গল্পগুচ্ছের কোন্ গল্পগুলিকে তুমি শ্রেষ্ঠ বলে মনে করো বুঝিয়ে দাও।

রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছে'র প্রথম খণ্ডের প্রায় সব কয়টি গল্পই প্রথম শ্রেণির রচনা। তার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ অতি উচ্চস্তরের। সেইগুলির মধ্য থেকে সাতটিকে সুনির্দিষ্টভাবে শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করা কঠিন। এই ক্ষেত্রে সমালোচকদের মধ্যে মতভেদ হবার সম্ভাবনা। কাজেই নিজেই নিজের রুচির উপরে অনেকখানি নির্ভর করে এই জাতীয় নির্বাচন করতে হয়। অন্য কোনো উপায় নেই।


আমরা নিম্নলিখিত গল্পগুলিকে এই সংকলনের শ্রেষ্ঠ গল্প বলে নির্দেশ করবার পক্ষপাতী : (১) 'সমাপ্তি' (২) ‘মহামায়া’ (৩) 'কঙ্কাল' (৪) 'কাবুলিওয়ালা' (৫) ‘একরাত্রি' (৬) ‘পোস্টমাস্টার’ (৭) 'সুভা'। এই তালিকাটি আদৌ গুণানুক্রমিক নয়।


‘সমাপ্তি’ গল্পটিতে মনোবিশ্লেষণ এবং কাব্যদৃষ্টির মিলন ঘটেছে। বন্য মৃগের মতো দুরন্ত, চঞ্চলা বালস্বভাবা মৃন্ময়ীকে যখন ধরে-বেঁধে জোর করে বিবাহ দেওয়া হল, তখন প্রথম প্রথম সে কিছুতেই পোষ মানল না, সমস্ত দেহমন তার বহুদিন পর্যন্ত বিদ্রোহী এবং নিজের ঘরে প্রকৃতির মুক্ত আবেষ্টনের মধ্যে ফিরে আসতে উদ্গ্রীব হয়ে রইল। বালোচিত চপলতা কিছুতেই তার ঘুচল না। কিন্তু তার এই অদ্ভুত ব্যবহারে স্বামী অপূর্ব যখন তাকে বাপের বাড়ি রেখে দীর্ঘদিনের জন্য কলকাতায় চলে গেল, তখন হঠাৎ কী এক অদৃশ্য প্রভাবে যেন সমস্ত আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেল। হঠাৎ যেন তার মনে হল সমস্ত গৃহে এবং গ্রামে কেহ লোক নেই, হঠাৎ এক মুহূর্তে যেন তার বাল্যজীবন অপসারিত হয়ে যৌবনে সমস্ত আকাশ ছেয়ে গেল, হঠাৎ যেন কেমন করে বাল্য-অংশ যৌবন হতে বিচ্যুত হয়ে পড়ল। এই অতর্কিত আমূল পরিবর্তন, এ যেন এক সোনার কাঠির স্পর্শ, এবং এই স্পর্শটুকু এমন সুন্দর ও মনোরম করে কবি ফুটিয়েছেন যে, তার মধ্যে একটি অতি সুকোমল দরদ যেন স্বতঃউচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে।


মহামায়া তার দৃপ্ত চরিত্র নিয়ে এক দুর্ভেদ্য অবগুণ্ঠনের অন্তরালে আত্মগোপন করে রাজীবের নিকটে আপনাকে রহস্যময়ী করে তুলেছে। রাজীব তার নাগাল পায় না, “কেবল একটি মায়াগণ্ডির বাইরে বসে অতৃপ্ত তৃষিত হৃদয়ে এই সূক্ষ্ম অচল অটল রহস্য ভেদ করবার চেষ্টা করেছে।” তারপর রাজীবের রহস্য টুটে গেল, মহামায়া একটি উত্তর না দিয়ে এক মুহূর্তের জন্য পশ্চাতে না ফিরে ঘর হতে বাহির হয়ে গেল, আর তার সেই “ক্ষমাহীন চিরবিদায়ের ক্রোধানল রাজীবের সমস্ত ইহজীবনে একটি দগ্ধচিহ্ন রেখে দিয়ে গেল।” সমস্ত গল্পটির মধ্যে একটি অপূর্ব রহস্য কী সুন্দর ভয়ংকর রূপে ঘনীভূত হয়ে উঠে কীরূপে নিবিড়তর বিদায়রহস্যের মধ্যে পরিসমাপ্তি লাভ করল, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। এর মধ্যে যে শুধু একটা সরল কল্পনাশক্তির পরিচয় আছে তা নয়, এর ঘটনাবর্ণনা ও চরিত্রচিত্রণের ফাঁকে ফাঁকে প্রকৃতির সাথে একটি নিবিড় ঐক্যরস সৃষ্টি করা হয়েছে।


‘কঙ্কাল' গল্পটি অতিপ্রাকৃত রসের নয়। গল্পটির আরম্ভে কঙ্কালের আবির্ভাব অপার্থিব জগতের একটি রসঘন পরিস্থিতি গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু গল্পটির মধ্যে প্রবেশ করলে চরিত্রভাবনার বৈচিত্র্যে বিস্মিত হতে হয়। এই গল্পের নায়িকা রূপের দহনলীলা সারা অঙ্গে জ্বালিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল। কোনও পুরুষকে সে ভালোবাসতে পারেনি। পুরুষকে সে আপনার রূপের পূজারি হিসাবে দেখেছে। আসলে এ নারী আত্মরূপসচেতনাই শুধু নয়, আত্মরূপমুগ্ধা। সেই রূপসূরা পানের যন্ত্রণা এবং তার অনবার্য পরিণতি যে মৃত্যু তা আশ্চর্য মনস্তাত্ত্বিক নিপুণতায় কবি প্রকাশ করেছেন। গল্পটির পরিসমাপ্তিতে চমক আছে। কিন্তু তা আকস্মিক হইলেও অনিবার্য। আলোচ্য গল্পটিতে বিষপানে হত্যা, আত্মহত্যা প্রভৃতি তীব্র ঘটনা আছে। তা রবীন্দ্রপ্রতিভার পক্ষে খুব স্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই গল্পের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের জন্যই তা এসেছে।


‘কাবুলিওয়ালা’য় ঘটনাবৈচিত্র্য বেশি নেই। কবির মানবপ্রীতি কুসীদজীবী মেওয়াবিক্রেতা কাবুলিওয়ালাকেও অপরিচয়ের ধূসরতা হতে উদ্ধার করে এনেছে। এটা সম্ভব হয়েছে তার অন্তরের পিতৃত্ব আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। পিতার হৃদয় যে যুগোত্তীর্ণ, সুদূর আফগানিস্তানের বালুময় প্রান্তর ও পর্বতগৃহ থেকে কলকাতার প্রাসাদ-প্রকোষ্ঠে সমসক্তিতে সক্রিয়, এই মনোরম করুণ গল্পটি তারই সুর ধরিয়ে দেয়। গল্পের পরিণতি যেমন কৌশলপূর্ণ তেমনি কবিত্বময়। রহমৎ তার বুক পকেট থেকে একটি ছিন্নপ্রায় কাগজ বের করে দিল। তাতে একটি ছোটো মেয়ের হাতের ছাপ রয়েছে। এই ঘটনাটি কত সামান্য ! কিন্তু এর মধ্যে প্রবাসী পিতার হৃদয়বেদনার গুঞ্জরণ যুক্ত রয়ে গেছে।


‘একরাত্রি’ গল্পটির একদিকে রাজনৈতিক কোলাহল, অন্যদিকে আশ্চর্য গীতিরস। গল্পের নায়ক আয়ত্তপ্রায় প্রণয়কে অস্বীকার করে রাজনৈতিক জীবন বরণ করেছিল; সেই জীবনের উচ্চকণ্ঠে ধূলিজালে বিক্ষত হয়ে সে একটি সামান্য সেকেন্ড মাস্টারি বরণ করে দিনগত পাপক্ষয় করেছিল। কোথায় গেল এই আদর্শবাদের বহুবারম্ভ। কোথায় চলে গেল প্রথম যৌবনের প্রণয়ের দিনগুলি ! অতি তুচ্ছ ও সামান্য প্রাত্যহিক অস্তিত্বের মধ্যে এক বন্যার রাত্রে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল কবি সেকথা বলেছেন। তার মধ্যে ঘটনাগত বিশিষ্টতা ছিল না। তা আশ্চর্য নীরব। চারিদিকে কল্লোলিত বানের জল, অন্ধকার রাত্রি, মেঘ বিদ্যুৎ গাছেদের মাতামাতি মিলে এক আশ্চর্য পরিবেশ ঘনীভূত হল। ওই এক রাত্রির সেই ক্ষণস্থায়ী উপলব্ধির যে-আস্বাদ কবি দিয়েছেন, গল্পটি তাতেই অসাধারণ হয়ে উঠেছে। গল্পের নায়কেরো উপসংহারের ভাবনাটি এই প্রসঙ্গে উদ্ধারযোগ্য : “ভাবলাম, আমি নাজিরও হইনি, সেরেস্তাদারও হইনি, গারিবল্ডিও হইনি, আমি এক ভাঙা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার, আমার সমস্ত ইহজীবনে কেবল ক্ষণকালের জন্য একটি অনন্ত রাত্রির উদয় হয়েছিল—আমার পরমায়ুর সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটিমাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।"


‘একরাত্রি'র ন্যায় 'সুভা' গল্পটিও প্রকৃতির সাথে মানবহৃদয়ের অসপত্ন সম্বন্ধে আবদ্ধ এবং গীতিকবিতার সুরে বাঁধা। এর কাহিনি, চরিত্র, প্রকৃতি-পরিবশে সব মিলে যেন একটা সুর হয়ে উঠেছে। মানবসমাজে বদ্ধ এক মূক বালিকার বেদনাঘন দৃষ্টিপাত মৃক প্রকৃতির সাথে একে এক করে ফেলেছে। কবি লিখেছেন, “মুখের ভাব বই আজন্মকাল যার অন্যভাষা নেই, তার চোখেরো ভাষা অসীম উদার এবং অতলস্পর্শ গভীর—অনেকটা স্বচ্ছ আকাশের মতো, উদয়াস্ত এবং ছায়ালোকের নিস্তদ্ধ বঙ্গভূমি। এই বাক্যহীন মনুষ্যের মধ্যে বৃহৎ প্রকৃতির মতো একটা বিজন মহত্ত্ব আছে। এইজন্য সাধারণ বালক-বালিকারা তাকে একপ্রকার ভয় করত, তার সাথে খেলা করত না, সে নির্জন দ্বিপ্রহরের মতো শব্দহীন এবং সঙ্গিহীন”


‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটির মধ্যেও একটি গীতিসুরই প্রধান। রতন নাম্নী বালিকার সাথে তার বিচিত্র প্রীতির সম্পর্ক বিচ্ছেদবেদনার মুহূর্তে মৌন কারুণ্যে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। গল্প তৈরি করে তুলবার কোনো আয়োজন নেই। শুধুই আসা-যাওয়া, যেমন—আসা আমাদের নিত্যকার অভিজ্ঞতার, যেমন আসা-যাওয়ার চরম প্রতিনিধি জন্ম এবং মৃত্যু, তার মধ্যে অনিবার্য অপ্রতিরোধ গতিস্রোতে হৃদয়ের প্রীতিকে ধরে রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা এবং ব্যর্থতার করুণ ক্রন্দন। এর সমাপ্তিতেও সেই অনন্তের সুর। কবির নিজের ভাষায় পোস্টমাস্টার “যখন নৌকায় উঠলেন এবং নৌকা ছেড়ে দিল, বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণির উচ্ছ্বলিত অশ্রুরাশির মতো চারিদিকে ছলছল করোতে লাগল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করতে লাগলেন,—একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ রতে লাগল।”