মানবিক জীবনের মধ্যবর্তিতায় দিব্যজীবনের আলো ফুটিয়ে তোলা বৈষ্ণব কবিদের উদ্দেশ্য ছিল। তোমার পাঠ্য কবিতা অবলম্বনে মন্তব্যটি বিচার করো।

দুটি জগৎ নিয়ে আমাদের চলাচল, বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ। অন্তর্জগতে কতকগুলি ভাব সুপ্ত ভাবে রয়েছে। বহির্জগতের দৃশ্য-গন্ধ-গান ইন্দ্রিয়পথে অন্তর্জগতে প্রবেশ করে। তখনই একএকটি বিশেষ বিশেষ ভাব জেগে ওঠে। ভাব এবং রূপের রসপরিণতির মূল কথাটি হল, অনুভূতি। লৌকিক অনুভব ব্যক্তিগত উপলব্ধির সীমা পেরিয়ে সার্বজনীন সহৃদয়তায় রূপান্তরিত হয়। এখন প্রশ্ন হল বৈক্ষ্ণব পদাবলীতে ভাবের রসরূপ, অর্থাৎ ব্যক্তিক বা শ্রেণিগত আবেদনের কোনও সার্বজননীন রসোপলব্ধি আছে কি?


বৈষ্ণব পদবলীতে রাধা কৃষ্ণ প্রেমলীলা অপ্রাকৃত। ভক্তের বিশেষ দৃষ্টিতে ভাববৃন্দাবনে এই লীলা প্রত্যক্ষ করতে হয়। বৈবকবিরা আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন, নর-নারীর প্রাকৃত ভালোবাসার দৃষ্টিতে যেন আমরা পদবলীর রসসৌন্দর্যকে গ্রহণ না করি। আমাদের প্রশ্ন হল, মানবীয় প্রেম অর্থেই কি কামনা বাসনা ?–সে প্রেমকি কাম গন্ধের ঊর্ধে পঙ্কজ হয়ে ফুটে উঠতে পারে না? যে প্রেমের দেবতাকে ভক্ত কল্পনা করে, মানবীয় জীবনের অভিজ্ঞতার উপাদানেই তো তাকে গড়া হয়, তাছাড়া মানুষ পাবে কোথায় ? রবিঠাকুরের ভাষায়-

“আর পাব কোথা,

দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়রে দেবতা।”


বৈষ্ণব কবিরাও এই প্রিয়কেই দেবতা করেছেন। তার প্রমাণ রাধিকার রূপবর্ণনায়, কৃষ্ণের জন্য বিরহে, প্রিয়সম্মিলনে সকল রকম পদেই আছে, বয়ঃসন্ধির কিশোরী প্রেমিকা রাধার ছবি এঁকেছেন বিদ্যাপতি—

খনে খনে নয়ন কোণ অনুসরই।

খনে খনে বসনধূলি তনু ভরই।

খনে খনে দশন ছটা ছুট হাস,

খনে খনে অধর আগেকরু বাস


রাধার যৌবন মুকল একটু একটু করে বিকশিত হচ্ছে। কখনও সে যুবতীর মতো চোখে কটাক্ষ হানে কখনও কিশোরীর মতো বসনের ধূলি মাখে, কখনও অল্প অল্প হাসে। কখনও বসনে মুকঢাকে নবীন যৌবন চেতনায় বিদ্যাপতি এই নব যৌবন স্বাদ-প্রাপ্ত কিশোরী রাধিকার ছবিতে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অনুভূতির ঊর্ধ্বে মহাভাবস্বরূপিনী শ্রীরাধিকাকে যতই কল্পনা করুন, কবিকে এই বাস্তব প্রেমের জগৎ থেকেই তথ্য আহরণ করে রাধিকাকে সাজাতে হয়েছে।


বৈষ্ণব মহাজনেরা বৈশ্বব প্রেমতত্ত্বকে এক গভীর উদার দৃষ্টিতে গ্রহণ করেছিলেন। উপনিষদ বলে, আনন্দ থেকে সফলের জন্ম। আনন্দে সকলের মিলন, সব কিছুর পরিণতি আনন্দে। বৈব করিবারও কতকটা একই সুরে বলতে চেয়েছেন—প্রেমেই সকলের জন্ম, প্রেমেই মিলন, প্রেমেই শেষ পরিণতি। কান্তাকান্ত সন্মিত মধুর প্রেমই ধর্মপথ। এযুগের মানব প্রেমিক কবি রবীন্দ্রনাথের কথাই আবার মনে পড়ে—

এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত্য ছেয়ে

সব চেয়ে পুরাতন কথা, সবচেয়ে 

গভীর ক্রন্দন, ‘যেতে নাহি দিব'।


এই অনস্ত চরাচরে অতি ক্ষুদ্র তৃণ থেকে, সমুদ্রের ভৌমপ্রবাহ পর্যন্ত সবই পরস্পরকে ধরে রাখতে চায় প্রেমের আকর্ষণে। মর্ত্যের মানুষের কবি রূপের আধারে অরূপের সুধা পরিবেশন করেছেন। বৈক্ষ্ণব কবি ভক্ত রাধার প্রেমে অনন্ত প্রেমময় কৃষ্ণকে মর্ত্য লীলাভূমির বৃন্দাবনে টেনে এনেছেন।

পূর্বরাগে রাধার একটি ছবি- 

“নহাই উঠল তীরে রাইকমলমুখী

সমুখে হেরল বর কান, 

গুরুজন সঙ্গে লাজে ধনি নবমুখী

কৈসনে হেরর বয়ান।”


এত আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার সাথে সাথে সাধারণ মানুষের রূপক এই ছবিটিই রসম্বাদ নর পক্ষে যথেষ্ট। আর সের সের মূল্য ও কিছুকম নয়। মাটির পৃথিবীর প্রেম স্পর্শ পদে বিদ্যমান। রাধিকার চির অতৃপ্ত প্রেমিকার ছবিটি অ্যাধ্যাত্মিক অতৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ—

“জনম অবধি হম রূপ নিহারলু

নয়ন না তিরপিত ভেল। 

সই মধুর বোল শ্রবণহি শুনলু

শ্রুতি পথে পরশ ন গেল।।"


জনম অবধি তোমার রূপ দেখে অতৃপ্ত। তোমার মধুর এতকথা শুনেও মনে হয় যেন কিছুই শুনিনি এখনও। কালিদাস, রবীন্দ্রনাথ, শেলী, কীটস্ত্ত এই চিরন্তন প্রেম-অতৃপ্তির কথাই বলেছেন।


বৈষ্ণুব কবিদের বৈশিষ্ট্য হল, তাঁরা জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রেম অনুভূতিকেই ধর্মের তত্ত্বরূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। পৃথিবীর মানুষের প্রেম বেদনার চিরন্তন অনুভূতি বৈব প্রেমধর্মকে সঞ্জীবনী শক্তি দিয়েছে। যে ধর্ম মানবীয় জীবনকে যতটা স্পর্শ করতে পেরেছে, তাদের সুখ দুঃখের যত কাছাকাছি আসতে পেরেছে সে ধর্মের গতি তত প্রাণৈশ্বর্যময় । সুতরাং বৈক্ষ্ণব ভক্তদের লজ্জিত বা ক্ষুদ্ধ না হয়ে গর্ব বোধ করা উচিত যে তাঁরা এমন এক মানবীয় সত্যকে চিরন্তন কাব্যে রূপান্তরিত করতে পেরেছেন, সম্প্রদায় বিশেষের ধর্মকে গন্ডীর সীমা পেরিয়ে সর্ব মানবীয় আবেদনের রসরূপ দিতে পেরেছেন। জীবনের আচরণীয় সত্যকেই মূলত ধর্ম বলা হয়। চলমান জীবনের সত্যের সাথে যার যোগ নেই তা ধর্ম নয়, ধর্মের কঙ্কাল মাত্র, বৈব মহাজনেরা এমন কিছু সৃষ্টি করেছেন যার ফলে পাঁচশত বছর ধরেও তাঁদের ধর্মচেতনা ‘ফসিল’ না হয়ে সুস্থ জীবনের ধারা বহন করে চলেছে। বৈব সাহিত্যের এবং ধর্মের এটুকুই পরম গৌরবের কথা।