মুক্তধারা তাৎপর্য [মান–৫ নম্বর, শব্দ সংখ্যা – ১০০টি]

১। “ওটাকে অসুরের মতো দেখাচ্ছে, মাংস নেই, চোয়াল ঝোলা।”

উঃ উদ্ধৃত অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মুক্তধারা' নাটকের প্রথম অংশে কোনো এক পথিকের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে।

পার্বত্য প্রদেশ উত্তরকূটের উত্তর ভৈরব মন্দিরের অদূরেই প্রবহমান মুক্তধারা ঝর্ণার গতিকে রোধ করার জন্য যন্ত্ররাজ বিভূতি রাজা রণজিতের পরামর্শক্রমে অভ্রভেদী লৌহমন্ত্র প্রতিস্থাপিত করেছেন। উদ্দেশ্য এই মুক্তধারাকে বেঁধে ঝর্ণার জলে প্রবুদ্ধ শিবতরাই বাসীদেরকে নানান শোধন যন্ত্রে শোধন করে তাদের বশীভূত করা। বিভূতির এই অসামান্য কীর্তিকে পুরস্কৃত করার জন্য রাজা রণজিৎ উত্তর ভৈরব মন্দির প্রাঙ্গণে উত্তরকূটের সমস্ত লোকজনকে আমন্ত্রণ করে এনে এক উৎসব অনুষ্ঠিত করেন। ফলত সারাদিন ধরে যেখানে ভৈরবমন্ত্রে দীক্ষিত সন্ন্যাসীদল স্তবগান করে বেড়াচ্ছে কারও হাতে ধূপাধার, কারও হাতে শঙ্খ ঘণ্টা ইত্যাদি। এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসার পথে সাধারণের দৃষ্টি গিয়ে সহজেই নিক্ষিপ্ত হয় যন্ত্ররাজ বিভূতির লৌহ যন্ত্রের প্রতি। কারণ পূর্বে কখনও এমনটি তারা দেখেনি, তাই বিস্ময় প্রকাশ করতে যন্ত্রটির স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে পথিকের কণ্ঠে এমন বাক্যস্ফূরিত হয়েছে।

অনুরূপ : "ও যেমন করে মন্দিরের মাথা ছাড়িয়ে গেল এটা যেন স্পর্ধার মতো দেখাচ্ছে।”


২। “বালি পাথর—জলের ষড়যন্ত্র ভেদ করে মানুষের বুদ্ধি হবে জয়ী এই ছিল উদ্দেশ্য।” 

উঃ উদ্ধৃত অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মুক্তধারা' নাটকের প্রথম অংশে কোনো এক পথিকের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে।

উক্তিটি যন্ত্ররাজ বিভূতির।

নাট্যমধ্যে দুটি স্থানেই নাম উল্লেখিত হয়েছে—শিবতরাই আর উত্তরকূট। এই দুই স্থানের রাজা হলেন রণজিৎ। সাধারণের অজানা নয়, সর্বদা পাশাপাশি এই দুই স্থানের বিরোধ বিসম্বাদ লেগেই আছে। উত্তরকূটের রাজা রণজিতের লক্ষ্য শিবতরাই বাসীদের নিজ পদানত করে রাখা। কিন্তু ধার্মিক প্রজারা তা কখনও সম্ভব হতে দেননি। উপায়ান্তর না দেখে রাজা রণজিত কূট কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেন। সে মুক্তধারা ঝর্নার জলে শিবতরাইবাসী সারাজীবন প্রবুদ্ধ হয়ে আসে তা উত্তরকূটের ওপর দিয়ে বহমান। রণজিৎ ক্ষমতাবলে প্রজাদের সে পদানত করতে না পেরে জলের বিহনে তাদের অবদমিত করতে যন্ত্ররাজ বিভূতিকে দিয়ে বিরাট এক লৌহযন্ত্রের দ্বারা সেই ঝর্নাধারাকে অবরুদ্ধ করেন। এটা যে অসামান্য অশুভকীর্তি তা সর্বজন বিদিত। নিজের ক্ষমতা ও বুদ্ধিকে জাহির করতে উত্তরকূটের যুবরাজ অভিজিৎ কর্তৃক প্রেরিত দূতের নিকট বিভূতি এমন দম্ভের বাণী উচ্চারণ করেন।

অনুরূপ : “জলের বেগে আমার বাঁধ ভাঙে না, কান্নার জোরে আমার যন্ত্র টানে না।”


৩। “ভাঙনের যিনি দেবতা তিনি সবসময় বড়ো পথ দিয়ে চলাচল করেন না। তাঁর জন্যে যেসব ছিদ্রপথ থাকে সে কারও চোখে পড়ে না।” 

উঃ যুবরাজ অভিজিতের প্রেরিত দূত যন্ত্ররাজ বিভূতিকে এই উক্তি করেছে।

যন্ত্ররাজ বিভূতির অসামান্য কীর্তিকে স্বকর্নে জানাতে যুবরাজ অভিজিৎ দূতের মারফৎ বিভূতিকে নিজের অভিব্যক্তি জ্ঞাপন করেন। দূতকে কাছে পেয়ে যন্ত্ররাজ বিভূতি গর্বে ও অহংকারে আত্মহারা। কত দীর্ঘকাল ধরে মুক্তধারার ঝর্নাকে বাঁধবার জল কত না বিশেষজ্ঞা সময় অতিবাহিত করেছেন কিন্তু ঝর্নাকে বাঁধতে পারেননি। বারবার বাঁধ ভেঙে গেছে, কত লোক ধুলোবালি চাপা পড়েছে, কত লোক বন্যায় ভেসে গেছে তবুও তা রোধ করা সম্ভব হয়নি। আজ বিভূতি নিজ অভিজ্ঞতাবলে তা সম্ভব করেছেন। তাইতো তিনি নিজের বুদ্ধিকে নিজেই জাহির করছেন এবং ভবিষ্যতে এ বাঁধ যে ভাঙবার নয় তাও তিনি বলতে ভুললেন না। গর্বভরে জানালেন—“যন্ত্রের জোরে দেবতার পদ নিজেই নেব, এইকথা প্রমাণ করবার ভার আমার ওপর। যুবরাজ বোলো, আমার এই বাঁধ যন্ত্রের মুঠো একটুও আলগা করতে পারা যায় এমন পথ খোলা রাখিনি।” এর প্রত্যুত্তরে বিভূতিকে দেবতার স্বরূপ উপলব্ধি করতে দূত উপরিউক্ত উদ্ধৃতিটি প্রকাশ করে দেন। অর্থাৎ দেবতার চেয়ে কেউই বড়ো নয়।


৪। “নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র নমো যন্ত্র....।” 

উঃ এটি একটি সমবেত সংগীতের আদ্যকলি। উত্তরকূটের নাগরিকদের কণ্ঠে এই সংগীতটি ধ্বনিত হয়েছিল।

বহুদিনের প্রচেষ্টায় মুক্তধারা ঝর্নাকে বাঁধতে সচেষ্ট হয়েছেন যন্ত্ররাজ বিভূতি। উত্তরকূটের রাজা রণজিতের উদ্দেশ্য তিনি চরিতার্থ করতে এতদিনে সচেষ্ট হয়েছেন। এরজন্য উত্তরকূটের মন্দিরে এক উৎসবের আয়োজন করা হয়, যে উৎসবে বিভূতিকে জয়ধ্বনি দিয়ে সংবর্ধিত করা হবে। উৎসবের খবর পেয়ে সমগ্র উত্তরকূটের প্রজারা দলে দলে এসে ভৈরব মন্দিরে জড়ো হতে থাকে, কয়েকজন সাধারণ নাগরিকরা আসার পথে বাঁধ নির্মাণকারী বিভূতিকে আবিষ্কার করে আহ্লাদিত হয়ে তারা সমন্বয়ে তাঁর জয়ধ্বনি দিতে থাকে এবং সেই সাথে আলোচ্য সংগীতটি লৌহযন্ত্রকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে নাগরিকগণ গেয়ে ওঠে। শুধু কি তাই? বিভূতিকে কোলে নিয়ে নাচতে নাচতে গানটি গাইতে থাকে।


৫। “রাষ্ট্রনীতি আমাদের অস্ত্র, মানুষের মন নিয়ে আমাদের কারবার।” 

উঃ উত্তরকূটের রাজা রণজিতের উদ্দেশ্যে মন্ত্র এই উক্তি করেছেন।

রাজা রণজিৎ বহুদিন ধরেই লক্ষ্য করে আসছেন শিবতরাই এ প্রজারা বড়ো অবাধ্য। যথাসময়ে তারা খাজনা দেয় না। এমনই অবাধ্য রাজাকেও তারা মানতে চায় না। এই কারণে শিবতরাই-এ প্রজাদের প্রতি ক্রোধবশত রাজা নিজেই তাঁদের দমন-পীড়নের নীতি গ্রহণ করেন, কিন্তু তাতেও যখন সম্ভব হল না, তখন তিনি নান্দি সংকটের পথ অবরুদ্ধ করে শিবতরাই বাসীদের অনাহারে মারার উদ্যোগী হন। শুধু তাই নয়, যে মুক্তধারা ঝর্নার জলে শিবতরাই বাসীরা বেঁচে-বর্তে আছে তাও তিনি বাঁধ দিয়ে আটকাতে বহুদিন ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন। অবশেষে যন্ত্ররাজ বিভূতির দ্বারা যখন তা সম্ভব হল, রাজা রণজিৎ বিজয় গর্বে স্ফূরিত হয়ে এতে মন্ত্রীমশাই প্রীতি কিনা জানতে চাই তিনি এমন উক্তি করেন। অর্থাৎ রাজার পক্ষে সাধারণ মানুষকে কোনো শোষণ নয়, তাদের মনের কাছাকাছি আসতে চেষ্টা করতে হবে। তবেই শ্রেষ্ঠ রাজারূপে পরিগণিত হবে।


৬। রাজকার্যে ছোটোদের অবজ্ঞা করতে নেই.... যখন অসহ্য হয় তখন দুঃখের জোরে ছোটোরা বড়োদের ছাড়িয়ে বড়ো হয়ে ওঠে।

উঃ এ উক্তি মন্ত্রীমশাই-এর উত্তরকূটের রাজা রণজিতের উদ্দেশ্যে। 

দীর্ঘদিন ধরে রাজা রণজিৎ লক্ষ্য করে আসছেন শিবতরাই-এর প্রজারা ক্রমেই অবাধ্য হয়ে উঠছে, কোনো কিছুতেই যখন তাদের বশে আনা যাচ্ছে না, তখন তাদের ধনে প্রাণে মারার জন্য তিনি নন্দিসংকটের পথটি অবরুদ্ধ করেন এবং বহু প্রচেষ্টায় বিভূতির সহায়তায় মুক্তধারা ঝর্নার জল বাঁধতে সমর্থ হন, যে ঝর্নার জল শিবতরাইবাসীরা তাদরে দৈনন্দিন জীবনে পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করে। কিন্তু রাজার এই আচরণে মন্ত্রীমশাই ক্ষুব্ধ। অসহায় প্রজাদের ওপর রাজার এমন দমন-পীড়ন তিনি সহজ মনে মেনে নিতে পারেননি। তিনি রাজাকে সুমতি ফেরাতে বিজ্ঞের মতো বোঝাতে থাকেন ক্ষুদ্রকে সর্বদা তুচ্ছজ্ঞানে অবজ্ঞা করা ঠিক নয়, কারণ ক্ষুদ্ররা যদি একবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তাহলে বড়োদের পরাজয় অনিবার্য, এমনই এক পরিস্থিতিতে মন্ত্রীমশাই রাজাকে এমন উক্তি করেছেন।


৭। "প্রীতি দিয়ে পাওয়া যায় আপন লোককে, 

পরকে পাওয়া যায় ভয় জাগিয়ে রেখে।”

উঃ এই উক্তি স্বয়ং উত্তরকূটের রাজা রণজিতের। অবাধ্য শিবতরাইবাসীদের শাসন করতে তিনি যুবরাজ অভিজিৎকে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু মানবতার মূর্ত প্রতীক অভিজিতের সান্নিধ্য এসে উজ্জীবনের মন্ত্রে প্রবুদ্ধ হয়ে প্রজারা আরও অবাধ্য হয়ে ওঠে। ফলে রাজা অভিজিতকে শিবতরাই থেকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হল। অভিজিত কর্তৃক নান্দি সংকটের পথ আবার খোলা হলে তিনি ক্রুদ্ধ হন। পথটি বাঁধতে তিনি পুনরায় সচেষ্ট হন এবং পিপাসার জলবিহনে শিবতরাইবাসীদের মারতে মুক্তধারা ঝর্নার জনাকেও বিভূতির সহায়তায় লৌহযন্ত্রের দ্বারা বেঁধে ফেলেন। এই বিষয়টি মন্ত্রীর ভালো লাগেনি, মৃদু প্রতিবাদ জানাবেন রাজা এমনভাবে তাঁর মুক্তিকে প্রাধান্য দান করেন।


৮। “তঁর জন্ম রাজবাড়িতে নয়, তাঁকে মুক্তধারার ঝর্নাতলা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া গেছে।

উঃ এ উক্তি উত্তরকূট রাজ্যের মন্ত্রিমশাই এর। শিবতরাই-এর অবাধ্য প্রজাদের দমন করতে যুবরাজ অভিজিৎকে প্রেরণ করেন স্বয়ং রাজা, কিন্তু মানবতার প্রতিমূর্তি অভিজিৎ শিবতরাই বাসীদের শাসন করতে গিয়ে তিনি তাঁদের দুঃখ দারিদ্র্যের সঙ্গী হয়ে পড়েন এবং তাঁদেরকে সুখী করতে নন্দিসংকটের অবরুদ্ধ পথ উন্মোচন করে দেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে রাজা তাঁকে শিবতরাই থেকে ফিরিয়ে আনেন। অভিজিৎ উত্তরকূট রাজ্যে ফিরে এসে কেমন উদাসীন ভাবে ঘোরাফেরা করতে থাকে, যা রাজপুত্র সুলভ নয়। অভিজিতের আচরণে রাজা কেমন সন্দিহান হয়ে পড়েন এমনকি মন্ত্রীমশাই-এর দৃষ্টিও এড়ায়নি। তাঁর মনে সন্দেহ জাগে আসল রহস্য বুঝি অভিজিৎ টের পেয়ে গেছেন। অভিজিৎ যে প্রকৃত রাজপুত্র নয়, ঝর্নার ধারে কুড়িয়ে পাওয়া, এটিই বোধকরি অভিজিৎ জানতে পেরেছেন এমন এক আশংকায় রাজসমীপে মন্ত্রীমশাই এমন উক্তি করেন।


৯। “আমি পৃথিবীতে এসেছি পথ কাটবার জন্যে

এই খবর আমার কাছে এসে পৌঁচেছে।

উঃ এ উক্তি যুবরাজ অভিজিতের।

অভিজিৎ রাজার নির্দেশে শিবতরাইবাসীদের শাসন করতে এসে কীভাবে জানতে পেরেছেন তিনি রাজপুত্র নয় বা রাজকুলে তাঁর জন্ম নয়। মুক্তধারার ঝর্নার ধারে তাঁর জন্ম, রাজানুকূল্যে তিনি বড়ো হয়েছেন, তিনি নিজেকে আর রাজপুত্র ভাবতে না পেরে সাধারণের সঙ্গে মিশে তাঁদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে নন্দিসংকটের অবরুদ্ধ পথ মুক্ত করে দেন। রাজাদেশে তিনি উত্তরকূটে ফিরে এলেও কেমন বন্ধনহীন মুক্ত বিহঙ্গের মতো বিচরণ করতে থাকেন। সন্দেহ পরবশ হয়ে রাজা মন্ত্রী সমীপে অভিজিতের চিত্তবৈকল্য সম্পর্কে কথা তুললে মন্ত্রী মশাই সাগ্রহে জানিয়ে দেন, অভিজিৎ তাঁর জন্ম-রহস্য লোকমুখে জানতে পেরেছেন, এবং একদা মন্ত্রীকেও তিনি উপরিউক্ত উক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন তিনি রণজিতের মতো পথ বাঁধতে আসেননি, এসেছেন মুক্ত করতে।

অনুরূপ : "এই জলের শব্দে আমি আমার মাতৃভাষা শুনতে পাই।"


১০। "এমন সব দুর্যোগ আছে যাকে আটকে রাখার চেয়ে ছেড়ে রাখাই নিরাপদ।” 

উঃ এ উক্তি মন্ত্রীমশাই-এর।

শিবতরাই-এর অবাধ্য প্রজাদের দমন করতে, রাজা রণজিৎ যুবরাজ অভিজিৎকে প্রেরণ করেন। কিন্তু অভিজিৎ তাদের শাসন করার বদলে রাজার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলেন। যার জন্যে বাধ্য হয়ে রাজা তাঁকে উত্তরকূটে ফিরিয়ে আনেন, অভিজিতের মতোই শিবতর ইবাসীদের রাজার বিরুদ্ধে খেপানের কাজে নেমে পড়েছেন ধনঞ্জয় বৈরাগী। রাজা তাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করে একেবারে চিরতরে মেরে দেওয়ার পরিকল্পনা বাতলালে মন্ত্রীমশাই রাজাকে ধিক্কার জানাতে কুণ্ঠিত হননি। সেইসঙ্গে আরও স্মরণ করিয়ে দেন এমনসব বাধা আছে যা অতিক্রম করার চেষ্টা করলেই বিপদ আরও বাড়বে। অর্থাৎ ধনঞ্জয়ের কণ্ঠরোধ হলে তা দেখে হাজার হাজার শিবতরাই-এর প্রজাদের কণ্ঠ জ্বলে উঠবে। প্রসঙ্গক্রমে মন্ত্রীমশাই এমন উক্তি করতে সচেষ্ট হয়েছেন।


১১। “আত্মীয়রূপী পর হচ্ছে কুঁজো মানুষের কুঁজ ; পিছনে লেগেই থাকে, কেটেও ফেলা যায় না, বহন করাও দুঃখ।”

উঃ এ উক্তি উত্তরকূটের রাজা রণজিতের।

শিবতরাই-এর প্রজাদের নিয়ে তিনি অতিষ্ঠ। তাদের ঔদ্ধত্য রাজার নিকট সহ্যের অতীত। তাদের দমন করতে তিনি নন্দিসংকটের পথ অবরুদ্ধ করেন। মুক্তধারা ঝর্নার বুকে বাঁধ দিতে থাকেন এমনকি যুবরাজ অভিজিতকে প্রেরণ করেন তাঁদের শাসন করতে। কিন্তু ফল ফলল বিপরীত, মানবতার মন্ত্রে দীক্ষিত অভিজিৎ শাসনের পরিবর্তে তাদের ভালোবেসে নন্দিসংকটের পথ খুলে দেন, তারই মানব মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে গেয়ে ওঠেন ধনঞ্জয় বৈরাগী, অবশেষে রণজিতের শোষণ নীতিতে অতিষ্ট হয়ে তাঁর মোহনগড়ের খুড়া মহারাজ বিশ্বজিতের আগমন ঘটে তাঁকে সতর্ক করতে। দূত মারফত তাই আগমনের সংবাদে রুষ্ট হয়ে রণজিৎ এমন উক্তি করেছেন।


১২। যেসব পথ এখনও কাটা হয়নি ওই দুর্গম পাহাড়ের ওপর দিয়ে সেই ভাবীকালের পথ দেখতে পাচ্ছি—দূরকে নিকট করবার পথ।” 

উঃ কথাচ্ছলে উত্তরকূটের যুবরাজ অভিজিৎ মোহনগড়ের খুড়া মহারাজ বিশ্বজিৎকে এই উক্তি করেছিলেন।

শিবতরাইবাসীদের ওপর অমানষিক আচার আচরণে রুষ্ট হয়ে মোহনগড়ের খুড়া মহারাজ বিশ্বজিত এসেছিলেন রণজিতকে এই হিংস্র পথ থেকে নিবৃত্ত করতে। ইতিমধ্যে রণজিৎ মন্ত্রীর নিকট শোনেন—অভিজিৎ জেনে গেছেন তাঁর আসল জন্ম-রহস্য। কেমনভাবে অভিজিং এই বিষয়টি জানতে পারলেন? এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর যখন পাচ্ছিলেন না তখন বিশ্বজিতের কণ্ঠে অভিজিতের প্রশংসাবাণী শুনে তিনি বুঝতে পারেন, এই রহস্য উদ্ঘাটনের মালিক আর কেউ নন স্বয়ং বিশ্বজিৎ। শুধু তাই নয়, তিনি আরও জানান নিজ জন্ম পরিচয় জানার পর অভিজিতের মধ্যে কীরূপ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তারই এক বালক চিত্র ফুটে ওঠে উপরিউক্ত কথাগুলির মধ্য দিয়ে, যার মধ্য দিয়ে শুধু মুক্তির ব্যাকুলতা প্রতিধ্বনিত হয়েছে।


১৩। "খাপের চেয়ে তলোয়ার বড়ো হয়ে উঠলে ভালো হয় না।

উঃ এ উক্তি উত্তরকুটের ১নং নাগরিকের কণ্ঠ দিয়ে স্ফুরিত হয়েছে। শিবতরাইবাসীদের দমন করতে রাজ আজ্ঞায় বহুদিনের প্রচেষ্টার ফলে যন্ত্ররাজ বিভূতি মুক্তধারার ঝর্নার জলকে লৌহ্যন্ত্রের দ্বারা বেধে এক অসামান্য কীর্তি প্রতিস্থাপিত করেছেন। উত্তরকূটের অসংখ্য নাগরিক তার এই অসামান্য কীর্তিকে চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করতে দলে দলে আসতে শুরু করেছে, পথের মাঝেই তাদের আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় লৌহযন্ত্রের স্রষ্ট্রার স্বভাব প্রাকৃতি নিয়ে। একদিন যে বিভূতি ছিল অতীব সাধারণ নগণ্য আজ লৌহযন্ত্রের দ্বারা মুক্তধারাকে অবরুদ্ধ করে কিনা মহীয়ান হয়ে উঠেছে, সাধারণ থেকে হয়েছেন অসাধারণ। গর্বভরে নিজের কাছের মানুষদের এড়িয়ে চলেন, তবে এই ব্যবহার বিভূতির পক্ষে যে সমীচীন নয় তা ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একজন নাগরিক উক্ত কথাগুলি অনায়াসে বলে ফেলে, অর্থাৎ অহংকার মানুষকে সর্বনাশ করে।


১৪। মুক্তধারার উৎসের কাছে কোন ঘরছাড়া মা ওকে জন্ম দিয়ে গেছে, ওকে ধরে রাখবে কে?

উঃ উত্তরকূটের যুবরাজ অভিজিৎ সম্পর্কে বিশ্বজিৎ এই কথাগুলি বলেছেন।

যে অভিজিৎ শৈশব থেকেই জানতেন তিনি উত্তরকূটের ভাবী রাজা, আজ তিনিই রাজা রণজিতের আগ্রাসী নীতিতে বিহ্বল। নির্যাতিত শিবতরাইবাসীদের শাসনের ভার নিয়ে ও তাঁদের দুঃখে ব্যথিত হয়ে নন্দিসংকটের অবরুদ্ধ পথকে উন্মোচন করেন। কারণ, জন্মরহস্যই তাঁকে এই শুভপথের অভিযাত্রী করে তুলেছেন। তিনি তাঁর কর্তব্য গুণে মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী বিশ্বজিতের নিকট জ্ঞাত হন তিনি রাজপুত্র নয়, মুক্তধারার নিকট কুড়িয়ে পাওয়া কোনো এক নামগোত্র পরিচয়হীন সন্তান। এ সংবাদে আত্মহারা হয়ে তিনি রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে হারিয়ে যেতে চাইলেন সাধরণের ছিঁড়ে। তাঁর আরচণে রণজিৎ বিহ্বলতা প্রকাশ করলে, বিশ্বজিৎ উপরিউক্ত কথাগুলি শোনান রাজা রণজিৎকে। অর্থাৎ তিনি বন্ধনহারা, তাঁকে কোনোমতেই বাঁধা যাবে না।


১৫। “মানুষের ভিতরকার রহস্য বিধাতা বাইরের কোথাও না কোথাও লিখে রাখে।”

উঃ এ উক্তি যুবরাজ অভিজিতের।

রাজার নির্দেশে শিবতরাই-এর প্রজাদের শাসন করতে গিয়ে তিনি বুঝেছেন একাজ তাঁর দ্বারা সম্ভব নয়, তিনি তাঁদের দুঃখ মোচন করতে নন্দিসংকটের পথ খুলে দিয়েছেন। এর পরই তিনি মোহনগড়ের রাজা বিশ্বজিতের নিকট জানতে পারেন তাঁর আসল জন্মরহস্য। রাজকুল নয়, মুক্তধারার ঝর্নার ধারে তাঁর জন্ম, রাজা তাঁকে কুড়িয়ে এনে প্রতিপালন করেছেন। তাই যখন তিনি দেখলেন যন্ত্ররাজ বিভূতি মুক্তধারাকে বেঁধেছেন বাঁধ দিয়ে। এ বন্ধন যে তার মুক্ত জীবনের বন্ধন, তা উপলব্ধি করে তিনি রাজ-সান্নিধ্য ত্যাগ করে মুক্তিপিয়াসে ফিরতে লাগলেন, আর ভাবতে থাকলেন কীভাবে মুক্তধারার বাধকে ভেঙে ফেলা যায়। তাঁর এই চিত্তবৈকল্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে রাজকুমার সে সম্পর্কে জানতে চাইলে অভিজিৎ এমন কথা বলেন। 

অনুরূপ : “আমার জীবনের স্রোেত রাজবাড়ির পাথর ভিঙিয়ে চলে যাবে। এই কথাটা কানে নিয়েই পৃথিবীতে এসেছি।”/ “কোনো আগুনের পাখি মেঘের ডানা মেলে রাত্রির দিকে উড়ে চলেছে।”/ “স্বৰ্গকে ভালো লেগেছে বলেই দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করতে যেতে দ্বিধা করিনে।"


১৬। যা কঠিন তার গৌরব থাকতে পারে, কিন্তু যা মধুর তারও মূল্য আছে।” 

উঃ এ উক্তি রাজকুমার সঞ্জয়ের।

যুবরাজ অভিজিৎ যখন জানতে পারলেন তাঁর আসল জন্মপরিচয়, যখন বুঝলেন তিনি রাজপুত্র না, ঝর্নার ধার থেকে কুড়িয়ে পাওয়া কোনো এক অজানা মায়ের সন্তান, তখন তিনি রাজকার্যের মোহ ত্যাগ করে জীবন বৈরাগ্যের পথে অভিসারী হয়ে ওঠেন। কিন্তু মানবত্বে পূর্ণ প্রতিরূপ এই অভিজিৎকে সঙ্গ ছাড়া করতে নারাজ তাঁর আবাল্য আদরের বন্ধু, রাজকুমার সঞ্জয়, তিনি অভিজিতের সঙ্গী হতে চাইলে অভিজিৎ তাঁকে নিরস্ত্র করতে না নাম মুক্তির অবতারণা করেন। অভিজিৎ আজ যে পথের অভিযাত্রী সে পথ সঞ্জয়ের কাছে দুস্তর, কিন্তু সঞ্জয় নাছোড়বান্দা অভিজিৎকে বোঝাতে সঞ্জয় উক্ত কথাগুলি বলে জানিয়ে দিলেন—শুধু কঠিনের গৌরব নয়, মধুরেরও একটা গৌরব আছে।


১৭। “সেই ভীরু, যে আপনাকে গোপন করেছে, কিন্তু আপনার পূজা গোপন করতে পারেনি।”

উঃ উক্তি রাজকুমার সঞ্জয়ের।

রাজকুলে প্রতিপালিত হলেও রাজরক্তের হিংস্রতা অভিজিতের মধ্যে বহমান নয়। কারণ জন্ম তো তাঁর রাজকুলে নয়, মুক্তধারার ঝর্না তলায়। কোনো এক অজানা দুঃখিনী মায়ের গর্ভে তাঁর জন্ম। কাজেই ক্রমেই অভিজিতের আচরণে মনুষ্যত্বের পূর্ণ স্বরূপ উঠতে থাকে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন শ্রোতা–ভক্তের দল। তাঁরা যুবরাজের সান্নিধ্য কামনা করতে চায়। তাদেরই মধ্যে একজন একদা এসেছিল শ্বেতপদ্ম উপহার দিতে, অভিজিতের অলক্ষে তাঁর পূজার আসনের সামনে রেখে নাম না জানিয়ে চলে গিয়েছিল। এঘটনা সঞ্জয় অবগত ছিল। আজ অভিজিতের চিত্ত বৈকল্য দেখে (রাজকার্যের প্রতি) সেই অনাম্নী ভক্তকে স্মরণ করে সঞ্জয় এই কথাগুলি বলেছেন। অর্থাৎ সঞ্জয় বোঝাতে চাইলেন ভক্তটি নিজেকে গোপন করলেও তাঁর দেওয়া পূজাকে গোপন করতে পারেনি।


১৮। “ডান হাতের কার্পণ্য দিয়ে পথ বন্ধ করে বাঁ হাতের বদান্যতায় বাঁচানো যায় না।” 

উঃ যুবরাজ অভিজিতের এ উক্তি।

শিবতরাইবাসীদের শাসনের ভার নিয়েও যুবরাজ অভিজিৎ নন্দিসংকটের পথের বন্ধন উন্মোচন করেছিলেন। যে পথ বেঁধেছিলেন রাজা রণজিৎ, শিবতরাইবাসীদের অনাহারে মরতে। আজ স্বয়ং রাজা বিস্মিত, সে যুবরাজকে তিনি পাঠিয়েছিলে শিবতরাইয়ে। তাদের শাসন করতে, সেই যুবরাজ তাদের সুবিধার্থে রাজার বিরুদ্ধচারণ করে নন্দিসংকটের অবরুদ্ধ পথ খুলে দিয়েছে। শুধু রাজা নন সমগ্র উত্তরকূটের বাসিন্দারা যুবরাজের এ কতবে ক্রুদ্ধ। এমনকি রাজপ্রহরী ও অভিজিতের কাছে জানতে চাইলেন তাঁর এ কাজের আসল উদ্দেশ্য কী? আরও জানালেন মহারাজ তো স্বয়ং শিবতরাইবাসীদের সাহায্যার্থে প্রস্তুত, যদি অবিলম্বে তারা রাজার বশ্যতা স্বীকার করে। রাজারও অন্তরে দয়ামায়া আছে, প্রত্যুত্তরে, অভিজিত উক্ত কথাগুলি বলে বোঝাতে চেয়েছেন তাদের ভাতে মেরে দয়া দেখানো ছলনা ছাড়া আর কিছু নয়।


১৯। তোদের মনকে নিজের কাছে রাখিসনে, ভিতরে যে ঠাকুরটি আছেন তাঁরই পায়ের কাছে রেখে আয়, সেখানে অপমান পৌঁছবে না।"

উ: উদ্ভিটি ধনঞ্জয় বৈরাগীর। যুবরাজ অভিজিতের মতোই ধনঞ্জয় বৈরাগীও শিবতরাইবাসীদের মুক্তি কামনায় ব্যাকুল। তিনি নিজেই শিবতরাই-এর অধিবাসী। যখন শুনলেন রাজার বিরুদ্ধচারণ করায় স্বয়ং যুবরাজ রাজার নির্দেশে বন্দি হয়েছেন, তখন তিনি তাঁর মুক্তি পিয়াসে স্বাধীন জীবনের সংগীতে প্রবুদ্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে পড়লেন। রাজার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুললেন শিবতরাইবাসীদের তিনি বোঝাতে চাইলেন, শুধু মুখ বুজে রাজার অন্যায়কে সহ্য নয় প্রতিবাদ করতে তুলে আগুনের মতো জ্বলে উঠতে হবে, রাজার মারকে পরস্থ করলে তবেই জয়ী হওয়া যাবে, আর এরজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিজের নিজের ভেতরকার মনকে প্রস্তুত করা। অন্তরের ঠাকুরকে স্মরণ করা। দিন শেষ হয়ে আসছে জয় অবশ্যই হবে। এমনই পরিপ্রেক্ষিতে ধনঞ্জয় উক্ত কথাগুলি বলছেন কয়েকজন শিবতরাইবাসীকে।


২০। “ঢেউকে বাড়ি মারলে ঢেউ থামে না, হালটাকে স্থির করে রাখলে ঢেউ জয় করা যায়।”

উঃ এ উক্তি ধনঞ্জয় বৈরাগীর। 

রাজাদেশ অমান্য করায় যুবরাজ অভিজিৎ বন্দি হয়েছেন, এই সংবাদ দিকে দিকে প্রচারিত হতেই শিবতরাইবাসীরা যখন শুনলে তাদের প্রাণের ঠাকুর রাজকারাগারে বন্দি তখন তারা ধৈর্য হারাতে বসেছিল, সবাই এক বাক্যে ঘোষণা করে মারের বদলে মার, অর্থাৎ রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা। এই সময় ধনঞ্জয় তাঁর সুরেলা কণ্ঠে বয়ে নিয়ে এলেন—‘আমি মারের সাগর দেব পাড়ি'—অর্থাৎ 'মারের বদলে মার’ এই নীতিকে বিশ্বাসী হয়ে চললে জীবনের জয় রথ অবিলম্বে থেমে যাবে, সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী। সত্যিকারের বেঁচে থাকার পথ হল মারকে জয় করা মারের বিরোধিতা না করা। ভালোবাসার দ্বারা মারকে প্রেমে পরিণত করা, কারণ মারের বিরুদ্ধে মার কষালে তা আরও বেড়ে যাবে, যেমন ঢেউকে বাড়ি মারলে তাকে থামানো যায় না, এমনই পরিপ্রেক্ষিতে ধনঞ্জয় উক্তিটি করেছেন।


২১। “আসল মানুষটি যে তার লাগে না, সে যে আলোর শিক্ষা, লাগে জন্তুটার, সে যে মাংস।”

উঃ এ উক্তি ধনঞ্জয়ের।

মহামনীষীরা বলেন, প্রত্যেক মানুষের অন্তরের দেবতার অধিষ্ঠান, যথাযথ পরিচর্যায় তাকে যদি সন্তুষ্ট করা যায় তবেই তাঁর বহিপ্রকাশ ঘটে। যুবরাজ অভিজিতের বন্দি হওয়ার সংবাদে সমগ্র শিবতরাইবাসীরা হয়ে ওঠে মারমুখী। তারা উত্তরকূটের রাজা রণজিতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চায় অর্থাৎ তারা মারের বদলে মার গ্রহণ করবে। তাদেরই দলপতি ধনঞ্জয়ের নিকট অনুমতি চাইতে এলে ধনঞ্জয় উক্ত কথাগুলি বলে তাদের বুঝিয়ে দেন—মারের বদলে মার পাশবিক ক্রিয়া। মনুষ্যত্বের অপমান, কাউকে মারলে মানুষের মধ্যেকার জন্তুটা কেঁদে ওঠে আসল মানুষটির অর্থাৎ প্রাণের দেবতার কিছু হয় না, তাই হিংসার পথ পরিত্যাগ করে মানবতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে এগিয়ে চললে অবশ্যই জয়ী হওয়া যাবে।


২২। “সে কথাটা পাকা যেটাকে ভিতর থেকে পাকা করে না যদি বুঝিস তো মজবি।”

উঃ উক্তিটি ধনঞ্জয় বৈরাগীর।

প্রাণের প্রিয় মানুষটির অর্থাৎ অভিজিতের বন্দি হওয়ার সংবাদে শিবতরাইবাসীরা রাজার বিরুদ্ধে ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে। তারপর একযোগে রাজসমীপে গিয়ে এর যথাযথ বিচার চায়, অর্থাৎ তারা মারের বদলে মার চায়। কিন্তু তারা কেমন করে যাবে, উপযুক্ত নেতৃত্ব চাই, তাদের নেতা হিসাবে ধনঞ্জয়কে সবার মনে ধরেছে। ধনঞ্জয়ের নিকট সবাই দরবার জানালে ধনঞ্জয় তা সর্বাগ্রে নাকচ করে দেয়। কারণ কেউ কাউকে জাগাতে পারে না, সবাইকে নিজে থেকে জাগতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে তবেই মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। কাউকে অনুসরণ করলে পরে নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয় থাকবে, অস্তিত্ব হবে বিনষ্ট। আসল স্বরূপকে প্রকাশ করতে হলে চাই স্বমূর্তি ধারণ। তাই ধনঞ্জয় তাদের বোঝাতে সচেষ্ট হয় কোনো অনুসরণ নয়, সত্য মিথ্যাকে নিজে থেকেই চিনতে হবে। নইলে পরের কথায় অবশেষে মজতে হবে।


২৩। “তোরা যে মনে মনে মারতে চাস, তাই ভয় করিস, আমি মারতে চাইনে তাই ভয় করিনে। যার হিংসা আছে ভয় তাকে কামড়ে লেগে থাকে।” 

: উক্তিটি ধনঞ্জয় বৈরাগীর।

অভিজিতের মতোই ধনঞ্জয় বৈরাগীর ধ্যান-জ্ঞান শিবতরাইবাসীদের ভালো করা। তাই তিনিও রাজার বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলতে রাস্তায় নেমে পড়েন তলব কণ্ঠে বিদ্রোহের গান নিয়ে। তলব জেলে যান, প্রজাদের বিদ্রোহী করে তোলার মূলে স্বয়ং ধনঞ্জয়। তিনিও ধনঞ্জয়কে তলব করতে থাকেন রাজকারাগারে বন্দি করে রাখবেন। এ সংবাদ ক্রমেই দিকে দিকে প্রচার পেলে শিবতরাইবাসীরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে, তাদের কর্ণধার সমূহ বিপদের সম্মুখীন। ধনঞ্জয়কে কাছে পেয়ে তারা জিজ্ঞাসা করে তাঁর রাজাকে ভয় করে না? প্রত্যুত্তরে ধনঞ্জয় উক্ত কথাগুলি বলেছেন, অর্থাৎ তিনি সকল ভয়ের ঊর্ধ্বে, মরতে তাঁর ভয় করে না, কারণ তিনি তো কাউকে মারতে চান না, তাই মৃত্যুতে তাঁর ভয় নেই, যারা মারতে চান তাদের মৃত্যুতে ভয় অবশ্যম্ভাবী।


২৪। “রাজদরবারের ওপর তলার মানুষ যখন নালিশ মঞ্জুর করেন তখন রাজার তাড়া রাজাকেই তেড়ে আসে।”

উঃ এ উক্তি ধনঞ্জয় বৈরাগীর।

উত্তরকূটের রাজা রণজিতের দীর্ঘদিনের অত্যাচারে শিবতরাই-এর প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে সবাই সমবেত হয়ে চলেছে তাদের নালিশ জানাতে। কেন লৌহযন্ত্রের দ্বারা তাদের পিপাসার জল দায়ী—মুক্তধারাকে বাঁধা হয়েছে। সর্বাগ্রে চলেছেন ধনঞ্জয় বৈরাগী। তাঁরই নেতৃত্বে অনান্য সাধারণ মানুষ চলেছেন রাজসমীপে। রাজার কাছে গিয়ে কে কী চাইবে ধনঞ্জয় জিজ্ঞাসা করলে সবাই নির্বাক হয়ে যায়, রাজত্ব চাইবার প্রশ্নে সবাই সন্ধিহান হয়ে তাকিয়ে থাকলে ধনঞ্জয় উক্ত কথাগুলি বলেছেন। কারণ, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, রাজত্ব কেবল রাজার একলার নয়, প্রজাদের তার ওপর সম পরিমাণে অধিকার নিহিত, তাইতো কোনো দীনতা নয়, রাজার খাতিরেই রাজত্ব দাবি করা শ্রেয়, নইলে রাজার অত্যাচারে ঈশ্বর সেদিন ক্ষেপে উঠবেন রাজার আর বেঁচে থাকার কোনো পথ থাকবে না।


২৫। “জগৎটা বাণীময় রে, তার যে দিকটাতে শোনা বন্ধ করবি, সেইদিক থেকে মৃত্যুবান আসবে।”

উঃ উক্তিটি ধনঞ্জয় বৈরাগীর।

অবশ্য শিবতরাই-এর প্রজাদের পিপাসার জল থেকে বঞ্চিত করতে রাজা রণজিৎ বিভূতির সহায়তায় মুক্তধারার বুকে এক বিরাটাকায় লৌহযন্ত্রের দ্বারা বাঁধ নির্মাণ করেন। শিবতরাইবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে পথে নামে, তারা রাজার কাছে নালিশ জানাবে। তাদের আদর্শ ধনঞ্জয়কে কাছে পেয়ে জানিয়ে দেয় রাজা রণজিতের অপকীর্তির কথা, এবং এর একটা যথাযত বিহিত করতে তারা ধনঞ্জয়কে অনুরোধ করতে থাকে। ধনঞ্জয় সবাইকে ‘একলা চলতে' মন্ত্রদান করে বুঝিয়ে দেয়, সংসারে সবাই ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট জীব, কেউ কাউকে কোনো ক্ষতি করতে পারে না। ভগবানও তা সইবেন না। কারণ, সমগ্র জগৎটা বাণীময়, ঈশ্বরের নামে মুখর, শক্তির দাসত্ব করতে কেউ যদি একদিক তা অবরোধ করে সেই দিক থেকে অবশ্যই মৃত্যুবান ধেয়ে আসবে।


২৬। 'প্রাণ দিবি তাঁকেই প্রাণ দিয়েছেন যিনি।”

উঃ উক্তিটি ধনঞ্জয়ের।

অন্যায় অধর্মের প্রতিমূর্তি রাজা রণজিৎ অবাধ্য শিবতরাইবাসীদের বশে আনতে তিনি তাঁদের নন্দিসংকটের পথ অবরোধ করেছে। তাদের তৃষ্মার জল থেকে বঞ্চিত করতে মুক্তধারাকে বিরাটাকায় লৌহযন্ত্রের দ্বারা অবরোধ করেছে। ক্রমেই শিবতরাইবাসীরা রাজার বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছে, তারা বিদ্রোহ করতে চায়। সকল দেশবাসীকে একত্র করতে তারা ধনঞ্জয়ের দ্বারস্থ হয়। কারণ ধনঞ্জয়ের কথা সবাই শোনে এবং মানে। তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নিজ অধিকার ফিরে পেতে চায়। এরজন্য যদি জীবন দিতে হয় তাতেও প্রস্তুত। কোনো মতেই পিছিয়ে আসা নয়। ধনঞ্জয় তাদের এই উদ্দেশ্যকে অভিবাদন জানিয়ে বলতে ভুল করলেন না অকারণে অধর্মের পায়ে মাথা কুড়তে নেই, অর্থাৎ প্রাণ দিয়েছেন স্বয়ং ঈশ্বর, যদি দিতেই হয় তাঁকেই দেওয়া যায়, নতুবা অর্ধামিক রাজার নিকট প্রাণ দিয়ে কোনোই লাভ নেই, বরং ক্ষতি। একথা তিনি রাজা রণজিতের সমক্ষে সদর্পে ঘোষণা করেছেন।


২৭। “বাইরের ভরসাটুকু ফুটো হলেই ভিতরের ভয় সাতগুণ জোরে বেরিয়ে পড়বে৷ তখন ওরা মরবে যে।” 

উঃ এ বক্তব্য রাজা রণজিতের।

যুবরাজ অভিজিতের মতোই ধনঞ্জয় বৈরাগী শিবতরাইবাসীকে ক্ষেপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে স্বাধীনতার মন্ত্র শোনাচ্ছেন। উত্তরকূটের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসতে খাজনা দান থেকে বিরত করছেন, এ সংবাদ রাজার নিকট গেলে রাজা উত্তেজিত হয়ে ধনঞ্জয় সমীপে এসে তাকে জবাবদিহি করছেন তার এই সকল কর্মের আসল উদ্দেশ্য কী? ধনঞ্জয় যখন সোচ্চার কণ্ঠে বলে ওঠেন—প্রাণ তাকেই দেওয়া যায় যিনি প্রাণদানের মালিক। রাজা সামান্য মানব মাত্র তাঁকে দেখে ভয় কীসের? এমনতর সাহস জাগানোর কীরূপ পরিণাম হতে পারে তার স্মরণ করাতে রণজিৎ ধনঞ্জয়কে এমন উক্তি করে বোঝাতে সচেষ্ট হয়েছিল—সাময়িকের মধ্যে এমন প্ররোচনায় তারা প্ররোচিত হলেও যখন সত্যিকারের বিপদ ঘনিয়ে আসবে তখন ধনঞ্জয় তাদের রক্ষা করতে পারবে তো।


২৮। "ছেড়ে রাখলেই যাকে মুঠোর মধ্যে পাও, চাপতে গেলেই দেখবে সে ফসকে গেছে।”

উঃ এ উক্তি ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজা রণজিতের প্রতি।

রাজা রণজিতের অন্যায় এবং অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যখন শিবতরাইবাসীরা পথে নেমেছে প্রতিবাদের আশায় তাদেরকে কর্মে উৎসাহ দিতে সহায় হয়েছেন ধনঞ্জয় বৈরাগী। রাজার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। এ সংবাদে রাজা স্বয়ং বিচলিত হয়ে ধনঞ্জয় সমীপে এসে তাকে নির্দেশ দেন এই মুহূর্তেই তিনি যেন শিবতরাই-এ ফিরে যান এবং প্রজাদের পুনরায় খাজনা দানের নির্দেশ দেন, নইলে ফল অতীব মারাত্মক। মানবতার মন্ত্রে প্রবুদ্ধ ধনঞ্জয় রাজাকে বোঝাতে সচেষ্ট হন—যখন পীড়নের দ্বারা কিংবা কারারুদ্ধ করে কোনো মানুষের মন পাওয়া যায় না, ছেড়ে রাখলেই তবে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে অত্যাচারে তা সম্ভব নয়। তাই রাজার পক্ষে বৃথা এই আয়োজন, তিনি যেন প্রজাদেরকে ভালোবেসে কাছে টানেন। এ বাণী মানবতার আর এক মন্ত্ৰ৷

অনুরূপ : “টেনে কিছুই রাখতে পারবে না। সহজে রাখবার শক্তি যদি থাকে তবেই রাখা চলবে। যিনি সব দেন তিনি সব রাখেন। লোভ করে যা রাখতে চাইবে সে হল চোরাই মাল, টিকবে না।”


২৯। “শাসনের ভীষণ যন্ত্র তৈরি হয়েছে, তার ওপরে ভয় আরও চড়াতে গেলে সব যাবে ভেঙে।" 

উঃ এ উক্তি মন্ত্রীমশাই-এর, রাজার প্রতি।

রাজার সন্দেহ শিবতরাই-এর প্রজাদের খেপিয়ে তোলা থেকে, তাদের খাজনা দেওয়া থেকে বিরত করা পর্যন্ত সবই ধনঞ্জয়ের দ্বারাই সম্ভব হচ্ছে। কাজেই তিনি যত মুক্ত ভাবে ঘুরে বেড়াবেন ততই রাজ্যের পক্ষে অমঙ্গল। অতএব আর নয়, যত শীঘ্র পারা যায় ধনঞ্জয়কে কারারুদ্ধ করা আবশ্যক। ধনঞ্জয়কে কারারুদ্ধ করতে মন্ত্রীকে আদেশ দিলে প্রত্যুত্তরে মন্ত্রীমশাই এমন উক্তি করে বুঝিয়ে দিয়েছেন—শাসন নিষ্ঠুর যন্ত্র রাজার 'পরে ন্যস্ত হয়েছে। রাজা তা যথাসময়ে কার্যকরী করছেন, তার ওপর 'ভয়' নামক বস্তুটা যদি তিনি উপর্যুপরি ব্যবহার করতে থাকেন তাহলে শাসনের নিয়ম যন্ত্রটা ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে অবিলম্বেই ভেঙে পড়বে, তাতে রাজ্যের পক্ষে চরম ক্ষতিকারক।


৩০। “ভালোবেসে তোদের চেপে মারার চেয়ে ভালোবেসে তোদের ছেড়েই থাকাই ভালো।”

উঃ এ উক্তি ধনঞ্জয় বৈরাগীর।

ধনঞ্জয় শিবতরাই-এর মানুষদের রাজার বিরুদ্ধে খেপিয়ে বেড়াচ্ছেন এই অভিযোগে রণজিৎ তাঁকে বন্দি করতে চান। ধনঞ্জয় সে বন্দিত্ব হাস্যমুখে বরণ করতে প্রস্তুত। কিন্তু ধনঞ্জয়ের অসংখ্য অনুরাগী ভক্তগণ এটি হতে দিতে চান না। তারাও এক জোটে ধনঞ্জয়ের মতোই বন্দিত্ব স্বীকার করতে চায়, কারণ তারা তাদের প্রাণের মানুষকে এভাবে ছাড়তে চায় না, ভালোবেসে কাছে থাকতে চায়। কিন্তু ধনঞ্জয় তা চান না। “দূরে গেলে প্রিয় হয়। এই নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে বলেন— ভালোবাসার চাপে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে দূরে যাওয়াই শ্রেয়, অতএব নিশ্চিন্তমনে যেন শিবতরাইবাসী আপন কাজ মনোনিবেশ করেন।" অগত্যা ব্যথিত চিত্তে সবাইকে তা মনে নিতে হয়।

অনুরূপ : "আমাকে পেয়ে আপনাকে হারাবি। এতবড়ো লোকসান মেটাতে পারি। এমন সাধ্যি কি আমার আছে।”


৩১। “দেনা যাদের অনেক বাকি, শুধু কেবল দৌড় লাগিয়ে দিয়ে তাদের দেনা শোধ হয় না তো।”

উঃ এ উক্তি ধনঞ্জয়ের, রাজার প্রতি।

উত্তরকূটের রাজা রণজিৎ ভেবেই পান কোন সাহসে অসহায় শিবতরাইবাসীরা তাঁর আদেশ লঙ্ঘন করে খাজনা দেওয়া থেকে বিরত থাকে? অতঃপর যখন শুনলেন তাদের নাটের গুরু ধনঞ্জয় স্বয়ং, তাঁরই প্ররোচনায় ওরা এমন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে, তখন রাজা ধনঞ্জয়-এর নিকট জানতে চাইলেন এটা কেমনভাবে সম্ভব হল? প্রত্যুত্তরে ধনঞ্জয় স্বীকার করলেন তাঁরই নির্দেশে প্রজারা ক্ষেপে উঠলেও তা যথাযথ হয়নি, কারণ তারা যে ধনঞ্জয়ের দ্বারা পরিচালিত, তারা কেউই স্বয়ং-সম্পূর্ণ নয়। ক্রমেই তাদের বলবুদ্ধি এতে হ্রাস পাচ্ছে। অতএব অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিতে দৌড় লাগালে চলবে না, আগে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কৌশল জানতে হবে, সবার মূলেই তো ভগবান।

অনুরূপ : "আমাকে পুজো দিয়ে ওরা অন্তরে অন্তরে দেউলে হতে চলল, সে দেনার দায় যে আমারও ঘাড়ে পড়বে।


৩২। “পৃথিবীতে কোনো একলা মানুষই এক নয়, সে অর্ধেক। আর একজনের সঙ্গে মিল হলে তবেই সে ঐক্য পায়।” 

উঃ এ উক্তি রাজকুমার সঞ্জয়ের। শিবতরাইবাসীদের বিদ্রোহী করে তোলা থেকে নন্দিসংকটের অবরুদ্ধ পথ উন্মোচন করার অপরাধে রাজা রণজিতের নির্দেশে যুবরাজ অভিজিৎকে বন্দি করা হয়। এ সংবাদে তাঁর আবাল্য বন্ধু সঞ্জয় মনে মনে ব্যথিত হলেন, কোনোমতেই যুবরাজের এই দুর্দশাকে তিনি মেনে নিতে চান না। যুবরাজের সঙ্গ ছাড়া তিনি সহ্য করতে পারবেন না। তাই মন্ত্রীর নিকট সঞ্জয় বলে ওঠেন একই বন্দিশালাতে তিনিও থাকতে চান। একই দুঃখে দুঃখী হতে চান, কোনো মতেই একাকী তিনি বেঁচে থাকতে চান না। মন্ত্রীমশাই তাঁকে নিরস্ত্র করতে নানারকম নিষেধ আজ্ঞা জারি করলে সঞ্জয় উপায়ান্তর না দেখে আলোচ্য উক্তিখানি করেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন কোনো মানুষ যেমন একাকী বাঁচতে পারে না, তেমনি যুবরাজ ছাড়া তাঁর পক্ষেও বেঁচে থাকা চরম দুরূহ।


৩৩। “আকাশের মেঘ আর সমুদ্রের জল অন্তরে একই, তাই বাইরে তারা পৃথক হয়ে ঐক্যটীকে সার্থক করে।”

উঃ এ উক্তি মন্ত্রীমশায়ের সঞ্জয়ের প্রতি।

যুবরাজ অভিজিতের বন্দিত্বের সংবাদে বিচলিত হয়ে রাজকুমার সঞ্জয় মন্ত্রীর দ্বারস্থ যখন জানালেন, তাঁরা আবাল্য বন্ধু, আত্মার আত্মীয়। এভাবে যুবরাজকে ছেড়ে বেঁচে থাকা তাঁর পক্ষে অসম্ভব, যে করেই হোক যুবরাজের সান্নিধ্যলাভ তাঁকে করতেই হবে। যুবরাজের সঙ্গে একই বন্দিশালাতে তিনি কাল-যাপন করতে চান, বিনা অপরাধে। উত্তেজিত রাজকুমারকে সংযত করতে মন্ত্রীমশাই আলোচ্য উক্তিটি রেখেছেন। তিনি এর দ্বারা বোঝাতে চাইলেন কাছাকাছি থেকে শুধু ভালোবাসার নিদর্শন রাখা যায় না দূরে থেকেও হয়, যেমন মেঘ তার সমুদ্রের জল, তাদের দুজনের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান হলেও অস্তরে তাঁরা এক। অতএব যুবরাজকে দূরে রেখে সঞ্জয়ের পক্ষে স্বাভাবিক থাকাই সমীচীন।


৩৪। “মুক্তধারা তাঁর সেই আহত দেহকে মায়ের মতো কোলে তুলে নিয়ে চলে গেল।”

উঃ এ উক্তি রাজকুমার সঞ্জয়ের।

নন্দিসংকটের অবরুদ্ধ পথ উন্মোচন আর শিবতরাইবাসীকে রাজার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার অপরাধে যুবরাজ অভিজিৎ রাজার নির্দেশে কারাগারে অবরুদ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু মোহনগড়ের খুড়ারাজা বিশ্বজিতের কৌশলে তিনি যখন কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হলেন তখন সবার অলক্ষে সোজা চলে গেলেন মুক্তধারার সেই বিরাটাকায় বাঁধটার কাছে, তার ত্রুটি অনুসন্ধান করতে, কীভাবে বাঁধটাকে ভেঙে মুক্তধারার গতিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। রাজকূলে প্রতিপালিত হলেও যখন তিনি জানলেন তাঁর জন্ম ঝর্নার দ্বারা, কোনো এক হতভাগিনী অনাম্নী অনামিকা তাঁর মা, তাই ঝর্নাকে মাতৃজ্ঞা তাকে বন্ধনমোচন করতে বাঁধের ত্রুটির স্থানে আঘাত হানলেন, সঙ্গে সঙ্গে মুক্তধারারূপী মা অভিজিতকে ভাসিয়ে নিয়ে কোনো অতল তলে চলে গেল। এই দুঃসংবাদটি রাজকুমার সঞ্জয় রাজসমীপে ব্যক্ত করতে আলোচ্য উক্তিটি করেছেন।