ধর্মমঙ্গল কাব্যে খেলারাম চক্রবর্তী, ময়ূরভট্ট, যাদুনাথ বা যাদবনাথ পণ্ডিত, সীতারাম দাস, রামদাস আদক, ধর্মদাস, শ্যাম পণ্ডিত

ধর্মমঙ্গল কাব্যে শ্যাম পণ্ডিত :


ধর্মমঙ্গল কাব্যের এই কবি রাঢ় অঞ্চলের বাসিন্দা। তাই বীরভূম ও বর্ধমান অঞ্চল থেকেই তার অধিকাংশ পুঁথি পাওয়া গেছে। কাব্যের নামকরণ করা হয়েছে ধর্মদেবতার আর এক নাম নিরঞ্জনের নামে— “নিরঞ্জন মণ্ডল”। এই পুথিগুলি অবশ্য অধিকাংশক্ষেত্রে খণ্ডিত। তাছাড়া অন্যান্য কবির রচনার প্রক্ষিপ্ত অংশও তার মধ্যে বিদ্যমান। সেই কারণে রচনায় প্রাচীনত্ব এবং আঞ্চলিকতা থাকলেও অন্যান্য কবির রচনাংশ থেকে পৃথক করা অসম্ভব। শ্যাম পণ্ডিত লাউসেনের আত্মবিবরণীতে বল্লাল সেনের উল্লেখ করেছেন।


ধর্মমঙ্গল কাব্যে ধর্মদাস :

শ্যামপণ্ডিতের কাব্যে আত্মগোপন করে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন এই কবি ‘ধর্মদাস’ ভণিতায়। এঁর কাব্যের নাম ‘নিরঞ্জন মঙ্গল’। কবি নিজে ছিলেন বণিক সম্প্রদায়ভুক্ত। জন্মস্থান বসর গ্রাম। তবে ড. সুকুমার সেন বৈদ্যজাতিভুক্ত মন্দারণবাসী আর এক ধর্মদাসের নামোল্লেখ করেছেন। ধর্মদাসের ‘নিরঞ্জনমঙ্গল’ কাব্যে সৃষ্টিপত্তন বর্ণনা বিস্তৃত। রচনারীতি সহজ ও বাস্তবধর্মী। ইনি প্রধানত রূপরামের ধর্মমঙ্গলের আদশেই কাহিনী বিবৃত করেছেন।


ধর্মমঙ্গল কাব্যে রামদাস আদক :

১৩১১ সনে জনৈক মধুসূদন অধিকারী ‘সাহিত্যসংহিতা’ পত্রিকায় ‘অনাদিমঙ্গলের কবি’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানেই প্রথম কবি রামদাস আদকের নাম জানা যায়। তিনি কবি রচিত পুঁথি সবটা সংগ্রহ করতে পারেন নি। মৌখিকভাবে সংগৃহীত এই রচনার বাকী অংশ শুনেছিলেন রামদাসের উত্তরপুরুষদের (গায়কদের) কাছে। আরও পরে ১৩৪৫ সনে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে গবেষক বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু বসন্তবাবুরও এই কাব্য-সংস্থানের উৎস ছিল কবির বংশধরদের স্মৃতিবাহিত পয়ার-ত্রিপদীতে আবদ্ধ কবিতাবলী এবং গায়েনদের ব্যবহৃত একটি খাতা। আবার এই খাতায় রূপরামের রচনার সঙ্গে এত অধিক সাদৃশ্য দেখা যায়, যে কারণে ড. সুকুমার সেন বলতে বাধ্য হয়েছিলেনঃ “ইহার বারো আনাই রূপরামের, শুধু ভণিতা রামদাসের।” দ্বিতীয়ত, মধুসূদন অধিকারীর সংগৃহীত ‘আত্মপরিচয়’ অংশের সঙ্গেও এর যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। তৃতীয়ত, রামদাস তাঁর আত্মপরিচয়ে ধর্মঠাকুরকে বলেছিলেন

“পাঠ করি নাই প্রভু চঞ্চল হইয়া

গোধন চরাই মাঠে রাখাল লইয়া।”


কিন্তু বসন্তবাবুর পুঁথিতে রামদাস পণ্ডিত বাগবৈদগ্ধ্যের পরিচয়ে শক্তিমান। কাজেই “রামদাস আদকের মুদ্রিত অনাদিমঙ্গল সর্বাংশে প্রাচীন কিনা সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ হয়’” (‘বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, পুনর্মুদ্রিত নতুন সংস্করণ, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ১৫৪ ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)।


কবি রামদাসের কাব্যের উল্লেখযোগ্য অংশ হল ‘আত্মজীবনী’। ভুরসুট পরগণার রাজা প্রতাপনারায়ণের (কবি ভারতচন্দ্রের পূর্বপুরুষ) রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত আরামবাগের কাছে হায়াৎপুর গ্রামে রামদাসের জন্ম হয়। কবিরা ছিলেন জাতিতে কৈবর্ত। পিতার নাম রঘুনন্দন। শৈশবেই কবি মাতৃহীন। পৌষের কিস্তি খাজনা যথাসময়ে দিতে না পারার অজুহাতে জমিদারের লোক চৈতন্য সামস্ত কবিকে তিনদিন কয়েদ করে রাখে। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি যান মামার বাড়ি। পথে দেখেন শঙ্খ, চিল, মাথার উপরে মালা ইত্যাদি নানাবিধ শুভ চিহ্ন এবং সেইসঙ্গে ধর্মঠাকুরের ছদ্মবেশে সিপাহী। সিপাহী বালক কবির মাথায় মোট চাপিয়ে তাড়না করে, কিন্তু শেষে অদৃশ্য হয়। তারপর ব্রাহ্মণ বেশে আবার ধর্ম এসে দেখা দিয়ে কবিকে বলেন

“ধর্ম বলে রামদাস মূর্খ নও তুমি। 

জাড়গ্রামের কালু বামন হই আমি ৷৷

আসরে জুড়িবে গীত আমা সঙরণে। 

মুখেতে ঠেকিলে গীত চাইও কর পানে !! 

এত বলি ঠাকুর ধরিল তারি কর। 

মহামন্ত্র লিখি দিল দ্বাদশ অক্ষর৷” 


রামদাসের কাব্যে যে সন-তারিখের উল্লেখ দেখা যায়, তার ভিত্তিতে মনে হয় ১৫৮৪ শকাব্দ বা ১৬৬২ খ্রীস্টাব্দের ভাদ্রমাসের কৃষ্ণাষ্টমীতে কাব্যটি লেখা শেষ হয়েছিল।


তবে ভাষায় আধুনিক স্বচ্ছতা এবং কবি রূপরামের আচ্ছন্নতায় কবি রামদাসের কাব্যের প্রকৃত স্বরূপ অজ্ঞাত থেকে গেছে সমালোচকদের কাছে।


ধর্মমঙ্গল কাব্যে সীতারাম দাস :

অষ্টাদশ শতকে প্রাপ্ত পুঁথির ভিত্তিতে আলোচিত এই কবির কাব্যে আত্মকাহিনীর অংশটুকুই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কবির পৈত্রিক বাড়ি বর্ধমান জেলার খণ্ডকোষের অন্তর্গত সুখসাগর বা শভুসাগর গ্রাম। তবে কবির জন্ম মাতুলালয়ে, বাঁকুড়া জেলার ইন্দাস গ্রামে। পিতার নাম দেবীদাস, মায়ের নাম কেশবতী। গজলক্ষ্মী ছিলেন গৃহদেবী। মল্লভূমিতে রচিত তাঁর কাব্যের রচনাকাল ১০০৪ বঙ্গাব্দ ধরে ১৬৯৮ ৯৯ খ্রীস্টাব্দ বলে মনে করা হয়।


ডোমের ঠাকুর ধর্মের পূজা প্রচারে ও কাব্যরচনায় প্রথমে কবি ছিলেন অনিচ্ছুক। কিন্তু ধর্মঠাকুরের “পরিণামে মোর পদ পাবে অনায়াসে” প্রতিশ্রুতি পেয়ে এবং স্বপ্নে গজলক্ষ্মীর অনুমতি পেয়ে কবি ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করেন। ইন্দাস গ্রামের পুরোহিত নারায়ণ পণ্ডিতও কবিকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। কবির আত্মকাহিনীর সাক্ষ্যে চল্লিশ দিনে এই কাব্যটি রচিত হয়েছিল।


সীতারামের কাব্যের কাহিনী অংশ নতুনত্ব বর্জিত। তবে রচনারীতি সহজ এবং বিবৃতিমূলক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্ণনা চিত্রধর্মী এবং শব্দময়, যেমন বৈশাখের মধ্যাহ্নে বনের শোভা বর্ণনাঃ

“বৈশাখ সময় তার কুড়চির ফুল। 

ঝুপ ঝুপ ফুল খসে বাতাসে আকুল ॥

কত কত কাননে হরিণী কালসার। 

ক্ষণেক দিবস হয় ক্ষণেক আন্ধার ॥”

শোনা যায়, সীতারাম মনসামঙ্গল কাব্যও লিখেছিলেন।


ধর্মমঙ্গল কাব্যে যাদুনাথ বা যাদবনাথ পণ্ডিত :

ধর্মমঙ্গলকাব্য শাখার এক উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর জন্ম হাওড়া জেলার দোস গ্রামে (বর্তমানের ডোমজুড় গ্রাম)। ড. পঞ্চানন মণ্ডল এক তাঁতীর বাড়ি থেকে পুঁথিটি উদ্ধার করে বিশ্বভারতী থেকে ‘ধর্মপুরাণ’ নামে প্রকাশ করেন। কবির পিতার নাম ধর্মদাস, পিতামহ বিনোদ দাস। কবি খুব সম্ভবতঃ ছিলেন নাথ সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু তবু যাদবনাথ পণ্ডিতের কাব্যের অসাম্প্রদায়িক পরিচয় নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। এখানে যেমন আছে চৈতন্যবন্দনা, চণ্ডীর বন্দনা তেমনি ধর্ম নিরঞ্জনের দশ অবতার বর্ণনায় বৃদ্ধ কল্কি ও ধর্মের সঙ্গে এক হয়ে পতিশাহ রূপে দিল্লীতে শাসনের কথা

“দশমে বন্দিনু বৌদ্ধ কল্কি অবতার। 

সত্য শূন্য নাম তার মেলেশ্চ আকার ॥

যবনরূপে দিল্লীয়ে কৈলে পাসাই ঠাকুরালি।

যবনরূপে একাকার সংহারিলে কলি ।।”


তার কাব্যে বর্ধমানরাজ কৃষ্ণরামের উল্লেখ দেখে মনে হয় ১১০৩ বঙ্গাব্দে বা ১৬৯৬ খ্রীস্টাব্দে (কৃষ্ণরামের শোভাসিংহের হাতে মৃত্যু হয়) অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে কাব্যটি সমাপ্ত হয়।


যাদুনাথ পূর্ববর্তী কবিদের মতো লাউসেনের কাহিনী শোনাতে চান নি। এখানে রামাই পণ্ডিত এবং হরিশ্চন্দ্র ও লুইচন্দ্রের কথা বলা হয়েছে। করুণরস সৃষ্টিতে এবং লুইচন্দ্রের মাতা মদনার বাৎসল্যময়ী চরিত্র নির্মাণে কবি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। রচনারীতি সংযত আবেগ ও পাণ্ডিত্যের পরিচয়ে উজ্জ্বল। বস্তুতঃ কাহিনীর নৃতনত্বেই তিনি স্মরণীয়।


ধর্মমঙ্গল কাব্যে ময়ূরভট্ট :

ধর্মমঙ্গলের এই প্রাচীন কবির কথা সব কবিই বলেছেন। এঁর লেখা পুঁথিও পাওয়া যায় নি। তবু মনে হয় তিনি এই শাখার আদি কবি। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর সম্পাদনায় ‘শ্রীধর্মপুরাণ’ নামে একটি কাব্য প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে এই গ্রন্থটি ময়ূরভট্টের নয়। এই পুঁথিটি আসলে অষ্টাদশ শতকের রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখা, (ড. পঞ্চানন মণ্ডল দ্বারা প্রমাণিত)।


ধর্মমঙ্গল কাব্যে খেলারাম চক্রবর্তী :

১৩০২ সালে হারাধন দত্ত ‘জন্মভূমি’ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ‘গড় মান্দারণ ও প্রাচীন জাহানারাদের ইতিবৃত্ত' প্রবন্ধে এই কবির কথা লেখেন। পুঁথিটি তিনি হাতে পাননি, তবে হুগলী জেলার আরামবাগের নিকট বদনগঞ্জের কাছে শ্যামবাজার গ্রামে এক জেলে-পুরোহিতের কাছে দেখেছিলেন। কাব্যের নাম—‘গৌড়কাব্য’।


কাব্যের রচনাকাল ১৪৪৯ শকাব্দ কার্তিক মাস বা ১৫২৭ খ্রীস্টাব্দ। কিন্তু সপ্তদশ শতকের আগে কোনও ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্য ছিল কিনা সন্দেহ আছে। ফলে অনুমান করা হয়, এই গ্রন্থ জাল।


পরবর্তীকালে ড. পঞ্চানন মণ্ডল ঐ অঞ্চলে খেলারামের নাম শোনেন। গবেষকরা দেখেন ঐ নামে এক কবি ছিলেন। কেননা রূপরামের কাব্যে এবং যাদুনাথের কাব্যে খেলারাম নামক কবির নাম আছে। তবে খেলারাম গায়েন কবি কিনা তা নির্ণয় করা এখন দুঃসাধ্য ব্যাপার।