‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রহসনটির পূর্ব নাম ছিল 'ভগ্নশিব মন্দির'। এই পূর্ববর্তী ও পরিবর্তিত নামের মধ্যে কোন্‌টি ব্যঞ্জনাধর্মী বলে তোমার মনে হয়? যুক্তি সহ প্রমাণ দাও।

কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি তারিখ বিহীন লেখা চিঠিতে মাইকেলের এই নাটকটিকে ‘ভগ্ন শিবমন্দির' নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা চলে নাটকটির এমন নামকরণ সম্ভবত করেছিলেন স্বয়ং নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মূলত পাইকপাড়ার রাজারা—যথা প্রতাপ চন্দ্র সিংহ এবং ঈশ্চরচন্দ্র সিংহ, মাইকেলের শুভানুধ্যায়ী ছিলেন। তাঁদের নাট্যানুরাগের জন্যই নিত্যনূতন নাট্যরচনায় মাইকেল মেতে ওঠেন। এই রাজাদের ব্যয়েই আলোচ্য প্রহসনটি মুদ্রিত হয়। নানাপ্রকার বাধার ফলে শেষে নাকটটি আর অভিনীত হয়নি। রাজা ঈশ্চরচন্দ্র সিংহ মহাশয় স্বয়ং প্রহসনটির নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেন—“বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ'। এটি অবশ্য আলোচ্য প্রহসনটির শেষ পঙক্তি। এথেকে পাঠক মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, এই নাম পরিবর্তন কতখানি সাহিত্য শিল্পসম্মত হয়েছে। এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বিশদ পর্যালোচনায় অবতরণ করতে হবে।


ভগ্ন শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে এবং সেই শিবের নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে যে ভূতের আবির্ভাব ঘটেছে, ভূতনাথ শিবের সঙ্গে শক্তিরও যে প্রকাশ ঘটেছে, তা বর্তমান নামকরণে প্রতিফলিত হয়নি। কাহিনি বিন্যাসে দেখা যায়, ভক্তপ্রসাদের উচ্ছৃঙ্খলতার চরম ও চূড়ান্ত লগ্নেই অর্থাৎ ভক্তপ্ৰসাদ যখন বলেছেন—শিবের আর শিবত্ব নেই; এবং সেই কারণেই পবিত্র মন্দির প্রাঙ্গণেই অপবিত্র কর্মানুষ্ঠানে তাঁর কুণ্ঠা ; একজন যবনকন্যার রূপযৌবনে আকৃষ্ট হয়ে নিজের জাতি সংস্কার মর্যাদাকে বিসর্জন দিতেও তাঁর আপত্তি নেই, সেইসময় অশ্বত্থ গাছের ওপর থেকে, যেন আকাশবাণীর মতো, হানিফের বজ্রকণ্ঠ শোনা গেল। এই ঘটনার নাট্যচমক যেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করে তেমনি এর নাট্য ব্যঞ্জনাও উল্লেখযোগ্য।


মাইকেলের অনেক রচনাতেই এই দৈববাণী–আকাশবাণীর প্রসঙ্গটি আছে। হানিফ যেন অশ্বত্থ গাছের ওপরে বসে একটি চরম চূড়ান্তকালের সুযোগ ও অবকাশ খুঁজছিল। যতক্ষণ না সে সুযোগ আসে, ততক্ষণ সে নীরব ও নিষ্ক্রিয় হয়ে অবস্থান করছিল। হানিফের পেছনে আবার মূল উৎসরূপে ছিলেন—পঞ্চানন বাচস্পতি—যিনি বাক্যের পতি। এই ‘ভূত’ আসলে ভূতনাথ ভূতেশ শিব। নইলে ভূতের আবির্ভাবে সাধারণত মানুষ ভয় পেয়ে মূর্ছা যায় ; রাম নাম করে। সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলে পলায়ন করে। কিন্তু “কর জোড় করিয়া সকাতরে’ দেবজ্ঞানে বলে না—“দোহাই বাবা আমাকে ক্ষমা করো।” এসবই দেবস্থানকে অপবিত্র করে ফেলবার কারণে নীরব দেবতার আকস্মিক আবির্ভাবের ফলরূপে নাট্যকার প্রদর্শন করেছেন।


'ভগ্ন শিবমন্দির' নামের মধ্যে প্রথমে নিষ্ক্রিয় পরে সক্রিয় শিবের প্রসঙ্গটি দ্বিমাত্রিক ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে। শুধু শিবমন্দির নয়, মাইকেল একটি মসজিদেরও কথা বলেছেন। বামুনে ও যবনে মিলে, মন্দির ও মসজিদে মিশে, শিব তখন চিরকালীন একটি ন্যায় দর্শনের প্রতীক হয়ে গেছেন। শিবমন্দিরের সঙ্গে শক্তিরও আবির্ভাবের কথা বলা হয়েছে। এও ভক্তপ্রসাদের সমস্ত তত্ত্বের সঙ্গে জড়িত। ভক্তপ্রসাদ তাঁর অর্থ দণ্ডকে একটি 'দক্ষিণা' রূপে দেখেছেন। “এ কর্মের দক্ষিণান্ত এইরূপেই হওয়া উচিত।” তাঁর শেষ মন্তব্য— “এখন নারায়ণের কাছে প্রার্থনা করি যে এমন দুর্মতি যেন আমার আর কখনও না ঘটে।” তখন দেবতার কাছে প্রসাদ প্রার্থী ভক্ত—তাঁর 'ভক্তপ্রসাদ' নামটি সার্থক করে তোলেন। নাট্যকার বিশেষ বিবেচনা করেই নামটি দিয়েছেন, তা বোঝা যায়। অর্থাৎ সবদিক বিচার করে দেখলে দেখা যায়, ধর্ম ও পুণ্য কাজের সঙ্গে ভক্তপ্রসাদ নিজের কর্মাবলীকে জড়িয়ে নিয়ে একটি নৈতিক বিশুদ্ধতার সৃষ্টি করেছেন। 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' নামকরণের মধ্যে তা নেই। 'ভগ্ন শিবমন্দির নামে এক্ষেত্রে একাধিক ব্যঞ্জনা আছে।


সর্বোপরি বলা যায়, কতকগুলি শিথিল-বিন্যাস দৃশ্যের সমষ্টি নিয়ে সাময়িক কোনো বিষয়কে ব্যঙ্গ করবার যে নাট্যপ্রয়াস তাকে বলে 'Revue'। আলোচ্য নাটকটিকে সে পর্যায়ে ফেলা যায় না। গ্রিক এবং ল্যাটিন শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রভাবে, চতুর্দশ শতকে ইতালিতে যে রেনেসাঁস দেখা দেয় তার গুরুত্ব ছিল মানুষের বুদ্ধি ও মনন-এর ওপরে; এবং এই বিশ্বাসের ওপর মানুষের কর্মাবলীকে সামগ্রিক ও অখণ্ড দৃষ্টিতে না দেখলে তা দুর্বোধ্য থেকে যায় ; ‘ভগ্ন শিবমন্দির’ নামের মধ্যে ভক্তপ্রসাদকে সেই সামগ্রিক দৃষ্টিতে দর্শন ও প্রদর্শনের আয়োজন আছে। তাই, স্বীকার করতে হয় আলোচ্য প্রহসনটির নামকরণ বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁর চেয়ে 'ভগ্ন শিবমন্দির’ বেশি তাৎপর্যবাহী ছিল।