গদ্যের সূচনা ও বিকাশপর্ব : মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার (১৭৬২ খ্রীঃ-১৮১৯ খ্ৰীঃ)

মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার জন্ম ও কর্মজীবন :


প্রয়োজনের নিয়মে বন্দী ফোর্ট উইলিয়ম কলেজগোষ্ঠীর লেখক তালিকায় মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের নামটি নিঃসন্দেহে চোখে পড়ার মত। তাঁর সৃষ্টি যথার্থ বিচারে ‘মৃত্যুঞ্জয় কিনা সে সম্বন্ধে সংশয় যদিও বা জাগে, তবু, বাংলা গদ্য ক্ষেত্রে তাঁর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যটুকু অবশ্যই স্মরণীয়। তাই শুধু এযুগের সাহিত্যের ঐতিহাসিকের কাছেই নয়, সেইযুগেও বিদেশীর কাছে সর্বাধিক এবং সুপণ্ডিত গ্রন্থকাররূপে তিনি অভিনন্দিত হয়েছিলেন। মেদিনীপুরে বঙ্গ-উড়িষ্যার সীমান্তে তাঁর জন্ম হয়। কৌলিক উপাধি ছিল 'চট্টোপাধ্যায়। তিনি বাংলা এবং ওড়িয়া দুই ভাষা মাতৃভাষার মত আয়ত্ত করেছিলেন। তবে সংস্কৃতে পাণ্ডিত্যের জন্যই ‘বিদ্যালঙ্কার’ উপাধি পান। ১৮০১ খ্রীস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে যোগ দেন। সুদীর্ঘ আঠারো বছর এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এছাড়া কিছুকাল কোম্পানীর ‘জজ পণ্ডিত’ পদে থেকে সংস্কৃত থেকে বাংলায় আইন ব্যাখ্যার দায়িত্বশীল কাজে যুক্ত হন। এই সময় সত্যবাদী স্পষ্টবক্তা মৃত্যুঞ্জয় রামমোহনের বিরোধীপক্ষ হয়েও সতীদাহ শাস্ত্রানুমোদিত কোন প্রথা নয় এবং তা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত এই অভিমত প্রকাশ করেন।


বস্তুতঃ, একরকম তার অভিমতের উপর বিশ্বাস করেই ইংরেজ শাসকপক্ষ সতীদাহ সামাজিক প্রথা বুঝে আইনানুগ পদ্ধতিতে তা বন্ধের জন্য সচেষ্ট হন। এই কাজ নিঃসন্দেহে মৃত্যুঞ্জয়কে বাংলার সমাজ-ইতিহাসে উদারনৈতিক ও মানবিক ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করে।


মৃত্যুঞ্জয়ের পাঁচটি বইয়ের চারটি কলেজের জন্য লেখা হয়। এই চারখানিই আদর্শ পাঠ্যপুস্তক। কেবল বিদেশী শিক্ষার্থী নয়, দীর্ঘদিন ধরে বাঙালী ছাত্ররাও ছিলেন তাঁর কাছে ঋণী, এমন কি, পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর একখানি বই ‘প্রবোধচন্দ্রিকা কে পাঠ্য তালিকাভুক্ত করে তার গ্রন্থ মুদ্রণের (১৮৬২) উপযোগিতা পর্যন্ত অনুভব করেছিলেন। স্বনাম-চিহ্নিত মৃত্যুঞ্জয়ের গ্রন্থগুলি হল— ‘বত্রিশ সিংহাসন’ (১৮০২), 'হিতোপদেশ’ (১৮০৮), ‘রাজাবলী’ (১৮০৮), “প্রবোধ-চন্দ্রিকা’র (রচনাকাল–আনুমানিক ১৮১৩, মৃত্যুর পরে প্রকাশিত, ১৮৩৩) তাঁর শেষোক্ত গ্রন্থ ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’র (১৮১৭) বিষয় শাস্ত্রবিচার, কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যধর্মী, রামমোহন রায় প্রবর্তিত ধর্মসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন। কিন্তু লেখকের নামহীন এই গ্রন্থটি যথার্থই তাঁর রচনা কিনা সে সম্বন্ধে ঐতিহাসিকরা সংশয়াচ্ছন্ন। 'সাংখ্যভাষা সংগ্ৰহ মৃত্যুঞ্জয়ের পুত্র রামজয় তর্কালঙ্কারের নামে প্রচারিত হলেও সেখানে মৃত্যুঞ্জয়ের রচনাই ছিল সংখ্যায় বেশি।


মৃত্যুঞ্জয়ের প্রথম গ্রন্থ 'বত্রিশ সিংহাসন' সংস্কৃত 'দ্বাত্রিংশৎ পুত্তলিকা'র অনুবাদ। রচনারীতির কুশলতা এখানে নেই, বরং মূলের অত্যধিক অনুসরণের জন্য গদ্য অনেক জায়গায় কষ্টপাঠ্য। প্রকৃতপক্ষে, এখান থেকেই বহুল প্রচারিত বিক্রমাদিত্য উপকথার সূত্রপাত। এই বাংলা সংস্করণ বিদেশীর কাছে তার উপকথার জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। এর অনেকগুলি ইংরেজী সংস্করণ শ্রীরামপুর, লন্ডন এবং প্যারি নগরী থেকে ফরাসী অনুবাদও প্রচারিত হয়। ইংরেজী গদ্যকাহিনীর ইতিহাসে ম্যালরির 'Morte Darthur'-এর যে গুরুত্ব, বাংলা গদ্যকাহিনীর ইতিহাসেও বলা যায় এই বইয়ের ভূমিকা প্রায় তদনুরূপ। আবার বিদ্যাসাগরের প্রথম প্রকাশিত বই 'বেতাল পঞ্চবিংশতি'র ভাবী রূপচিত্রটিও এখানে ধরা পড়েছে।


মৃত্যুঞ্জয়ের ‘হিতোপদেশ’ বইটিও সংস্কৃত থেকে অনুবাদ। বাংলাদেশে সংস্কৃত শিক্ষার্থীর পাঠ্যরূপে বইটির অনেকদিন ধরেই সমাদর ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলায়। কয়েকটি পদ্যানুবাদও দেখা যায়। বিশ বছর আগে চার্লস্ উইলকিন্স এই গ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদ করেন। তবু ফোর্ট উলিয়ম কলেজের পাঠ্যরূপে নির্বাচিত হওয়া এবং মৃত্যুঞ্জয়ের অনুবাদের পর এর গুরুত্ব আরো বাড়ে বলে মনে হয়। এক ফোর্ট উইলিয়ম গ্রন্থমালার মধ্যেই তিনখানি ‘হিতোপদেশে’র অনুবাদ পাওয়া যায়। ১৮৪০-এর মধ্যে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় অন্তত দশটি।


তার ‘রাজাবলী' বইটি ইতিহাস, গ্রন্থনামের মধ্যেই তার পরিচয় আভাসিত  :“রাজাবলী। অর্থাৎ কলির প্রারম্ভ হইতে ইংরাজের অধিকার পর্যন্ত ভারতবর্ষের রাজা ও সম্রাটদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস”। বিষয়বস্তুর মৌলিকত্ব সন্দেহাতীত নয়। রমেশচন্দ্র মজুমদার এই বইয়ের আদর্শ হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুঁথিশালার অন্তর্ভুক্ত সংস্কৃত ‘রাজাবলী’ গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। তুলনামূলক বিচারে রামরাম বসুর 'লিপিমালা’য় পৌরাণিক কাহিনীর ছলে অথবা কেরীর ইতিহাসমালা’য় ইতিহাসের মত গল্প বলার ছন্দরীতির আশ্রয় অবশ্য লক্ষ্য করা যায়, এর পৌরাণিক অংশে। কিন্তু মুসলমান যুগ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনকাল পর্যন্ত ঘটনা ঐতিহাসিকের নিঃস্পৃহ ভাবদৃষ্টি ও অনুত্তেজিতভাবে বিবৃত হয়েছে। অনতি-পূর্ববর্তী লেখক রাজীবলোচনের ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং' গ্রন্থে ইংরেজ জয়ের যেখানে উল্লাস, সেখানে মৃত্যুঞ্জয়ের অতি সংক্ষেপে এবং নিরাসক্তভাবে সিরাজের পরাজয় বর্ণনা রীতিমত অভিনন্দনযোগ্য। এই ইতিহাস-নামাঙ্কিত কাহিনীর মধ্যেও সন-তারিখের যথার্থ্যের দিকে দৃষ্টিদান, দেশের ইতিহাস সম্বন্ধে পাঠকদের কৌতূহল জাগানোর চেষ্টা, রচনার মধ্যে অনুভব করা যায়।


মৃত্যুঞ্জয়ের বিদ্যার অলঙ্কারে উজ্জ্বল তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’। এর বিষয়বস্তু, সংস্কৃতবিদ্যার সংক্ষিপ্ত পরিচয়। অর্থাৎ সংস্কৃত ব্যাকরণ-অলঙ্কার-স্মৃতি-ব্যবহার নীতিশাস্ত্রের পরিচয়দান। কিন্তু এখানেই গ্রন্থখানির গুরুত্ব নিঃশেষিত নয়, আছে কৃষাণীর মর্মান্তিক দুঃখের হৃদয়স্পর্শী বর্ণনাঃ “মোরা চাষ করিব ফসল পাবো রাজার রাজত্ব দিয়া যা থাকে তাহাতেই বছর শুদ্ধ অন্ন করিয়া খাব ছেলেপিলেগুলিকে পুষিব .... শাকভাত পেট ভরিয়া যেদিন খাই সেদিন তো জন্মতিথি”, আছে বিশ্ববঞ্চক উপাখ্যানে' চরিত্রের উপযোগী শ্যাঙ-বাংলার ব্যবহার যেমন: ঠক কহিল, “এক ছোঁড়াকে ভুলাইয়া বন্ধক দিয়া মুদিশালাকে ঠকিয়া আনিলাম।” ইহা শুনিয়া তৎপিতা কহিল, “হ্যা মোর বাছা, এই তো বটে। না হবে কেন? আমার পুত্র ভাল করিয়া অন্ন খাইতে পারিবে।”


মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার গদ্যরীতি :

বাংলা গদ্যের প্রাথমিক অবস্থায় মৃত্যুঞ্জয়ের গদ্য-ভাবনার লক্ষ্য করা যায় কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য


(১) তার রচনায় আছে অন্তত তিনটি বিভিন্ন ধরনের বাংলা রচনারীতিকথ্য, সাধু ও সংস্কৃতানুগ। বাংলা গদ্যভাষার দুই রীতি—সরল ও অলঙ্কৃত পদ্ধতির প্রথম আদর্শ তার লেখনীতে প্রকাশিত। হয়ত দ্বিধাময়, তবু অনুপেক্ষণীয়। স্বয়ং প্রমথ চৌধুরী পর্যন্ত তাই একথা স্বীকার করেছেন যে, “তিনি একদিকে যেমন সাধুভাষার আদি লেখক–অপর দিকে তিনি তেমনি চলতি ভাষারও আদর্শ লেখক”


(২) সিভিলিয়ানদের জন্য লেখা পাঠ্যবস্তুর প্রয়োজন সীমা ছাড়িয়ে জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে পৌঁছাবার সীমিত প্রচেষ্টা তাঁর মধ্যে দেখা গিয়েছিল। কবিতার অস্ত্যমিল বা সুরসৃষ্টির পূর্ব বিশ্বাস ছেড়ে আখ্যান উপাখ্যানে দৈনন্দিন শব্দ (হাঁড়ি-কুঁড়ী, খুদকুঁড়া, এক ছোঁড়া, মুদিশালা ইত্যাদি) ব্যবহার করে যুগঞ্জীবনকে স্পর্শ করার আগ্রহ দেখা যায়।


(৩) মানুষের প্রতি দরদী দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে চিত্তের পরিহাসময় মনোভঙ্গীর সমন্বয় তার রচনায় অনুভব করা যায়।


(৪) তিনি ফারসি-মোচন করে বাংলা ভাষায় সংস্কৃতের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠিত করার যথোচিত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কেরীর অনুসরণে সৃষ্ট বাংলায় ইংরেজী পদযোজনা রীতির প্রভাবকে এড়িয়ে সহজিয়া কড়চা পুঁথিগুলিতে বাংলাভাষার নিজস্ব যে স্বাভাবিক পদবিন্যাস ছিল, তাকে ব্যবহারের চেষ্টা দেখা যায়। পরবর্তী বাংলা গদ্যের স্বীকৃত অন্বয়রূপ মৃত্যুঞ্জয়ের গদ্যরীতির মধ্যেই প্রথম সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।