'ফুল্লরার বারমাসের দুঃখ' এবং 'চণ্ডীর নিকটে পশুগণের দুঃখ-নিবেদন' অংশে কবি নিজের অভিজ্ঞতা উজাড় করে য়ছেন।—মন্তব্যটি উদ্ধৃতিসহ বিচার করো।

সমগ্র মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে বাস্তবধর্মী, জীবনরসে পরিপূর্ণ রচনা হল কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল' কাব্য। কাব্য ‘ফুল্লরার বারমাস্যা’ অংশে কবি দেখিয়েছেন বাঙালী জীবনের দুঃখ দারিদ্র্যকে। কাহিনি প্রসঙ্গে ষোড়শী রমণীরূপী দেবী চণ্ডিকা ফুল্লরা কালকেতুর গৃহে এসেছেন দুঃখ-দ্রারিদ্র্য দূর করতে এবং তাদের দ্বারা মর্ত্যে পূজা পাবার আশায়। দেবীর দ্ব্যর্থ বোধক ভাষায় আত্মপরিচয় দান মূর্খ ফুল্লরা বুঝতে না পেরে সতীন ভয়ে ভীত হয়ে নিজের দুঃখ বর্ণনা করে দেবীকে বিতাড়িত করতে চেয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে ফুল্লরার বারমাস্যা উল্লিখিত হয়েছে।


ফুল্লরা যেখানে বাস করে সেই ঘরটি তালপাতার ছাওয়া, ভাঙা কুঁড়ে ঘর কালবৈশাখীর ঝড়ে ভগ্ন প্রায়। বৈশাখের দাবাদাহে কোথাও যে গাছ নেই একটু স্বস্তি পাবে পশরা রেখে একটু জিরোবে। অথচ মাংস বিক্রি করতে না পারলে ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটাতে হবে। জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড সূর্যতাপে শরীর যেন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তৃস্থায় কন্ঠ শুকিয়ে গেলেও পশরা রেখে একটু জলখাবার উপায় নেই তার। ফলে বৈঁচির ফল খেয়ে তাকে জ্যৈষ্ঠে পশরা বিক্রি করতে হয়। আষাঢ় মাসে বর্ষায় বড়বড় গৃহস্থের ঘরেও কিছু সম্বল থাকে না। তাই পশরা নিয়ে ঘুরে যা কিছু খুঁদ কুঁড়ো জোটে তাতে উদর পূর্তি হয় না। এই দুঃখে সান্ত্বনা পেতে ফুল্লরা বাবা মাঁকে দোষ দেয়। শ্রাবণ মাসে অঝোর ধারায় দিবানিশি বর্ষণ হয়, ফলে মাংস বিক্রি বন্ধই থাকে। ভাদ্রে তথৈবচ-

“শুন মোর বাণী রামা শুন মোর বাণী।

কোন সুখে মোর সাথে হইবে ব্যাধিনী।।”


আশ্বিন মাসে সকলে পূজার প্রসাদী মাংস খায়। তাই ফুল্লরার নিকট কেউ মাংস কেনে না। কার্তিক মাসে দারুণ হিম পড়ায় সকলে গরম পোষাক কেনে মাংস কিনবে কে? পৌষ মাসে কোনও রকমে খোলস গায়ে দিয়ে তার দিন কাটে। মাঘ মাসের শীতে পশুদের হদিশ পাওয়া যায় না। শাকান্ন যে খাবে তারও উপায় নেই—

“মাঘ মাসে কাননে তুলিতে নাহি শাক।”


যে মধু মাসে বনিতা ও পুরুষ মদনের শরে জর্জরিত থাকে, সেই মধুমাসে ফুল্লরার ‘অঙ্গ পোড়ে উদর দহনে'। চৈত্র মাসে মৃন্দুমন্দ বাতাস বয়, মধুকর মালতীর মধুপান করে। চৈত্রের খরায় অভাগী ফুল্লরাকে একমাত্র সম্বল খাওয়ার পাত্রটিও বন্ধক দিতে হয়। বারমাস্যা বর্ণনা করতে করতে ফুল্লরা এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। অভাগিনী ফুল্লরা এতদিন সব দুঃখ সহ্য করেছে। তার কারণ স্বামীর প্রতি নিঃসপত্ন অধিকার। প্রেমের রাজ্যে সে সম্রাজ্ঞী, স্বামীর গর্বে গরবিনী হয়ে সে এতদিন সব জ্বালা যন্ত্রণা দুঃখ কষ্টকে সহ্য করে এসেছে কিন্তু তার এই প্রেমে যখন অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করতে এসেছে তখন সে আর স্থির থাকতে পারল না।

কাঁদতে কাঁদতে ফুল্লরা স্বামীর সন্ধানে বার হল ফুল্লরাকে দেখে কালকেতু বলে—

“শাশুড়ী ননদী নাহি নাহি তোর সতা।

কার সঙ্গে দ্বন্দ্বকরি চক্ষু কৈলি রাতা।।”


ফুল্লরা অভিমানের সুরে বলে—

“পিপীড়ের পাখা উঠে মরিবার তরে।

কাহার ষোড়শী কন্যা আনিয়াছ ঘরে।।”


কালকেতু একথা শুনে রেগে যায়, সে পরস্ত্রীকে মাতৃসমা জ্ঞান করে।


বারমাসের কাহিনি যাতে বর্ণিত হয় তাকে বারমাস্যা বলে। ফুল্লরার বারমাস্যা কাহিনিতে দুঃখের বর্ণনা রয়েছে বলে মুকুন্দরামকে দুঃখবাদী কবি অনেকে মনে করেন। এতে ফুল্লরার অভাব অনটনের কথা বর্ণিত থাকলেও ফুল্লরার দুঃখবোধ নেই। দুঃখের সম্বন্ধে কাতর ক্রন্দন নেই। বাইরে থেকে তাকে দুঃখীবলে মনে হয়। এটি তার ছলনা। দুঃখের কথা উল্লেখ করে সে ষোড়শী রমণীকে তাড়াতে চায়। তাই ফুল্লরার বারমাস্যা বাস্তব জীবনরসের আধার। দুঃখবোধটাই ছলনা। যেমন ছলনা ছাড়া প্রেম হয় না ঠিক তেমনি মুকুন্দরাম ফুল্লরাকে দিয়ে ছলনা করিয়ে কাব্যকে বাস্তব রসাস্বাদিত করতে চেয়েছেন।


মুকুন্দরাম মানব আকুতিকে পরিস্ফুট করেছেন 'চণ্ডীর নিকট পশুদের ক্রন্দন' অংশে। ক্ষুদ্র সজারু থেকে বৃহৎ হস্তী কেউই কালকেতুর কাছে রেহাই পায়নি। বনে ঢুকে বাঘ মারা স্বাভাবিক। ডিহিদার মামুদ যদি তালুকদার জমিদারের উপর অত্যাচার করত তবে তা সঙ্গত না হলেও অশোভন হত না। কিন্তু কি বলে সে কবির মতো ক্ষুদ্ৰব্যক্তিকে উৎখাত করল? তাই তো ভালুকের জবানীতে কবি বলেছেন—

“নেউগী চৌধুরী নই না রাখি তালুক।”


লক্ষণীয়, মশা মারবার জন্য কামান দাগার মধ্যে যে অসঙ্গতি রয়েছে কবির কৌতুক প্রিয়তা তাকে অবলম্বন করেই বিকশিত হয়েছে।


যাইহোক কালকেতুর অত্যাচারে নিরুপায় পশুরা তমাল তরুমূলে চণ্ডীর কাছে গিয়ে উপস্থিত হয় এবং নিজেদের দুঃখ বর্ণনা করে। পশুগণের এই ক্রন্দন ও বিলাপে নিহিত রয়েছে তৎকালীন শোষিত মানুষের কাতর ক্রন্দন—

“প্রাণের দোসর ভাই গেল পরলোক। 

উদরের জ্বালা আর সোদরের শোক।।”


সামস্তশ্রেণির অত্যাচারে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মর্মকথা ভালুকের ধ্বনিতে প্রকাশিত—

“উই চারা খাই পশু নামেতে ভালুক ।"


তখন একদিকে যেমন দুর্বলের করুণ অসহায় রূপটি ফুটে ওঠে অন্যদিকে জীবনরসিক মুকুন্দরামের স্বচ্ছ পরিহাস তরল জীবন দৃষ্টির শানিত বিদ্যুৎ চমকের মতো দুঃখ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। তাই বৃহৎ হস্তী দেবীর নিকট আকুতি জানায়—

‘বড় নামে বড় গ্রাম বড় কলেবর।

লুকাইতে স্থল নাই অরণ্যের ভিতর।”


এই দুঃখ সায়রে বানর পর্যন্ত অংশগ্রহণ করতে ভুল করেনি। অন্যদিকে হুকহুক করে কাঁদতে কাঁদতে সজারু বলে—

“চারি পুত্র মৈল মোর মৈল চার ঝি।

মাগু মৈল বুড়াকালে জিয়া কাজ কি।।”


এটা শুধু সজারুর বিলাপ নয়। সমগ্র ষোড়শ শতকের নিপীড়িত শোষিত বাঙালীর বিলাপ। মানুষ যখন শোষণে অত্যাচারে জর্জরিত হয় তখন নিভৃতে কাঁদা এবং দেবতার চরণে ঠাঁই নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।


পশুগণের করুণ আহ্বানে দেবী আবির্ভূত হলেন। দেবী তাদের বললেন, তারা এত শক্তিশালী হয়েও কালকেতুর কাছে পরাভব স্বীকার করছ কেন? তারা বলে তাদের চেয়ে কালকেতু বেশি শক্তিশালী, যে অলক্ষ্য থেকে যুদ্ধ করে তার সঙ্গে পেরে ওঠা দায়। দেবী অভয় দিয়ে বললেন—

“আজি হতে মনে কিছু না করিও ভয়। 

না বধিবে মহাবীর কহিনু নিশ্চয়।।”


অতপর চণ্ডিকা এক স্বর্ণ গোধিকা রূপ ধারণ করে কালকেতুর যাত্রাপথে শয়ন করলেন এবং কালকেতু দেবীর সান্নিধ্যে এসে পশু শিকার হতে বিরত থাকল।