জর্জ বার্নাড শ' নাট্য প্রতিভার পরিচয় দাও।

বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বর্নাড শ'। তাঁর রাজনৈতিক, সামাজিক এবং দার্শনিক চিন্তাধারা জাতির সঞ্চয়। কিন্তু যখন তিনি সাহিত্য রচনায় প্রথম ব্রতী হন তখন বহু লোকই তাঁর বিপ্লবাত্মক চিন্তাধারা সহজে গ্রহণ করেননি। শতাব্দীর অচলায়তন ভেঙে তছনছ করে তিনি যখন সাধারণ মানুষকে দিনের প্রখর আলোকে টেনে নিয়ে এলেন, তখন হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। পাঠক প্রথমে তাঁকে মনে করেছিল—কালাপাহাড়। তারপর বাচাতুর্য এবং হাস্যরসের প্রাচুর্য দেখে মনে করেছিল যে, শ' ভাঁড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ। অত্যন্ত গুরুগম্ভীর ভাব অত্যন্ত লঘু ভাষায় তিনি পরিবেশন করেছিলেন। শ'র মতে আর্ট মাত্রই প্রচার, তিনি হাজার বিষয়ে তাঁর মতবাদ প্রচার করেছিলেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন : “জাতিকে আমার মতবাদে দীক্ষিত করাই আমার নাটক রচনার একমাত্র উদ্দেশ্য।” তিনি বিশ্বাস করতেন যে, নদী যদি স্রোত হারিয়ে ফেলে তবে সহস্র শৈবাল দাম তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। জাতি ও লোকাচারের সহস্র বন্ধনে বাঁধা পড়লে তার মৃত্যু আনিবার্য, জাতির আজ দৈনদশা। ধর্ম এসেছে মোহবেশে, বিচারের চেয়ে আচার, বিজ্ঞানের চেয়ে সংস্কার বড়ো হয়ে উঠেছে। মূলত তাঁর নাটককে মতবাদ প্রচারের হাতিহার রূপে ব্যবহার করলেন।


রচনাসমূহ : ১৮৯২-এর ৯ নভেম্বর তারিখে বার্নাড শ'র প্রথম নাটক উইডোয়ারস হাউসেস অভিনীত হয়। এরপর কয়েক বছর বাদে অর্থাৎ ১৮৯৮-তে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর নাট্য সংগ্রহ গ্রন্থ— Plays and pleasant and unpleasant। এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছিলেন— মিসেস ওয়ারেনস প্রফেসন (1893), দি ফিলানডারার (1893), আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান (1894), ক্যান্ডিভা (1895), দি ম্যান অব ডেষ্টিনি (1895), ইউ নেভার ক্যান টেল (1897) প্রভৃতি নাটক। এই একই সময়ে শ’ লিখেছিলেন আরও দুখানি নাটক—দি ডেভিলস ডিসিপল (1897), ক্যাপটেন ব্রাসবাউন্ডস কনভারসান (1899)। এরপর রচনা করেন সিজার অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা (1898) নামক নাটক। তবে এর পরবর্তী সময়টি বার্নাড শ'র নিকট ছিল অত্যন্ত অনুকূল, কারণ ১৯০৪-১৯০৭ পর্যন্ত শ' ১১টি নাটকের ৭১১ বার অভিনয় হয়েছিল। এর মধ্যে নাম করতে হয়—ম্যান অ্যান্ড সুপার ম্যান (1905) এটি বার্নাড শ'র শ্রেষ্ঠ নাটক, মেজর বারবারা (1905), দি ডক্টরস জিলমা (1906) ইত্যাদি। কিন্তু এর পরবর্তী ধাপে অর্থাৎ 1913 খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়েছিল তাঁর শ্রেষ্ঠ মনোরঞ্জক কমেডি—পিগ ম্যালিয়ন।


১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন বার্নাড শ'। মূলত ম্যান অ্যান্ড সুপার ম্যান থেকে বার্নাড শ'র খ্যাতি ছিল সর্বদাই ঊর্ধ্বগামী। এই পর্বে রচিত নাটকগুলির উৎকর্ষতা তাঁকে এনে দেয় নোবেল প্রাইজ। বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে শ'র প্রধান নাট্যকীর্তি হিসাবে নাম করা যায়—হার্টব্রেক হাউস (1920), ব্যাক টু মে যুযেলা (1922), সেন্ট জোন (1923), দ্য অ্যাপল কার্ট (1929), বার্নাড শ'র শেষ ও গুরুত্বপূর্ণ নাটক এই দ্য অ্যাপল কার্ট মূলত পরিণত ও সরস রচনা। তাঁর নাটকের চরিত্রগুলি খুব প্রাণচঞ্চল ও জটিল নয় বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। তাঁর চরিত্রগুলি যেন নাট্যকারের চিন্তার বাহন মাত্র। কিন্তু একথা সর্বত্র স্বীকৃত নয়, সেটি হল নাটকের নায়িকা অন্তত বার্নাড শ'র চিন্তাধারার বাহন হয়ে ওঠেনি, তাঁর চরিত্রগুলির মধ্যে যথেষ্ট বৈচিত্র্য রয়েছে। তাঁর নাটকের মূল আকর্ষণ অপূর্ব সংলাপ এবং বাচাতুর্য, অলংকারের আশ্রয় তিনি এতটুকু গ্রহণ করেননি। ইংরাজি গদ্যের তিনি একজন শ্রেষ্ঠ রচয়িতা। আবার তিনি ছিলেন বাস্তববাদী, সত্যকে প্রকাশ করবার সৎ সাহস তাঁর ছিল। রোমান্টিকতার স্পর্শ বা ভাবাবেগ তাঁর এতটুকু নেই। সর্বপ্রকার কপটতা এবং মিথ্যাচারের তিনি তীব্র বিরোধিতা করেছেন, গতানুগতিক ভাবধারা তিনি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন।


যুক্তিবাদে বিশ্বাসী, রোমান্টিকতার অযৌক্তিকতায় তাঁর ছিল না বিন্দুমাত্র আস্থা। যেমন—ম্যান অ্যান্ড সুপার ম্যান নাটকে তিনি রোমান্টিক প্রেমের কঠোর সমালোচনা করেছেন। 'আর্মস অ্যান্ড দি ম্যান’ নাটকে তিনি বীরত্ব এবং প্রেমের সম্বন্ধে গতানুগতি মোহের উপর আক্রমণ করেছেন। ম্যান অব ডেসিমি এবং সীজার অ্যান্ড ক্লিক ও পেট্রা নাটকে তিনি ইতিহাস স্বীকৃত বীরপুরুষদের বীরত্বহীনতার কথা প্রকাশ করেছেন। উইডোয়ারস হাউস নাটকে বস্তির জমিদারদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন। দি ডেভিল ডিসিপল এবং মেজর বারবারা নাটকে তিনি গতানুগতিক ধর্ম বিশ্বাসের উপর নিষ্করুণ আঘাত হেনেছেন। দি ডকটরস নাটকে তিনি চিকিৎসকদের উপর আক্রমণ করেছেন। গেটিং ম্যারেড নাটকে তিনি বিবাহ পদ্ধতির নিষ্করুণ সমালোচনা করেন। মিসেস ওয়ারেনস প্রফেসন নাটকে তিনি গণিকাবৃত্তির উপর নতুন আলোকপাত করেছেন। পিগম্যালিয়ন নাটকে সামাজিক আচার ব্যবহারের নিন্দা করেন। এই সকল বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতির উপর কঠোর আঘাত হানায় নাট্যকার বার্নাড শ' বাস্তববাদী রূপেই আত্মপ্রকাশ করেন।


নাটকের বৈশিষ্ট্য :

(১) ধারণাপ্রবণ নাটক : ক্ষুরধার ব্যাঙ্গ, উজ্জ্বল ও শানিত সংলাপ চমৎকৃত করেছিল। দর্শকমণ্ডলীকে। মূলত তাঁর নাটকগুলি ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও দার্শনিক ভাবধারার মাধ্যম।


(২) নাটকের বিশদ ভূমিকা : শ'র প্রায় প্রতিটি নাটকে রয়েছে দীর্ঘ ভূমিকা, যাতে নাট্যকার জোরালোভাবে তাঁর চিন্তাভাবনাগুলিকে বিবৃত করেছেন। 


(৩) চরিত্র : বৈচিত্র্য ও বাস্তবনিষ্ঠ চরিত্র সৃষ্টিতে বার্নাড শ' শেকসপিয়রের সমতুল্য।


(৪) ব্যাঙ্গ ও সরসতা : বুদ্ধিদীপ্ত সরসতা ছিল শ'র কমেডি নাটকের প্রাণ। 


(৫) সমালোচনা : নাটকে নাট্যকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহের সমালোচনা ও বিশ্লেষণের হাতিয়ার রূপে দেখেছিলেন।


(৬) সংলাপ : কথা বলা শিসে শ’র দক্ষতা ছিল উচ্চাঙ্গে। তাঁর নাটকে সংলাপ নির্মাণ এক অভাবনীয় সাফল্যের পর্যায়ে পৌঁছেছিল।


(৭) নাট্য কৌশল : তাঁর নাটকগুলি প্রচারধর্মী ও ধারণা প্রধান হওয়া সত্ত্বেও নাট্য শিল্পের টেকনিকগত দিকগুলো তিনি বিশেষভাবে রপ্ত করেছিলেন, যে কৌশল একেবারে তার নিজস্ব।


সর্বোপরি বার্নাড শ' বিশ্বাস করতেন, মানুষের সৃষ্টি যেসব নীতি বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার অধিকাংশেরই কপটতার ওপর ভিত্তি। মুষ্ঠিমেয় লোকের স্বার্থ, লোভ, লালসা‌ চরিতার্থতার জন্যে প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে উঠেছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রয়োজন। তাই তিনি পুরোপুরি হাস্যরস ও ব্যঙ্গ কৌতুকের সাহায্যে এই সমাজ ব্যবস্থার মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন। তিনি ট্রাজেডি লেখেননি, লিখেছেন শুধু কমেডি। শেকসপিয়রের কমেডিতে রয়েছে রোমান্সের সুর, জনসনের কমেডিতে রয়েছে ব্যঙ্গ, আর শ’র কমেডিতে রয়েছে এসবেরই অপূর্ব সমন্বয়। তাই পাঠক ও দর্শকের কাছে তিনি অনায়াসেই গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিলেন। এখানেই নাট্যকার বার্নাড শ'র বিশেষত্ব।