'মতিলাল পাদরি' গল্পে মতিলালের মধ্যে যে সার্থক মানবতার স্ফূরণ ঘটেছে তা সংক্ষেপে আলোচনা করো।

মতিলাল জন্ম হতে খ্রিস্টান নন ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি মতিলাল পাদরিতে রূপান্তরিত হয়েছেন। নিম্ন শ্রেণির মানুষের মাঝে পাহাড়ি এলাকায় তাঁর গির্জা। সেই গির্জার তিনি হর্তা কর্তা। এই গির্জার পরমব্রত হল সেবা, তবে ধর্মান্তরিত শান্তি নয় কিছু নয়। বিচারের ভীতি তাঁর কোনো ক্রমেই ছিল না। শুধুমাত্র একটা আশা-পূর্ণাঙ্গ ক্রিশ্চান। পুরো অনুভূত ছল, অনুতাপ নয়। তাই পাশাপাশি পাঁচ দশ মৌজার এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি একথা না ভেবেছেন। সুদীর্ঘ ক্রীচ্ছসাধন-ক্লীষ্ট মানুষটির ছায়া কোথায় না পড়েছে।


সর্বজন বিদিত সমাজের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত লাঞ্ছিতদের একমাত্র আশ্রয়স্থল এই গির্জা ক্রিশ্চানদের পরম সাধনার স্থল। মতিলাল সেই ব্রতে উদ্দীপ্ত হয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেছিল। একসময় এক দুর্যোগের রাত্রিতে এই গির্জাতে আগমন ঘটে ভামরের। সে এসেছে তার গর্ভের পাপকে প্রসব করে মুক্ত হতে। মতিলাল সাগ্রহে তাকে ঠাঁই দেয়, ডেকে পাঠায় বীণা হাড়িকে, যে দাইয়ের কাজ করে। তারই তত্ত্বাবধানে ভামর তার কদাচারের সাক্ষীকে পৃথিবীর মুখ দেখাতে সমর্থ হয়। ভামরের এই সদ্য প্রসূত সন্তানকে নানান জনে নানান কুৎসিৎ মন্তব্যে মেতে উঠলেও মতিলাল মনে মনে ভেবেই নিয়েছে এ আর কেউ নয়, স্বয়ং ভগবান শিশুর বেশে তার সাধনস্থলে আবির্ভূত হয়েছে।


মতিলাল পাদরিকে সবাই সম্মান করে। তাঁর কথাকে অমৃতবাণী বলে মানে। তাই এই শিশু সন্তানকে নিয়ে যে যতই কুৎসিৎ মন্তব্য করুক না কেন পাদরির কথায় এক বাক্যে মেনে নেয় সে ভগবানের প্রেরিত দূত। মতিলাল অবশ্য ভামরকে সাবধান করতে ভোলে না, এই দেবদূতের দিকে তাকিয়ে যেন এবার থেকে সে গ্লানীময় পথ পরিত্যাগ করে আলোকময় পথে গমন করে। ভামরও মতিলালের কথায় সর্বান্তকরণে স্বীকৃতি জানায়। সময়কালে বদন হিজড়ে এসেছে গির্জাতে, সদ্যজাত দেবদূতকে আশীর্বাদ দিতে, সে ছোট্ট আঙিনায় দাঁড়িয়ে সদ্যজাতিকে নিয়ে গেয়ে উঠেছে—

“কীসের ভাবনা লো কীসের ভাবনা,

স্বগগ এখন ঠাঁই করেছে ঘরে 

আমার কীসের ভাবনা...।"


তবে ভামরের বিস্ময়ের পরিসীমা নেই। সে যে শ্রেণির রমণী, তার পক্ষে এই সম্মান গ্রহণ করা যেমন অসহনীয়, সমাজে সবাই তাকে দেখে ঘৃণায় থুতকার দেয়। আর ভোগীরা তাকে ভোগের সামগ্রী হিসাবে জানে। সেই ভামর আজ মতিলাল পাদরির সান্নিধ্যে এসে যে সন্তান পেল, তার সন্তান কেমন ভাবে দেবদূতে রূপান্তরিত হল, সত্যিই বিস্ময়জনক ব্যাপার বটে। শিশুটিকে নিয়ে সারাক্ষণ মতিলাল পরিচর্যায় ব্যস্ত, ক্ষণিকের জন্য ভামর সন্তানকে কাছে পায় না। মতিলালের কথামত দূর-দূরান্ত থেকে দেবশিশুকে দলে দলে দেখতে আসে, মুখে প্রশংসার বাক্য ছাড়তে ছাড়তে বিদায় হয়, “শিশুপুত্র এখন সর্বক্ষণ তাঁরই কাছে ... পাদরির কোলে কোলে সে অনেক মধ্যরাত্র দেখেছে, অনেক টিলায় কেঁদেছে, বিরাট আকাশের মধ্যে শিশুর ব্যাকুলতা তিনি মন দিয়ে শুনেছেন। পাদরিকে বাবা বলে, দুরন্তপনা করে, মাঝে মাঝে বাইবেলের পাতা খুলে দিয়ে, তাতে তিনি নিগূঢ় অর্থ খুঁজে পান।" এইভাবে ধীরে ধীরে শিশু সন্তানটি বড়ো হতে থাকে।


কালিমালিপ্ত জীবনে ভামর পাদরির দাক্ষিণ্যে স্বর্গীয় সুষমা লাভ করলেও আদিমতা তাকে কোনোমতেই ছাড়তে চায় না। একদিন মাতালদের ভাটিশালায় মতিলাল ভামরকে যেভাবে আবিষ্কার করে তাতে ঘৃণায় বিবশ হয়ে যেতে হয়—“চাঁদের আলোয় দেখা যায়, দু’একটি লোক মুখ গুঁজড়ে পড়ে, বোতল গড়াচ্ছে, কলসি কুকুরে চাটছে, একটু নিকটে আসতেই স্পষ্ট হয়ে উঠল একটি স্ত্রীলোকের দশাসই দেহ। যেন ছিটকে পড়ে মাটিতে তার মুখ গুঁজড়ে আছে। উদম নির্লজ্জ বিবসনা।” পাদরি পরিচয় জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে এ সেই ভামর। নিষেধ মানেনি। ভামর কম্পিত স্বরে নিজের কৃতকর্মে বলে—“বাবা, আমার কী হবে গো ?” পাদরি অকপটে বলেই ফেলে—“নবজীবন পেয়েছ, তুমি জান না তুমি কার মা।” ভামর আর স্থির থাকতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।


মতিলাল আর কাউকে দিয়ে বিশ্বাস করে না। বড়ো বিশ্বাস করেছিলেন তিনি ভামরকে। এবার বুঝি ভামর ভালো পথে ফিরবে। কিন্তু তার কদর্যময় বর্তমান পরিস্থিতি মতিলালকে বড়ো ব্যথিত করে তুলেছে, তিনি ভাবতেই পারে না এখন কী করবে। তাঁর শুধু মনে হয়—‘আমি ঠকেছি। ভামরের অপকর্মের সঙ্গে সঙ্গে যে শিশুপুত্রকে দেবশিশু বলে আদরে কোলে তুলে নিয়েছিল তার প্রতিও ক্রমেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। ভেবে নেন এবার তাকে পরিত্যাগ করবেন।


মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ' নাটিকার কথা। সেখানে সন্ন্যাসীকে যেমন পিতৃত্বের আকর্ষণে ছোট্ট কন্যা সন্তানটির নিকট ফিরে আসতে হয়েছিল, এখানে শিশু সন্তানটিকে চিরতরে ভুলে থাকবার জন্য যখন তাকে নির্জন পাহাড়ে ধারে রেখে পাদরি নিরুদ্দেশের পথে চলেছেন ঠিক তখনই পিছনে কান্নার শব্দের প্রত্যক্ষ করেন “শিশু কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে আসছে।” সর্বাঙ্গে ধুলো মাটি, আর পাথরের টুকরোতে লেগে ছড়ে রক্ত বেরুচ্ছে। কী একটা অমোঘ আকর্ষণে মতিলাল আর এগোতে পারল না। ফিরে এসে শিশু কে বুকে নিয়ে ও প্রাণ, ও প্রাণ’ বলে চুম্বনে ভরিয়ে দেন অবশেষে—“তার হাঁটুতে মুখখানি বুলাতে বুলাতে চোখের জলে ধোয়াতে ধোয়াতে বললেন— “আমি সত্যিই ক্রিশ্চান নই গো বাপ ।” অর্থাৎ কোনো ধর্মীয় মোড়কে বাধা না পড়ে তিনি যে সত্যিকার একজন মানুষ, এযে তার সাধনাকে মানবতার উত্তরণ ঘটিয়েছেন সে কথা মানতে কোনো সংশয় নেই।