পয়লানম্বর’ গল্পটি অধ্যায়নরত কাণ্ডজ্ঞানহীন এক ব্যক্তি ও তাঁর অনাদৃত তরুণী পত্নীর কাহিনি—আলোচনা করো।

‘পয়লানম্বর’ গল্পের বড়ো সম্পদ আপাতদৃষ্টিতে দাম্পত্য সম্বন্ধের বিশ্লেষণ ছাড়া কিছু নয়- বিশ্লেষণ করো।

‘সবুজ পত্র' পত্রিকায় ১৩২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘পয়লানম্বর’ গল্পটি আদপে একটি দাম্পত্য সম্পর্কের কাহিনি। বিভিন্ন সম্পর্কের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক খুবই সমস্যা জর্জরিত। স্বামী ও স্ত্রীর এই সম্পর্কের গভীরতা মাপার মানদণ্ড না থাকলেও তা মাপার প্রচেষ্টা উভয় তরফেরই থাকে। আর সমস্যা আসে সেখান থেকেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয় স্বামী কিংবা স্ত্রীর আচার-আচরণের বিষয়টিও। রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু গল্পে দাম্পত্য সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে বেশ কাটা ছেঁড়া করেছেন। ‘পয়লানম্বর' গল্পটিও এর ব্যতিক্রম নয়। লক্ষণীয় বিষয় তাঁর গল্পের নারী কিংবা পুরুষ সবাই আধুনিকবোধে জাগ্রত। ফলত একে অপরের দুর্বলতা সম্পর্কে প্রতিবাদী। সে প্রতিবাদ অনেকক্ষেত্রে বাচনিক না হলেও নীরব এবং ভয়ঙ্করী।


পয়লা নম্বর গল্পের অদ্বৈতচরণ ও অনিলার সুস্থ দাম্পত্য সম্পর্কের অন্তরায় অদ্বৈতচরণের গ্রন্থ থেকে আহরণ করা জ্ঞানের চর্চা। অবশ্য সেই জ্ঞানচর্চা প্রথামাফিক-এর বাইরে, এজন্য অদ্বৈতচরণ বলতেই পারেন—

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘড়ায় বিদ্যার তোলা জলে আমার স্নান নয়', এটা সাধুবাদযোগ্য হলেও তা দাম্পত্য সম্পর্কে রসের উসোর ঘটায় না। স্ত্রীকে মর্যাদা দেওয়া, তাকে সময় দেওয়া ইত্যাদি সামান্য ব্যাপারই এক্ষেত্রে যথেষ্ট। অদ্বৈত্যচরণ এক্ষেত্রে খুবই ব্যর্থ। কিন্তু ‘সংসারে অধিকাংশ বড়ো বড়ো জীবননাট্য যবনিকার আড়ালেই জমতে থাকে সেখানে কারও জয় কারও পরাজয়।


অদ্বৈতচরণের দ্বৈতাদ্বৈত সভা শুধুমাত্র জ্ঞানের ও বৌদ্ধিক চর্চার কেন্দ্র। সেখানে রসহীনতাই হয়তো অদ্বৈতচরণের মন থেকে সব রসই টেনে নিয়েছিল। তাই স্ত্রীর সুখের দিকে নজর দেওয়ার সময় তিনি পাননি। অনিয়মটাকেই নিয়ম করে নেওয়া অদ্বৈতচরণ সবকিছুকেই টেনিসন মেটেরলিঙ্কের ছাঁচে ভাবতে চেয়েছে। সংসারে আবেগের মর্যাদাকে গুরুত্ব দেয়নি। প্রথম দিকে স্ত্রীর সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনা করতে থাকা অদ্বৈতচরণ দ্বৈতাদ্বৈত সম্প্রদায় বিলীন হয়ে গেল। স্ত্রী জ্ঞানালাপ বঞ্চিত হলেন। রসালাপ দূর অন্ত, জ্ঞানালাপ ও নেই। অনিলা একাকী হয়ে পড়লেন।


সংসারে অনিলার যা কাজ ছিল তা হল ছোটো ভাই সরোজের পড়াশোনার দায়িত্ব ও দ্বৈতাদ্বৈত সম্প্রদায়ের রসনার পরিতৃপ্তি ঘটানো। স্বামীর নিরাসক্ত আচরণের জন্য তার কোনো অভিযোগ ছিল না। মনে মনে স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেও বিশ্বাসের স্থানটা সংকুচিত হচ্ছিল। তাই ভাই সরোজের পড়াশোনার দায় নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নিতে চাইলেও অনিলা তা সমর্থন করেনি, বুঝেছে স্বামীকে দিয়ে কোনো নিয়মমাফিক কাজ চলতে পারে না, যার কাছে অনিয়মটাই নিয়ম। এই অনিলাই শেষে দেখি সীতাংশু মৌলির প্রতি দুর্বল হয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে একটা কথা মিলে যায় তা হল, অনিলা বলছে ‘পাশের বাড়িতে একটা উৎপাত জুটেছে; এখন এখান থেকে অন্য কোনো বাসায় গেলেই তো ভালো হয়। অর্থাৎ অদ্বৈতচরণের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ককে স্বীকার করে অনিলা চলেই যেতে চেয়েছিল। অবশেষে সে গেল যখন কোনোকিছু সিদ্ধান্ত আর গ্রহণ করতে পারল না।


অদ্বৈত ও অনিলার দাম্পত্য সম্পর্কের এই দুর্বল প্রেক্ষাপটে সীতাংশু মৌলির আগমনে অদ্বৈত সম্বিত ফিরে পেয়েছে, তাও সবশেষ হয়ে যাওয়ার পর। অদ্বৈত শুধুমাত্র জ্ঞান-বিদ্যা বকুনি নিয়ে থেকে অদ্বৈতচরণের ঔদ্ধত সহ্য করতে না পারলেও অদ্বৈতচরণকে দেখেই তার মন দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে পয়লানম্বর বাড়িটিই লেখকের জীবনে বিষাদ বহন করে এনেছে।


গল্পের মূল সারবস্তু বিশ্লেষণ করলে আমাদের সহজেই নজরে পড়ে যে এই গল্পে মূল সমস্যা দাম্পত্য সম্পর্ক কেন্দ্রিক। এবং তা এসেছে অধ্যায়নরত এক নিস্পৃহ ব্যক্তির সঙ্গে অনাদৃত এক তরুণী পত্নীর চাওয়া পাওয়ার সংঘাত থেকে। সীতাংশু মৌলি চরিত্রটিও গল্পটির মাঝখানে এসে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। সব মিলিয়ে লেখক এই গল্পে নারী-পুরুষের সম্পর্কের মূল সূত্রটিকে চিনিয়ে দিতে চেয়েছেন।