাদেব সমস্ত ক্রিয়া, আচার বিধিবিধান অনুযায়ী অধিবাস সম্পন্ন করে দৈত্য-দানব, ভূত-প্রেত নিয়ে ছাই ভস্ম মেখে হিমালয় গৃহে পদার্পণ করলেন। গিরিরাজ বরকে অভ্যর্থনা করে আসনে বসালেন এবং অঙ্গুরী, বসন, মাল্য দ্বারা বরণ করলেন। ওদিকে মেনকা পুরনারীদের নিয়ে স্ত্রী-আচার শুরু করলেন—মহাদেবের পায়ে দধি ঢেলে, কপালে চন্দন লেপন করলেন। এরপর নন্দীর অনুরোধে মহাদেব মদনমোহন বেশ ধারণ করলে তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় সমবেত নারীগণ পতিনিন্দায় ব্রতী হন। এবার মহাদেব বিয়ের পিঁড়িতে আরোহণ করলেন। গৌরী শিবকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে— ‘নিছিয়া গেলিল পান কৈল নমস্কার' তার পর শিবের গলায় রত্নমালা সম্প্রদান করলেন। হরগৌরী একাসনে বসলে পিতামাতা গাঁটছড়া বেঁধে দিলেন। গিরিরাজ জামাতাকে ঝালর, শয্যা, মালা ধেনু এবং উত্তম আসন যৌতুক দিলেন। এর পর হরগৌরী ক্ষীরের অন্ন ভোজন করে বাসর শয্যায় গেলেন।


কালকেতু ফুল্লরার বিবাহ : কাব্যে কালকেতু-ফুল্লরার বিবাহের সঙ্গে হরগৌরীর বিবাহের সাথে কোনও অংশে মৌলিক পার্থক্য নেই। ব্যাধ জীবনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বিবাহ অনুষ্ঠান পালিত হয়েছে। সেকালে ব্যাধ সমাজেও বাল্য বিবাহের প্রচলন ছিল। কারণ ঘটকের মুখে প্রকাশিত—‘কার করে দশম বৎসরে মাতা হাতী'। দশ বৎসর বয়সেই কালকেতুর বিবাহ হয়। হাটে ফুল্লরা কালকেতুর আভিভাবকগণ বিবাহস্থির করলেও উভয়েই ঘটকের শরণাপন্ন হয়েছে। ধর্মকেতু তাদের কুলপুরোহিত সোমাই ওঝাকে কালকেতুর বিবাহের জন্য অনুরোধ করে। সোমাই ওঝা সঞ্জয় কেতুর গৃহে গেলে ফুল্লরার জন্য পাত্র দেখতে বলে গোঁসাই ওঝা জীবন-

“খুজিয়া পাইল যেন হাঁড়ি মুখের সরা।”

সঞ্জয় কেতু গোঁসাইকে এ বিবাহ সম্পন্ন করতে বলে।


কালকেতু ফুল্লরার বিবাহের বর্ণনা উমা-মহেশ্ব বিবাহের অনুরূপ। ব্যাধজীবনের সঙ্গে সঙ্গতি রাখার জন্য একটি নতুনত্ব সৃষ্টি করেছেন কবি—ঢেমচা দগড় বাজদা, কুঞ্জের চর্মে উপবেশন, দোলায় গমন, বনফুলের মালা দিয়ে বরণ ইত্যাদি। বরকে নানাবিধ যৌতুক দেবার সাথে সাথে কন্যাকে পণ দেবার প্রচলন ছিল। এখানেও ব্রাক্মণ পুরোহিত বেদমন্ত্রে গণেশের আবাহন দিয়ে বিবাহানুষ্ঠান শুরু করেছেন। উমা পরমমহেশ্বর বিবাহেও গণেশের পূজা বর্ণনা আছে। কিন্তু উমা জননী বলে তা গ্রথিত হয়নি কিছু কিছু ক্ষেত্রে। এখানেও গন্ধাধিবাসন, ফুল্লরার হলুদশাড়ি পরে বসে, দ্বিজকরে সূত্র বেঁধে দেওয়া, ষোড়শ মাতৃকা পূজা, বসুধারা দান, নান্দী মুখশ্রাদ্ধ ইত্যাদি যাবতীয় শাস্ত্রীয় বিধানের উল্লেখ আছে।


বাউরিদের দোলায় চড়ে বরযাত্রী নিয়ে কালকেতু সঞ্জয়কেতুর গৃহে গমন করল, উলুধ্বনির মধ্যে সবাই এসে পৌঁছুল—

“কেহ আগাইয়া ধীরে   গুড় চাউলী মারে

গুয়া কাটায় হৈল গণ্ডগোল।।"


ফুল্লরার মা হীরাবতী স্ত্রী-আচারে জামাতাকে বরণ করে—

"শিরে দিয়া দুর্বাধান   নিছিয়া ফেলিল পান

গালে দিল বনফুল মালা।।"


সঞ্জয়কেতু কুশহস্তে কন্যাদান করে যৌতুক তুলে দিল কালকেতুর হাতে। এখানেও বরকন্যার বস্ত্রে গাঁট ছড়া বেঁধে দিল। হোম হল, অরুন্ধুতি দর্শন হল। তারপর—

“দোহেঁ প্রবেশিয় ঘরে   মীন মাংস ভোগ করে

রাত্রি গেল কুসুম শয্যায়।”


অবশেষে কন্যাবিদায়কালে সঞ্জয়কেতুর ব্যবহার সম্পূর্ণ অন্যরকম।

“বেয়াই-এর পায়ে পড়ি   ব্যবহার কৈল কড়ি

সাতনলা আঠাজাল কান্দে।।”


নতুনত্ব দানের মধ্য দিয়ে মুকুন্দরাম তৎকালীন সমাজ-চিত্রকে সংস্কারে জালে আবদ্ধ করে একটা বাস্তব রূপদান করেছেন যাতে বর্তমান ও মধ্যযুগীয় সমাজের সাযুজ্য লক্ষ্য করা যায়।