“প্রার্থনা” ও “নিবেদন” পর্যায়ের পদগুলি কি সমজাতীয় ? বিশ্লেষণ সহ উভয় পদের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করো।

গৌড়ীয় বৈষ্ণুব সম্প্রদায় রসশাস্ত্র অনুযায়ী পঞ্চরসের তত্ত্ব স্বীকার করলেও বাস্তবে ‘দাস্যভাব’ এর প্রতি অনীহাই প্রকাশিত হয়। দাস্যভাবে ভগবানকে প্রভুরূপে উপাসনা করা হয়ে থাকে ; অতএব এই ভাবের উপাসনায় ভগবানের ঐশ্বর্যরূপই প্রকটিত। কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ মূলত মধুররসের সাধক বলেই তাঁরা ভগবানের ঐশ্বর্য ভাবকে কখনও কামনা করেন না। এই কারণেই চৈতন্যোত্তর যুগের কোনও কবি প্রার্থনার পদ রচনা করেন নি। চৈতন্য -পূর্বযুগে বড়ু চণ্ডীদাস রচিত শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্যরূপের প্রকাশ ঘটেছে। কবি বিদ্যাপতি ও কয়েকটি প্রার্থনা সূচক কবিতায় অপূর্ব ভাগবভক্তি এবং কবিত্ব শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। নিবেদন ও প্রার্থনার মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। এখানে রাধা ভক্তশ্রেষ্ঠ, কৃষ্ণ তাঁর ভগবান। কৃষ্ণের কাছে নিজেকে নিঃশেষে নিবেদন করে তিনি জীবনের সার্থকতা খুঁজে পান।


বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে প্রার্থনাসূচক কোনো পর্যায় নেই; বৈশ্বব পদাবলীর বিচিত্র রসলীলাতেও প্রার্থনার কোনও স্থান নেই। কিন্তু তৎসত্ত্বেও কোনো কোনো পদকর্তা প্রার্থনাসূচক কিছু পদ রচনা করে গেছেন।

তাতল সৈকত   বারিবিন্দু সম

সুত-মিত-রমণী-সমাজে

তোহে বিসরি মন    তাহে সমর্পিলু 

অব মঝু হব কোন কাজে।।


আলোচ্য পদটি বিদ্যাপতির প্রার্থনা বিষয়ক পদ। নিজের অন্তরের সহায়তায় তিনি একান্তভাবে মাধবের নিকট আত্মসমর্পণ করে গেছেন। অপর কোনও বৈষ্ণুব কবির পক্ষে এই দাস্যভাবের উপাসনা সম্ভব নয়। প্রার্থনা পদে বিদ্যাপতির কৃতিত্ব সর্বাধিক। ব্যক্তি জীবনে তিনি পঞ্চোপাসক ছিলেন বলে বৈষ্ণুব ধারায় তিনি ভক্ত ছিলেন না কিন্তু কৃষ্ণকে আদি অবসানহীন সর্বশক্তি কল্পনা করে তাঁর কাছে নিজ তাপিত হৃদয়ের অনুশোচনা অকৃত্রিম মনোভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন। তাঁর

“মাধব বাহুত মিনতি করি তোয় 

দেই তুলসী তিল    এ দেহ সমার্পিলু

দয়া জনু ছোড়বি মোয়।”


পদটিতে কবি শুধু আত্মসমর্পণই করেননি, কৃতকর্মের জন্যে অনুশোচনাও জানিয়েছেন এবং অচিন্ত্য জগৎ সংসার থেকে পরিত্রাণ পাবার আকৃতিও ব্যক্ত করেছেন।


বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রার্থনা পর্যায়ের পদের গুরুত্ব অপরিসীম। যে ভক্ত ভগবানের সংকেতে সাড়া না দিয়ে নিজেকে ভগবানমুখী না করে জাগতিক বিলাস ব্যসনে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন তাঁর তাপিত হৃদয় প্রার্থনাতে বসে শান্তিলাভ করে। এখানে ভক্ত মার্গের স্বরূপটি প্রতিফলিত হয়েছে। দ্বিতীয় যে ক্ষেত্রে প্রার্থনার গুরুত্বটি বৈষ্ণব পদাবলীর ক্ষেত্রে বড়ো কথা হয়ে ওঠে সেটি হল, প্রার্থনা পর্যায়েই সরাসরি বৈষ্ণব কবিদের আকুতি চিত্রিত হয়েছে।


সাধারণভাবে মধুর রসের সাধনায় ‘প্রার্থনা'র যেমন কোনও স্থান নেই ঠিক তেমনিই ‘নিবেদন’ পর্যায়টিও সরাসরি মধুর রসের সাধনার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এখানে মূলত কৃষ্ণের প্রতি রাধার কিছুক্ষেত্রে রাধার প্রতি কৃষ্ণের আত্মনিবেদন এর প্রক্রিয়াটি সাধিত হয়েছে। যদিও এই নিবেদনের রূপকে মূলত বৈষ্ণব কবিদেরই অন্তরের ইচ্ছাটিই ভগবানের উদ্দেশে নিবেদিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে রাধা হয়ে উঠেছে কবিদের তাপিত ও কাঙ্খিত হৃদয়ের নিবেদনের মাধ্যম।


এই প্রেক্ষিতে প্রার্থনাও নিবেদনের মধ্যে কিছু পরিমাণে সাযুজ্য প্রদর্শিত হয়। এক্ষেত্রে ভগবানের সঙ্গে ভক্ত কোনরূপ আত্মীয়তা করতে পারেন না। বরং ভক্ত বিষয় বাসনা পরিত্যাগ করে ঐশ্বর্যশালী পরম পুরুষের শ্রী চরণে আত্মসমর্পণ করেন প্রার্থনা ও নিবেদনের পদে এটাই সর্বাধিক তাৎপর্য।


বিদ্যাপতির ‘প্রার্থনা’ শিরোনামমণ্ডিত পদগুলির অনুরূপ ভাবযুক্ত নিবেদন পর্যায়য়ের পদগুলি। উভয়ের মধ্যে আত্মনিবেদন ভাবটির সাদৃশ্য থাকলেও একটি মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান— প্রার্থনা পদে আত্মনিবেদন করেছেন স্বয়ং কবি বিদ্যাপতি। এতে কবির কাতর ভক্তি ধ্বনিত হয়েছে। কিন্তু নিবেদনের পদগুলিতে আত্মনিবেদন করছেন স্বয়ং শ্রীমতি রাধিকা, কবি সেখানে অন্তরালেই রয়ে গেছেন। নিবেদন জাতীয় পদ রচনায় চণ্ডীদাসের সার্থকতা এবং শ্রেষ্ঠত্ব অবিসংবাদিত। 'বধু কি আর বলিব আমি'—শীর্ষক পদটিতে চিররঞ্জিত কৃষ্ণের কাছে রাধিকার যে আত্মনিবেদন তা সদার্থে চণ্ডীদাসেরই আত্মনিবেদন-

"তোমার চরণে   আমার পরাণে

বাঁধিল প্রেমের ফাঁসি।

সব সমর্পিয়া   একমনই হৈয়া

নিশ্চয় হইলাম দাসী।”


রাধা জীবনে মরণে জন্ম-জন্মান্তরে কৃষ্মকে প্রাণনাথ হিসাবে চান। এ ত্রিভুবনে তাঁর আপন বলতে আর কেউ নেই তাই তিনি কৃষ্ণ পদেই সর্বস্ব নিবেদন করছেন। কৃষ্ণ বিনা তাঁর অন্য গতি নেই। সে জন্যই কুলশীল, জাতি, দেহ, প্রাণ, মন সমস্ত কিছুই কৃষ্ণপদে নিবেদন করে নিশ্চিন্ত হতে চান

বঁধু তুমি যে আমার প্রাণ।

দেহ মন আদি   তোহারে সঁপেছি

কুলশীল জাতি মান৷”


জ্ঞানদাসের পদে রাধার কৃষ্ণের প্রতি আত্মনিবেদনের ভাবটি চমৎকার প্রকাশ লাভ করেছে–

“বঁধু তোমার গরবে    গরবিনী আমি

রূপসী তোমার রূপে।

হেন মনে করি    ও দুটি চরণ 

সদা লইয়া রাখি বুকে।।”


আসলে প্রার্থনা ও নিবেদন পর্যায়ের পদরচনা করতে বসে কী চণ্ডীদাস, কী জ্ঞানদাস আর কী বিদ্যাপতি, একদিকে যেমন ভক্তি বিনম্র বৈষ্ণবোচিত একাত্মতা দেখিয়েছেন—অপরদিকে তেমনি সেই ভক্তি প্রাণতাকে রস কাব্যের জগতে উন্নীত করিয়েছেন। ফলে এই পর্যায়ের পদগুলি লেখনী বলে বাংলা সাহিত্যের অক্ষয় সম্পদে পরিণত হয়েছে।