সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'বধূ' কবিতাটিতে শব্দ ও চিত্রকল্পের বিন্যাস কতখানি যথাযথ হয়েছে তার পরিচয় দাও।

কবিতার আঙ্গিক বিন্যাস বা কারুকর্মের উভয় পর্বেই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একজন দক্ষ শিল্পী। এই কারু দক্ষতা প্রথম থেকেই তাঁর কবিতায় অর্জিত। শুধু অর্জিত বললে কম বলা হয়, প্রথম থেকেই এ বিষয়টিতে তাঁর অধিকার এত অনায়াস এবং স্পষ্ট যে, সতর্ক পাঠক তা লক্ষ্য করবেনই। মাত্র বত্রিশ পৃষ্ঠার সামান্য পরিসরে গড়ে ওঠা কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিকেই তিনি যথেষ্ট আলোড়ন জাগিয়েছিলেন। এই আলোড়নের কারণ হিসাবে কবির বিশ্বাস ও স্বরগ্রামের প্রবল ওঠানামাই একমাত্র দায়ী নয়, কাব্যকলাকৌশলগত নৈপুণ্যও তার একটা বড়ো কারণ ছিল। অজস্র দেশী, অন্ত্যজ শব্দের নির্বাচন ও বিমিশ্র ব্যবহার ছন্দের বিচিত্র পরীক্ষা নিরীক্ষার সাফল্য, উচ্চারণগত লৌকিকভঙ্গি ; ক্রিয়াপদহীন ছেদচিহ্নশূন্য সংক্ষেপিত বাক্যগঠনরীতি, ব্যঙ্গবিদ্রূপের শানিত প্রয়োগ এবং রূপকল্পগত প্রতীকের সচেতন নির্মাণ তাঁর কবিতায় স্বতন্ত্র একটি আবহ সৃষ্টি করেছিল একথা বলা যায় । একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদ ও ধর্মবিশ্বাসের নিপুণ বলিষ্ঠতা যে এ পর্যায়ে কবির সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করেছিল, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।


কবিতার শরীরী নির্মাণের দিক থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় কোনো নির্দিষ্ট গঠন সচেতনার অনুসরণ করেননি। নাট্যধর্মী অবয়ব গঠনের মাধুর্যই সেখানে ধরা পড়েছে বেশি। ছন্দ ভাবনাতেও তিনি সিদ্ধ কারণ সবরকম ছন্দ নিয়েই তিনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। বিষয়টিতে তাঁর সাফল্যও তুলনাহীন। কবিতার রূপক ও প্রতীকগুলিকে অনেক বেশি তাৎপর্যবাহী করে তুলেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। যদিও সেই তাৎপর্যের বেশির ভাগটাই রাজনৈতিক ও সামাজিক বাণী নির্মাণ। কবিতায় রূপক ও প্রতীকের নৈসর্গিক ভাববিলাস তিনি কমই রচনা করেছেন। অতি সামান্য, তুচ্ছ মুখের কথাকে তিনি প্রায় বেতের মতো খুব শানিত করে ব্যবহার করেছেন। আঙ্গিকগত এ কলাকৌশলের কারণেই কবিতাকে ছিপছিপে নৌকার মতো করে নিয়ে সে পাড়ি জমিয়েছে দূরে দূরান্তে। কোথাও তা জাতিগত গুরুভার হয়ে পথরোধের কারণ হয়নি। শব্দের প্রতি কোনো স্বাভাবিক মোহজনিত কারণ বা দুর্বলতা তাঁর কবিতায় কখনও প্রশ্রয় পায়নি। চলতি-মৌখিক শব্দ ব্যবহারের অনুষঙ্গ তার কবিতায় প্রথম থেকেই রয়েছে। ফলে আপাত নিস্তরঙ্গ শব্দবাতি থেকে জীবনের অত্যুজ্জ্বল প্রকাশ কখনও ম্লান হয়ে যায়নি তাঁর কাব্যে। পাঠক যে-কোনো আঙ্গিকে সেই শব্দবাতি সাজিয়ে নিজ নিজ অভিলসিত অর্থকে প্রতীকায়িত করে নিতে পারতেন। প্রতিটি শব্দের ক্ষেত্রেই তাই স্বতন্ত্র অনুষঙ্গ দীপ্তিমান হয়ে উঠেছে কবিতার সম্পূর্ণ গঠন আশ্রয় করে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার আরও একটি প্রধান গুণ হল মানবতাবাহী বাক্‌বিন্যাস-চিত্রকল্পের সহজ প্রকাশ। সমাজে তিনি কখনও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে চাননি। জনতার সাথে সংযুক্ত হয়ে থাকবার প্রেরণাতেই সমগ্র জীবনদর্শন তার কাব্যে শব্দ-চিত্রকল্পের সহজ বিন্যাস নিয়ে প্রতিফলিত হয়েছিল।


নতুন যুগের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নতুন জীবনাদর্শ ও চিন্তা চেতনায় রবীন্দ্র উত্তরাধিকার অন্য মাত্রা পেয়েছিল সেদিন। শব্দ চিত্রকল্পের বাণী বিন্যাসও তার ব্যতিক্রম নয়। রবীন্দ্রনাথের 'বধূ' সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আকাঙ্ক্ষায় একেবারে অন্যরূপ পেয়েছে। নাগরিক জটিলতার প্রান্তভূমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে অন্যরকম সঙ্কটের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। ঘনিয়ে ওঠা ক্রান্তিলগ্নের সঙ্গে নিজেকে সে মানিয়েও নিয়েছে অনেকখানি। বদলে দিয়েছে তার গ্রাম্যবধূসুলভ অনেক আচার-আচরণ। সমাজ চেতনার কবি নাগরিকতার নানা অভিজ্ঞানকে শব্দ চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবিতাটির স্তবকে স্তবকে তুলে এনেছেন, ‘ফেরিওলার ডাক’ ‘বেতারের তরঙ্গ', আর 'গ্যাসের আলো জ্বলা' সান্ধ্য রাজপথ বধূটির নাগরিক হয়ে ওঠবার স্বীকৃতি বহন করে আনে। শহর তার অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে। আবার বদলেও দিয়েছে তার চিন্তা চেতনাকে। কারণ গ্রামের সুখস্মৃতি বধূটির মনে নিছকই আনন্দময় জীবনের অনুষঙ্গ রূপে আসেনি। তা এসেছে অনেক লাভ-ক্ষতির হিসাব কষেই। ‘দীঘির কালো জলে’ অরণ্যময় জীবনের ছায়া শুধুমাত্র প্রাণের আরাম বহন করে আসেনি কবিতায়। বধূটি যখন বলে সেখানে ছিপ ফেললে দু-একটা রুই-কাতলা মাছও পাওয়া যেতে পারে তখন নাগরিক জীবনের ক্ষুন্নিবৃত্তির চেষ্টা যে বধূটিকে নিরীহ সরল গ্রাম্যনারী থেকে অনেকখানি জটিল করে ফেলেছে সেকথা বোঝা যায়। গ্রামজীবনে ফিরে গিয়ে তারা যদি পরিচয়হীনভাবে গেরুয়া পোশাক পরে ঘাটের ধারে বসে থাকে, তাহলে দু-এক কানাকড়িও মিলতে পারে। কারণ সে হৃদয়পুরে রাজধানীর পাষাণী মূর্তি কখনও আসতে পারে না। রাজধানীর পাষাণ পিঞ্জরে তেজারতির মতো মূল্যবান ব্যবসা করতে পারলে দুদিনেই তা দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসে। বুর্জোয়া সমাজের ধনতান্ত্রিক বিনিময় সম্পর্কে যাবতীয় মূল্যবান, ধ্যান-ধারণা যে ফিকে হয়ে যায় সেকথাও জেনেছে মেয়েটি। জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধতা এ শহরে মন ভরিয়ে দেয় না, বরং চিনিয়ে দেয় সুদখোর কাবুলিওয়ালা মহাজনের দাপুটে চেহারাকে।


রবীন্দ্রকাব্য 'মানসী'র ‘বধূ' কবিতাটির কথা এ প্রসঙ্গে বারবার মনে আসে। সেখানেও গ্রাম্য বধূটির জীবনে শহুরে জীবন একাকীত্ব, এবং উষ্মতাহীন সম্পর্কের তীব্র কৃত্রিমতা নিয়েই উপস্থিত হয়েছিল। চারপাশের মানুষজনের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপনের সংযোগহীনতা এখানেও প্রতিটি মুহূর্তেই বিচ্ছিন্ন এক বিপন্নতাবোধে অস্থির করে তুলত মেয়েটির জীবন, কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায় যে ‘বধূ'র চিত্র এনেছেন সে নাগরিক মনস্তত্ত্বের তীব্র টানাপোড়েনে, মধ্যবিত্ত জীবনের অনিশ্চয়তায়, নিরাপত্তাহীন অর্থনৈতিক সঙ্কটে প্রবলভাবে দীর্ণ। রবীন্দ্রসৃষ্ট বালিকা বধূটির চোখে তবু যেন কোনো স্বপ্ন ছিল, সে স্বপ্নকে বুকে চেপে রেখে নিরন্তর এক মায়ার জাল রচনা করেছিল সে। কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বধূর ক্ষেত্রে সংশয়ের প্রবল দোলাচলতায় তা একেবারেই চূর্ণবিচূর্ণ। কারণ প্রিয় মানুষটিও তাকে এই অনিশ্চিত পৃথিবীতে একলা ফেলে উধাও হয়ে গেছে।


নাগরিক সংকটের এই তীব্র টানাপোড়েনেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিক উচ্চারণটি একেবারে আলাদা হয়ে গেছে। শব্দ বাক্য-চিত্রকল্পের নৈসর্গিক বিকাশ রবীন্দ্রনাথে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছিল, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ'র ক্ষেত্রে তা একেবারেই বিপ্রতীপ। বদলে যাওয়া এই জীবনবোধই ভাষা ও চিত্রকল্পে শানিত ব্যঙ্গের চাবুক মেরেছে বারবার। তাই 'কাঁখে', 'দিঘি', ‘দোঁহে', 'অঙ্গে', 'হেথা’, ‘মরণ' প্রভৃতি রাবীন্দ্রিক শব্দের পাশে নাগরিক প্রভাবজাত শব্দ ‘ফেরিওয়ালা’, ‘বেতার’, ‘গ্যাস', 'কলে’, ‘খাসা', 'মাশুল', 'তেজারতি', 'পুঁজি', 'পেশোয়ারি', ‘লেক’ প্রভৃতি রয়েছে। শব্দ-চিত্রকল্পের নিদারুণ বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন কবি, কবিতাটির ভাবগত চলমানতাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য। প্রায় একই ভাবকে দ্বিতীয় ও শেষস্তবকে দুবার উচ্চারণ করিয়ে কবি যেন গ্রাম্য মেয়েটিকে অনেক বেশি নাগরিক বধূতে রূপান্তরিত করেছেন,

“কাছেই পথে জলের কলে, 

সখা কলসি কাঁখে চলছি মৃদু চালে।”


কবিতাটির প্রথমে উনিশ শতকের একেবারে শেষ লগ্নের কলকাতার সরু গলিপথে সন্ধ্যা নেমে আসার চিত্র দেখিয়েছেন কবি। নাগরিকতা যে শুধু মানুষকে বদলে দেয় তা নয়, সেইসঙ্গে সে গ্রাস করে গ্রাম। গ্রামের সৌন্দর্য ও সবুজ স্বপ্নময়তা। শহর কারখানা, বণিকি বাণিজ্যনীতি ধানক্ষেতের বদলে এখন কালোধোঁয়া ভরা চিমনি দেখতে ভালোবাসে। আর সেই বদলে যাওয়া সময়ের হাত ধরে নাগরিক বধূটি পরবর্তী স্তবকগুলিতে তার ক্রিয়াশীলতার কথা জানিয়ে দিয়েছে। 'বেলা পড়ে গিয়ে সন্ধে নেমে আসার ব্যাকুল প্রত্যাশা মেয়েটির কাছে এবং সমগ্র পাঠক সমাজের কাছেই অন্য রূপকল্পের সন্ধান দেয়। এই দিন শেষ হয়ে আসা আসলে উনিশ শতক শেষ হয়ে বিশ শতকের অন্ধকার দীর্ণ সন্ধিলগ্ন সমাগত হওয়া। দ্বিতীয় স্তবকে নাগরিক বধূটি নিজের ক্রিয়াশীলতার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামজীবনে স্মৃতিচারণার কথা বলেছে। কিন্তু সেই স্মৃতি যে পথ ধরে তার কাছে এসে পৌঁছেছে সেটি খুব সরল বা সহজ পথ নয়। গ্রামের সুখস্মৃতি তার হৃদয়ে 'হানা' দিয়েছে। অর্থাৎ কাঁখে কলসি রয়েছে। বধূটি চলেছে জল আনতে। কিন্তু দীঘির গহীন কালো জলে গাছের ছায়াঘেরা কোমল শান্ত প্রকৃতির মধুর সম্ভাষণটি নেই। তাই গ্রামজীবন বধূটির কাছে হঠাৎ হানা দেওয়া একটা অতীত জীবন শুধু। হয়তো নাগরিক কূটপ্রবৃত্তি তাড়িত জীবনের চেয়ে সে জীবন অনেক উদার। কিন্তু নাগকির সত্তা দ্বারা জারিত বধূটির কাছে ভালোত্বের শব্দনির্বাচনও ‘খাসা’ শব্দ তাড়িত হয়ে গেছে। এর পরই আছে শহরের বিপর্যস্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে গ্রামজীবনের নিবিড় নষ্টালজিয়া। পঞ্চম স্তবকে চিত্রকল্প ধনতান্ত্রিক বুর্জোয়া জীবনের নিবিড় প্রতিফলক হয়ে উঠেছে। সমাজ-অর্থনীতি, রাজনৈতিক পালাবদল কবিতার মতো অনুভবী উচ্চারণগুলিকেও কীভাবে বদলে দিতে পারে ‘বধূ’ কবিতাটি তার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। বুর্জোয়া ধনতন্ত্রের নির্মম অবস্থানটি বুঝে নেওয়ার পরই নাগরিক বধূটির সামনে উন্মোচিত হয় গেছে একান্ত নির্ভরতার সেই পরম আশ্রয়টির বিশ্বাসঘাতকতা। প্রিয় পুরুষটি যখন এই নিবিড় অনিশ্চয়তায় তাকে একলা ফেলে উধাও হয়ে যায়, তখন বিপন্নতা যেন তাড়া করে বেড়ায় অজস্র মানুষের মাঝেও। তাই ‘সবার মাঝে একলা ফিরি আমি’ বাক্যবন্ধটি লক্ষণীয়। অসহনীয় গ্লানিময় জীবন থেকে মুক্তির আকুলতাই মেয়েটিকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুময় এক জীবনের প্রান্তভূমিতে। গ্রামীণ ‘দীঘি' শহরে ‘লেক' হয়ে গেছে। আর ‘লেকে'র বুকে মৃত্যুও বড় অকরুণ। কারণ মৃত্যুর কৃপাদৃষ্টি নাগরিক বধূটির ওপর পড়ে না। সে শুধু চিন্তাই করেছে, সত্যিকারের মৃত্যু যেন এই শহরবাসের কারণেই তাকে স্পর্শ করেনি কখনও। মৃত্যুময় চিন্তার মাঝখানে ‘যেন’ শব্দের সংশয়াত্মক উপস্থাপনা আমাদের বুঝিয়ে দেয়—এ তার সাময়িক কল্পনামাত্র। আসলে আত্মবিনাশের ক্ষয়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের হাতে জীবন সংরাগে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কবিতাটির শেষাংশে। মৃত্যুকেই তিনি মেয়েটির জীবনের চরম পরিণাম রূপে চিহ্নিত করেননি। পরিবর্তে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের অস্তিত্বকে মানিয়ে নেবার তীব্র বক্তৃতায় আধুনিক জীবনকে পুরোপুরি গ্রহণীয় করে তুলেছে। কবিতাটির শেষাংশে প্রথম পংক্তিটির পুনরাবৃত্তি রয়েছে। 'গলির মোড়ে বেলা যে পড়ে এল’ এই চিত্রকল্পটি প্রাত্যহিক দিনাবসানের ইঙ্গি’তই শুধু করেনি, সেই সঙ্গে নাগরিক পরিবেশের বহু ব্যবহৃত অর্থহীন জটিলতায় এক ধরনের ক্ষয়ের অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছে। এই ক্ষয় জীবনের শুদ্ধ সরল জীবনবোধের অবসানের প্রতীক এটি। সর্বোপরি কথ্য ও মৌখিক ভাষার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে, বাস্তবতার চূড়ান্ত দিকনির্দেশে কবিতাটির শব্দ-চিত্রের ব্যাখ্যা অনেকাংশেই সার্থক হয়ে উঠেছে বলা যায়।