‘মুক্তধারা’ নাটকে যে দুই ভাব জগতের সংঘাতের কথা বর্ণিত আছে তা ব্যাখ্যা করো।

‘মুক্তধারা’ নাটকের সূচনাতেই দুটি ভাবকে রবীন্দ্রনাথ দুটি প্রতীকের সাহায্যে উপস্থাপিত করেছেন— “দূরে আকাশে একটা অভ্রভেদী লৌহ যন্ত্রের মাথাটা দেখা যাইতেছে এবং তাহার অপরদিকে ভৈরব মন্দির চূড়ার ত্রিশূল।...আজ অমাবস্যায় ভৈরবের আরতি।” চতুর্দিকের অন্ধকার যন্ত্রদানবের সৃষ্ট অন্ধকার। এই অন্ধকার প্রতীকী অন্ধকার। মানুষের মনেও সে অন্ধকার সৃষ্টি করেছে। শিবতরাই-এর মানুষ অজ্ঞানতা এবং অন্ধকারের অত্যাচারে নিমজ্জিত উত্তর কূটের মানুষের মনেও আলো অনুপস্থিত। সেখানে লোভ, হিংসা ইত্যাদি সীমাহীন অন্ধকার সৃষ্টি করেছে। আবার অন্ধকার গভীর না হলে ভৈরব জাগ্রত হন না। মানুষের মনে অন্ধকার ঘনীভূত হলে নবচিন্তার, নবচেতনার উন্মেষ ঘটে। মানুষ নবপ্রেরণায় উদ্বোধিত হয়।


যারা মূলকে দেখতে পায় না তারা যন্ত্রকে বড়ো করে বস্তুর বোঝা বাড়িয়ে তোলে। তখনই যন্ত্রস্ফীত হয়ে ভৈরবকে অতিক্রম করতে চায়। ভৈরবকে বেদীচ্যুত করার দম্ভ থেকেই সংঘাতের সৃষ্টি। সেই সংঘাত বোঝানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ অভ্রভেদী লৌহযন্ত্রের মাথাটার অপরদিকের মন্দিরচূড়ার ত্রিশূল স্থাপন করেই ক্ষান্ত হননি, যারা জগৎ ব্যাপারে মূলকে তুচ্ছ করে যন্ত্রের বোঝা সৃষ্টি করে, সংঘাতের পথ উন্মুক্ত করে, রবীন্দ্রনাথ তাদের দম্ভকেও স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন, এ নাটকে আছে—


“পথিক।। আকাশে ওটা কী গড়ে তুলেছে? দেখতে ভয় লাগে।

নাগরিক।। জান না? বিদেশি বুঝি ? ওটা যন্ত্র।

পথিক।।... ওটাকে অসুরের মাথার মতো দেখাচ্ছে, মাংস নেই, চোয়াল ঝোলা... দিনরাত্রির দেখতে দেখতে তোমাদের প্রাণপুরুষ যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে....মন্দিরের ওপরের আকাশে কখনও এমনতর বাধা দেখিনি।... ওইটের দিকে তাকিয়ে আজ আমার গা শিউরে উঠল... ওযে অমন করে মন্দিরের মাথা ছাড়িয়ে গেল এটা যেন স্পর্ধার মতো দেখাচ্ছে।”


অর্থাৎ, যন্ত্র মন্দির চূড়াকে অতিক্রম করার জন্যেই অসুরের ন্যায় দৃশ্যমান। যন্ত্র যখন যন্ত্রীকে অতিক্রম করতে চায়, বস্তুর ভোগ যখন আত্মার দৃষ্টিকে রুদ্ধ করতে চায় তখনই প্রকৃতির রূপ ভবিষ্যতের বিপদসংকেত বহন করে। বস্তুর মর্যাদা আত্মিক শক্তিকে অতিক্রম করলে অমঙ্গলের সম্ভাবনা অধিক। নাটকের মূল সংঘাতের সূত্রটি এখানেই নিহিত।


অন্যদিকে অম্বার সঙ্গে উত্তরকূটের নাগরিকদের সংলাপে ভৈরবের সঙ্গে যন্ত্রের সংঘাত স্পর্শভাবে প্রকাশিত। ভৈরবের মন্দিরে অম্বা যখন পূজা প্রদানে গমন করেছিল, তখন তার সন্তান সুমনকে বাঁধবাঁধার কাজে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মাতা যখন মন্দিরে সন্তানের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনায় রত, তখনই মানুষের দম্ভ দেবতার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সন্তানের জীবনে অভিশাপের অন্ধকারকে ঘনায়মান করেছে। রবীন্দ্রনাথ ভাব জগতের এই সংঘাতকে দক্ষ শিল্পীর ন্যায় রূপায়িত করেছেন। অবশ্য একথা ঠিক যে, প্রতীক, ঘটনা বা চরিত্র নাটকের গল্পের বিবর্তনে কোনো সাহায্যে করেনি। নাটকের গল্প যেক্ষেত্রে বিবর্তিত হয়েছে সেই ক্ষেত্র নাটকের অঙ্গীভূত হয়েছে। প্রতীক ইত্যাদি নাটকের নিষ্ক্রিয় অংশ। এই নিষ্ক্রিয় অংশের পটভূমিকাতেই নাটকের সক্রিয় অংশ ঘটনার বিবর্তনে পরিণাম অভিমুখী৷


শংকরের রুদ্রমূর্তিতে আবির্ভাবের সংকেত প্রদানের জন্য রবীন্দ্রনাথ বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে ভৈরবপন্থীদের মুখে সংগীত প্রদান করেছেন। এরফলে নাটকীয়তার সৃষ্টি হয়েছে। ভৈরব বন্দনা এবং যন্ত্র বন্দনা পরস্পর বিরোধী দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। বিভূতি যখন উচ্চারণ করে—“যন্ত্রের জোরে দেবতার পদ নিজেই নেব'—তখন সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, বিভূতির দস্ত চরমে উপনীত হয়েছে। অবশ্য বিভূতির দম্ভ চূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনাও তার আলোচ্য উক্তিতে প্রতিফলিত ভৈরবের সঙ্গে যন্ত্রের সংঘাতের অবশ্যম্ভাবী পরিণত স্বরূপ ভৈরব যে জয়লাভ করবে রবীন্দ্রনাথ ক্রমেই এই তথ্যটি উদ্‌ঘাটিত করেছেন। সুমনের প্রাণ বিসর্জনকে রণজিৎ দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন রূপে ঘোষণা করতে চান—“আমি জানি, পৃথিবীতে সকলের চেয়ে চরম যে দান— তোমার ছেলে আজ তাই পেয়েছে।” কিন্তু এই অর্থ নাটকে বিপরীতভাবে প্রকাশিত । আত্মবিসর্জন দিয়ে সে ভৈরবকে জাগিয়ে তুলেছে। অন্ধকার যখন ঘনীভূত হয়, বস্তু যখন অস্তরে জোরে চেপে বসে তখনইতো ভৈরব জাগেন একেই ভৈরবের আশীর্বাদ বলা চলে।


সুন্দরের বলির মাধ্যমে ভৈরব জাগ্রত হন। ভৈরব মন্দিরের পথে অপেক্ষা করলে, জাগ্রত ভৈরব সুমনকে অর্থাৎ সুন্দর মনকে, শুভঙ্করী চৈতন্যকে প্রত্যর্পণ করেন। তাইতো অম্বার প্রতীক্ষা—“ভৈরর মন্দিরের পথে পথে আমি তার জন্য অপেক্ষা করব।” অন্যদিকে, রণজিও যেন দ্বন্দ্বের পরিণতি সম্পর্কে ভীত। “দেখেছ ওর পিছন থেকে সূর্য যেন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছেন ? আর ওটাকে দানবের উদ্যত সৃষ্টির মতো দেখাচ্ছে। যারা অভিজিৎকে বন্ধনের বেদনা দিতে চেয়েছে, তারাও সচকিত হয়ে যন্ত্রের চূড়া তার ভৈরব মন্দিরের ত্রিশূলের প্রতি দৃষ্টিপাত করেছে।–“ভৈরব মন্দিরের ত্রিশূলটাকে সূর্যাস্তের আলো আঁকড়ে রয়েছে যেন ডোববার ভয়ে।”


আর, বিভূতি ব্যতীত সকলেই ত্রস্ত, শঙ্কিত। অভিজিতের আদর্শ আকাশে বাতাসে স্পন্দিত। তার আদর্শে প্রায় সকলেই উদ্বোধিত। কেবলমাত্র বিভূতি স্থির—তার সঙ্গেই অভিজিৎ ধনঞ্জয়ের প্রকৃত সংগ্রাম। নাটকের শেষাংশে সংঘাত চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত। সংঘাতকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে নাট্যকার কাহিনিকে দ্রুত পরিণতির দিকে নিয়ে গেছেন। যন্ত্রবাদের বিরোধী বটুর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে— “জাগো ভৈরব জাগো।” বটুর এই সংলাপ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়েছে। মর্মরিত প্রকৃতিকে এই আবেদন এমন আবেষ্টনী রচনা করেছে যে, কবির ভাব-কল্পনা যেন তীব্র গতিসম্পন্ন হয়েছে। বিভূতিকে চূড়ান্ত আঘাত হানার পূর্ব মুহূর্তে—“অন্ধকার হয়ে এলো, সব অন্ধকার হয়ে এলো।” দ্বন্দ্বের অবসানে নাটকের সমাপ্তিতে ভৈরবের জয় বিঘোষিত হল। সমস্ত অন্ধকারকে বিদূরিত করে আলোর ঝর্ণার প্রতিশ্রুতিতেই নাটকের অবসান ঘোষিত। এইভাবে রবীন্দ্রনাথ আলোচ্য নাটকে নাটকীয় সংঘাতটি অত্যন্ত সুকৌশলে সংকেতে প্রকাশিত করে নাট্যসংহতি বজায় রেখেছেন।