'বাবরের প্রার্থনা' কবিতাটির নেপথ্যে সমকালীন অস্থির সময়ে প্রবল পালাবদল কতখানি ক্রিয়াশীল ব্যাখ্যা করো।

শঙ্খ ঘোষের ‘বাবরের প্রার্থনা' কবিতাটির প্রেক্ষপটে ঐতিহাসিক একটি ঘটনার উল্লেখ ধরা পড়লেও, সেই ঘটনাটি কবি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্রে ধারণ করেছেন মাত্র। কবিতাটির উৎস পরিকল্পনায় অন্য এক দেশ-কালের প্রবল প্রেক্ষিত নিবন্ধ। 'কবিতার মুহূর্ত গ্রন্থে কবি স্বয়ং এই সমকালীনতার বিবর্ণ ছবিটিকে উপস্থাপিত করেছেন,

“শেষ হয়ে আসছে ১৯৭৪।


বড়ো মেয়েটি বেশ অসুস্থ তখন, ডাক্তারেরা ভালো ধরতে পারছেন না রোগটা ঠিক কোথায়।।

শুয়ে আছে অনেকদিন, মুখের লাবণ্য যাচ্ছে মিলিয়ে। অথচ তখন তার ফুটে ওঠবার বয়স।

মন্থর হয়ে আছে মনটা।


ঘুড়ে বেড়াচ্ছি একদিন যাদবপুরের ক্যাম্পাসের মধ্যে, দিনের ক্লাস আর সন্ধ্যার ক্লাসের সুন্ধিমুখে মাঝখানে অনিশ্চিত ফাঁকা বিকেল, বন্ধুরা কেউ সঙ্গে নেই সেদিন। পশ্চিম থেকে পূবে, রাস্তার ওপর পায়চারি করতে করতে ঘরের ছবির সঙ্গে মনে ভিড় করে আসে ক্যাম্পাসের পুরোনো অনেক ছবি। দু-একটি ছেলেমেয়ে কখনো কখনো পাশ দিয়ে চলে যায়। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, ক'দিন আগেও এখানে যত প্রখরতা ঝলসে উঠত নানা সময়ে, তা যেন একটু স্তম্ভিত হয়ে আছে আজ। কেবল যে এখানেই তা তো নয়, গোটা দেশ জুড়েই সে কি খুব শান্তির সময় ছিল ? একেবারেই নয়। সংঘর্ষ অশান্তিতেই বরং ভরে ছিল দিনগুলি। এই পথ ওই মাঠ, এর প্রতিটি বিন্দু তার কোনো-না-কোনো উন্মাদনার চিহ্ন ধরে আছে, ভুলের লাঞ্ছনার আত্মক্ষয়ের, কিন্তু সেইসঙ্গে কিছু স্বপ্নেরও কিছু জীবনেরও। আজ প্রশমিত হয়ে আছে সব। কিছু একটা হবার কথা ছিল, অলক্ষ্য কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু হল না ঠিক, হয়ে উঠল না। কিন্তু কেন হল না? আমরাই কি দায়ী কিছু কি করেছি আমরা? করতে পেরেছি ? আমাদের অল্পবয়স থেকে সমস্তটা সময় নই? স্তূপ হয়ে ঘিরে ধরতে থাকে মাথা। ফিরে আসে মেয়ের মুখ। মনে পড়ে আমার নিষ্ক্রিয়তার কথা, তাকিয়ে দেখি কলেজ প্রাঙ্গণ ফাঁকা। হাঁটতে হাঁটতে পুবের শেষ প্রান্তে গিয়ে পশ্চিম মুখে ফিরেছি আবার, চোখ পড়ে আকাশে। সূর্য আড়াল হয়ে যাবে আর অল্প পরেই। হঠাৎ একেবারে হঠাৎ তখন মনে হল মাটির ওপর জানু পেতে বসে পড়ি একবার এই সূর্যের সামনে, কেউ তো নেই কোথাও। যেন সমস্ত শরীর ভরে উদ্‌গত হয়ে উঠতে চায় অতল থেকে কোনো প্রার্থনা, সকলের জন্য। মনে এল নামাজের ছবি। তার সঙ্গে সঙ্গে মনে এল ইতিহাসের পুরোনো সেই গল্প, রুগ্‌গ্ন হুমায়ুনকে ঘিরে ঘিরে বাবরের প্রার্থনা। মন্থরতার ভিতর থেকে তখন উঠে আসতে চায় কতগুলি শব্দ ; এই তো জানু পেতে– এই তো জানুপেতে—


পথে ছেড়ে দ্রুত পায়ে উঠে আসি সিঁড়ি বেয়ে তিনতলার ঘরে। দিন আর রাত্রির মাঝখানে অল্প বয়সের জন্য পরিত্যক্ত করিডর, তার শেষ প্রান্তে আচ্ছন্ন একলা ঘর। টেবিলের সামনে এসে বসি। মনে হয় একটা লেখা হবে।”


১৯৬৮, ৬৯, ৭০ বা তার পরবর্তী দিনগুলিতে গোটা বাংলা রাজনৈতিক-সামাজিক অনাচারের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় সদ্য বিদেশ থেকে ফিরে এসেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। দেশে ফিরেই রক্তাক্ত সময়ের অগ্নিপথ উন্মত্ত হতে দেখলেন নির্লজ্জ হত্যালীলায়। আগুন জ্বলতে দেখলেন ময়দানে যাদবপুর থেকে বারাসাত হয়ে একেবারে প্রান্তসীমা উত্তরবঙ্গে। ১৯৭০ সালের ১৯শে মার্চ ৩৫৬ ধারা জারি করে পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতিশাসন জারি করা হল। বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অনেককেই তখন মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলে ব্যক্তিহত্যার রাজনীতির শিকার হতে হয়েছিল। অনেকেই দীর্ঘদিন গৃহছাড়া হয়ে থাকেন। অত্যন্ত নৃশংসভাবে জনসমক্ষে খুন হতে হয় পুলিশকর্মী থেকে শুরু করে, নিরীহ সাধারণ মানুষ, শিক্ষক-উপাচার্যকে। স্বাধীনতার ঠিক কুড়ি বছর পরে পশ্চিমবঙ্গের যুক্তফ্রন্ট শাসনকালে, তড়াইয়ের নকশাল বাড়িতে পুলিশ কৃষক সংঘর্ষে ৭জন নারী ও ২জন শিশুসহ ১০ জন কৃষকের মৃত্যু হয়। নকশাল বাড়ির কৃষক সংগ্রামের পথই তাদের সঠিক বলে মনে হয়েছিল সেদিন। সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সত্তর দশককে মুক্তির দশকে করতে চাইল তরুণ সম্প্রদায়। স্বাধীনতার এতদিন পরেও চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা। ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি কর্মসংস্থানের অভাব মানুষকে হতাশা ও নৈরাশ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়েছিল। সাধারণ মানুষ একের পর এক সোচ্চার হয়ে উঠছে নিজেদের দাবী নিয়ে। গড়ে উঠেছে একের পর এক আন্দোলন। সত্তরের যুবসমাজ এই সবকিছুর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ জানিয়েছিল সেদিন। কৃষকদের জমি দখলের লড়াই—বিপ্লবের পথে আকৃষ্ট করেছিল তাদের। প্রথানুগ নিয়মের বিরুদ্ধে তারা এগিয়ে গিয়েছিল দ্বিধাহীন চিত্তে। এইসব পরিবর্তন পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতবর্ষেই শুধু নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই যুব ছাত্ররা ঘরের নিশ্চিত নিরাপত্তা ছেড়ে পথে নেমেছিল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে একইভাবে আমেরিকার ছেলে-মেয়েরাও ভিয়েতনামে মার্কিনি আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ক্লাসরুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল প্যারিসের সরবণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও। আমেরিকার আইওয়া থেকে কবি শঙ্খ ঘোষ প্রিয়বন্ধু অশ্রুকুমার সিকদারকে লিখেছিলেন, “গণতন্ত্রের নামে এখানেও যে প্রহসন চলছে তাও দমিয়ে দেয় মন। ভিয়েৎনাম বিদ্রোহের সেই ঢেউ ডিসেম্বরের গোড়ায় আর একবার উথলে উঠেছিল, শীতের মাঠে তাঁবুতে অনশন করে পড়ে থাকা ছেলেমেয়েদের যেভাবে লাঞ্ছিত হতে হল তখন আমাদের দেশে তাতে আগুন জ্বলে উঠত।" বছর খানেকের মধ্যেই দেশে ফিরে কবি সেই আগুন জ্বলতে দেখলেন। আসলে যুগটাই ছিল এমন। তারুণ্যই ছিল অপরাধ, যৌবন ছিল ভয়ের। এমন অনেক নিরপরাধ তরুণকে শুধুমাত্র তারুণ্যের উজ্জ্বলতার কারণে প্রাণ দিতে হয়েছিল সেদিন।


‘বাবরের প্রার্থনা' কবিতায় বারবার ফিরে ফিরে এসেছে ধ্রুবপদের মতো একটি পংক্তি ‘আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক'। এই পংক্তিটি কবির আত্মগত উচ্চারণ। সময়ের কাছে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যে দায় মানুষের থাকে তাকে তো অস্বীকার করতে পারে না মানুষ। তাই সত্তরের দশকের সেই ভয়ংকর সময় যখন ক্রমশই তলিয়ে দিয়েছিল পরবর্তী প্রজন্মকে তখন কবি নিজেকে ও তার সমকালের প্রতিটি মানুষকে সচেতন করে দিতে চেয়েছেন। বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন পূর্বসূরির হিংসা পাপ, আত্মার সুখ প্রবৃত্তি ভোগের নিরন্তন প্রক্রিয়াই উত্তর সূরির ধমনী-শিরা-ফুসফুস বিষিয়ে দিয়েছে। কবি নিজে পাথর হয়ে যাবার নিশ্চল কামনাও প্রকাশ করেছেন, বিনিময়ে প্রাণের উত্তাপ-বিশ্বাস-ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা সঞ্চারিত হয়ে যাক পরবর্তী প্রজন্মে। তারা স্বপ্নময় হয়ে উঠুক। কবি ভেবেছেন, এই জীবনের কাছে যা কিছু তিনি পেয়েছেন, তার সবটুকু নিয়ে বেঁচে উঠুক এই দীর্ণ সময়—তাদের সন্তান ও উত্তর প্রজন্ম। আত্মধ্বংসের এই কামনা শুধুমাত্র সন্ততির স্বপ্নকে সার্থক করার জন্য।


আসলে যুগদীর্ণ সময়ের সন্তানকে যথাযোগ্য আশ্রয় বিশ্বাস ও সম্ভাবনাকে সার্থক করে দিতে না পারার জন্য অসহায় পিতার আত্মিক অনুভব এই ‘বাবরের প্রার্থনা'। সমকালীন যুগের এই অস্থিরতা সম্পর্কে কবির বক্তব্যটি এ প্রসঙ্গে মনে আসে, “কিন্তু শৃঙ্খলার অজুহাতে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের নামে যখন একটা প্রজন্মকে বিকৃত বিকলাঙ্গ করে দেওয়া হয় পুলিশের অন্ধকার গুহায়, তখন তার বিরুদ্ধে যদি আমরা সরব নাও হতে পারি, তার স্বপক্ষে যেন আমরা কখনও না দাঁড়াই। এতটুকু ধিক্কার যেন আমাদের অবশিষ্ট থাকে যা ছুঁড়ে দিতে পারি সেই জেল প্রাচীরের দিকে, যার অভ্যন্তর ভরে আছে বহু নিরাপরাধের রক্তস্রোত আর মাংসপিণ্ডে, ব্যক্ত আর অব্যক্ত বহু আর্তনাদের স্তরান্বিত ইতিহাসে।” (“কবিতার মুহূর্ত)


সত্তরের দশক নকশাল বাড়ি আন্দোলনের চূড়ান্ত সময়। এই আন্দোলনের ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি সম্পর্কে কোনো সমালোচনাই যথেষ্ট নয় কিন্তু সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সহানুভূতি ও সক্রিয় অংশগ্রহণ এ আন্দোলনে দেখা যায়নি। প্রশাসনের চূড়ান্ত দমননীতি সাধারণ মানুষের মনে যে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল তাতে এ আন্দোলন সম্পর্কে প্রত্যেকেই ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এত বেশি হত্যালীলা, আত্মবিসর্জন সম্পর্কে কবি মনোভাব শুধু একটিই—‘কোনো দাম রইল কি কোথাও ? এই অনুভবই, সত্তরের স্বপ্নকে থামিয়ে দিতে চাওয়ার এই চূড়ান্ত অবক্ষয়ই কবিকে প্রাণিত করেছিল ‘বাবরের প্রার্থনা কবিতাটির নির্মাণে। মানুষের গভীরতর অন্তর্বেদনা সংবেদী রূপ পায় যে অনুভব থেকে, প্রজন্মলালিত ক্রম অবক্ষয়ের বৈপরীত্যে সেই অনুভবই নির্মাণ হয়ে জেগে উঠেছে কবি কণ্ঠে,

ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর 

আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক্।