মনস্তত্ত্ব প্রধান ছোটগল্প হিসেবে 'ল্যাবরেটরি' কতটা সার্থক হয়ে উঠেছে সে বিষয়ে আলোচনা করো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তিনসঙ্গী' গ্রন্থের শেষ গল্প হল 'ল্যাবরেটরি'। এটি আনন্দবাজার পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় ১৩৪৭ সালে ১৫ আশ্বিন প্রকাশিত হয়। অনেক সমালোচক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন যে, তাঁর সাহিত্যে আধুনিক জীবনের প্রখর বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়নি। কিন্তু আমাদের আলোচ্য ‘তিনসঙ্গী’র তিনটি গল্পেই তিনি প্রখর আধুনিকতার নিদর্শন রেখেছেন। তিনি এখানে বিষয়গত, চরিত্রগত এবং আঙ্গিকগত সমস্ত দিক থেকেই আধুনিকতার উপস্থাপন ঘটিয়েছেন। 'ল্যাবরেটরি' গল্পে সোহিনী চরিত্রের মধ্যে আমরা বিশেষভাবে আধুনিকতার ছাপ দেখি। তবে লেখকের মনে হয়েছিল 'সোহিনীকে সকলে হয়তো বুঝতে পারবে না, সে একেবারে এখনকার যুগের সাদায়-কালোয় মিশানো খংাটি রিয়ালিজম, অথচ তলায় অন্তঃসলিলার মতো আইডিয়ালিজম্‌ই হলো সোহিনীর প্রকৃত স্বরূপ। গল্পে সোহিনীর মনস্তাত্ত্বিকতারই উদ্ঘাটন রয়েছে সমগ্র কাহিনি জুড়ে।


রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে মনস্তাত্ত্বিকতার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ব্যক্তিসত্তার মগ্নচৈতন্যের গভীরে প্রবষ্টি হয়ে মানসিক বিবর্তনের ইতিবৃত্তের রচনা তাঁর মনস্তাত্ত্বিক গল্প ও উপন্যাসে স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়েছে। একে কেউ কেউ বলেছেন exploration of the individual personality. অর্থাৎ ব্যক্তি স্বভাবের বিস্ফোরণ। আসলে কথাসাহিত্যিকরা মানবমনের বিচিত্র অলিগলিতে পথ পরিক্রমা করেন। শুধু তাই নয় সেখান থেকে তাঁরা মানব মনের মর্মগত স্বরূপটিকেও চয়ন করেন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাই আমাদের সর্বাগ্রে মনে আসে। তিনি তাঁর ‘ল্যাবরেটরি’ ছোটগল্পে মনস্তাত্ত্বিকতাকে তীক্ষ্ণ ও তির্যকভাবে ব্যক্ত করেছেন।


‘ল্যাবরেটরি' গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র সোহিনী। উক্ত গলে তাকে আমরা জননী বা জায়া রূপে দেখিনা, তার মধ্যে এই দুয়ের কোন আদর্শই নেই। লেখক তাকে কেবল নারী হিসাবেই অঙ্কন করেছেন, যে নিজের অন্তর্দ্বন্দ্বকে প্রশ্রয় দেয়নি। নন্দকিশোরের সঙ্গে এই সোহিনীর যখন প্রথম পরিচয় ঘটে তখন তার মধ্যে নন্দকিশোর দেখতে পেয়েছিল ‘ক্যারেকটারের তেজ’। শুধু তাই নয় সে এও বুজে ছিল যে সোহিনী 'নিজের দাম নিজে জানে তাতে একটুমাত্র সংশয় নেই। আসলে সোহিনী তার অন্তরের অবিচল দৃঢ়তায় নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। সে কোনও দিনই সমাজের নিয়ম মানে নি। তাই তার আত্মসমীক্ষায় কোনও দ্বন্দ্ব নেই।


নন্দকিশোর সোহিনীকে যে দশা থেকে এনেছিল সেটা খুব নির্মল নয় এবং নিভৃত নয়। অর্থাৎ সোহিনীর পারিবারিক ইতিহাস অস্বচ্ছ, সে কেবল পতিতাই নয়, বহু পরিচর্যাকারিণীও ছিল। ‘খুব মিল নয়’ আর ‘নিভৃত নয়' এর মাঝখানে সোহিনীর নির্মলতার অভাব অপেক্ষা নিভৃতিরই অভাবকে বেশি বড়ো করে তুলে ধরেছে। লেখক সোহিনীকে চিত্তধর্মে নন্দকিশোরের অনুব্রতা করেছেন, আর প্রাণধর্মে সে স্বৈরিণী। সতীত্ত্বের সুপ্রাচীন সংস্কারকে অস্বীকার করতে তার বাধে না। তাই তো সে অলজ্জ ও অসংকোচে বলতে পেরেছে—'আজন্ম তপস্বিনী নই আমরা। ভড়ং করতে করতে প্রাণ বেরিয়ে গেল মেয়েদের। দ্রৌপদী কুন্তীদের সেজে বসতে হয় সীতাসাবিত্রী'। এই কৃত্রিমতার বন্ধনকে সে কোনও দিনই স্বীকার করেনি।তাই নিঃসস্কোচেই তাকে আমরা অধ্যাপক মন্মথ চৌধুরীকে চুম্বন করতে দেখি। যখন এই চুম্বনকেই কেন্দ্র করে মন্মথ বলেছে—'ঐরে সর্বনাশের শুরু হল দেখছি' তখন সোহিনী অবিচলিতভাবেই বলেছে— সে ভয় যদি একটু থাকত তাহলে কাছে এণ্ডতাম না।'


নন্দকিশোর সম্পর্কে সোহিনী অধ্যাপককে বলেছে—'তিনি সবার পথে তাঁর চিতার আগুনে আমার আসক্তিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন, জমা পাপ একে একে জ্বলে যাচ্ছে। এই ল্যাবরেটরিতেই জ্বলছে সেই হোমের আগুন।” এই ল্যাবরেটরির স্বার্থেই নারীর মোহজাল বিস্তার করতেও সে পিছপা হয়নি। সে অধ্যাপককে আরও বলেছে—“সেখানে আমি ছিলেন ছোটো সেখানে আমি তাঁর চোখে পড়িনি, যেখানে আমি ছিলুম বড়ো সেখানে তিনি আমাকে পুরো সম্মান দিয়েছেন।”আসলে তার সঙ্গে নন্দকিশোরে ব্রতের নিলে জীবসত্তাটি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে। নন্দকিশোরের মৃত্যুর পর সোহিনী ল্যাবরেটরির যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসাবে মন্মথ চৌধুরীর দ্বারা পায় রেবতী ভট্টাচার্যকে। কিন্তু রেবতীর ভাগ্যাকাশ জুড়ে আছেন ‘স্ত্রীরাহু’—তিনি হলেন তার পিসিমা।


রেবতীকে পিসিমার কবল থেকে বাঁচাতে গিয়ে সোহিনী তার মেয়ে নীলাকে কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু যখন দেখেছে স্বয়ং নীলাই রেবতীকে ব্যবহার করতে শুরু করেছেন তখন সে মেয়ের সঙ্গেই সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। তাই সে আম্বালাতে আইমাকে দেখতে যাওয়ার সময় মেয়েকে উন্মুক্ত ছুরি দেখিয়ে বলেছে—'ফিরে এসে যদি হিসাব নেবার হয়তো নেব। আম্বালা থেকে ফিরে এসে যে হিসাবও নিয়েছে। তার হিসাবের খাতা থেকে সে তার একমাত্র সন্তান নীলাকে ত্যাগ করেছে। নীলা যখন তার কাছে পিতার সম্পত্তি দাবী করে, তখন সোহিনী তাকে সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে যে,—কে তোর বাপ’...একথা মুখে আনতে তোর লজ্জা হয় না। কিন্তু এ লজ্জা সোহিনীরই হওয়ার কথা। আসলে এই লজ্জা, সংকোচ এসমস্ত কিছুকে সে কোনও দিনই মনের মধ্যে স্থান দেয়নি। অবশেষে যে রেবতী কে নিয়ে নীলাও সোহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব বেঁধে ছিল তা পিসিমার আগমনে রেবতীর সুড় সুড় করে চলে যাওয়ার মধ্য দিয়েই নিষ্পন্ন হল।


মানুষের স্বভাব-বিশ্লেষণে সোহিনীর দক্ষতা ছিল। অপ্রিয় সত্যকথা বলতে সে কোনদিন পিছপা হয়নি। দেহেরটানে মুগ্ধ স্তাবকদের সন্তুষ্ট এবং ল্যাবরেটরিতে প্রজ্জ্বলিত হোমের আগুন তার সমস্ত পাপকে স্খালন করে দিয়েছে। নীলা যে নন্দ কিশোরের মেয়ে নয় একথা নন্দকিশোর জানত। কিন্তু তার এতে বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না। এইভাবে রবীন্দ্রনাথ কাহিনির ভিন্ন ভিন্ন স্তরে, ছোট ছোট ঘটনাবৃত্তের সমাহারে সোহিনীর চরিত্রে অন্তলীন স্বভাবটি প্রকাশিত করেছেন। তিনি নীলার আচরণের মধ্যে দিয়ে আদিম কামনা বাসনার অতি আধুনিক বেপরোয়া মনোবৃত্তির স্ফুরণ ঘটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ মানুষের মনোজগৎ ও অন্তগূঢ় সত্তার ছবি আঁকতে গিয়ে অনেক সময় ঘটনা নির্ভর অবজেকটিভ রীতির আশ্রয় নিয়েছেন। ছোটগল্পে ব্যক্তিচরিত্রেই এই inner reality প্রকাশ করার দায়িত্ব ছোটগল্পকার রবীন্দ্রনাথ 'ল্যাবরেটরি' গল্পে দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। আর সেই জন্যই মনস্তত্ত্ব প্রধান ছোটগল্প হিসাবে 'ল্যাবরেটরি' গল্পটি সার্থকতা লাভ করেছে।