শিবায়ন কাব্য : শিবায়ন কাব্যের বৈশিষ্ট্য, শিবায়নের সঙ্গে মঙ্গলকাব্যের পার্থক্য, শিবায়নের কবি

শিবায়ন কাব্য


মধ্যযুগে বাংলাদেশে শিব-দুর্গার দরিদ্র সংসার জীবন কল্পনা করে মঙ্গলকাব্যের অনুসরণে যে আখ্যানকাব্য লেখা হয়েছিল সেইগুলি 'শিবায়ন' নামে পরিচিত হয়।


শিবায়ন কাব্যের বৈশিষ্ট্য:

শিবায়নের প্রথম অংশে আছে শিবের পৌরাণিক মহিমা কীর্তন। যেমন– দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস, সতীর দেহত্যাগের পর মেনকা ও হিমালয়ের গৃহে উমারূপে জন্মগ্রহণ, মহাদেবের সঙ্গে বিবাহ ইত্যাদি।


দ্বিতীয়াংশে আছে কৃষিজীবী শিবের প্রাত্যহিক সংসার জীবনের চিত্তাকর্ষক ঘটনা প্রসঙ্গ। এই অংশের শিব-কাহিনী একান্তভাবে গ্রামীণ এবং লোকজীবন-ভিত্তিক। শিব চরিত্র এই অংশে দেবত্ব গৌরবে মহিমান্বিত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, সংস্কৃত সাহিত্য ও পুরাণে বর্ণিত ‘রজতগিরি সন্নিভঃ' হেম-কান্তি মহাদেবের প্রশান্ত-গম্ভীর মূর্তি এখানে একেবারেই অনুপস্থিত। পরিবর্তে, এই লৌকিক শিব-চরিত্র দারিদ্র্যের গণ্ডীতে বাঁধা বাঙালীর সংসার সীমায় আবদ্ধ কামনা-বাসনায় জর্জরিত জীবনের হলাহল পানে আসক্ত। সুতরাং সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য নিরূপণে বলা যায়, শিবায়ন কাব্যের শিব-চরিত্রে পৌরাণিক শিব এবং আর্যেতর গোষ্ঠীভুক্ত কোন অমার্জিত স্থূল দেবতার সংমিশ্রণ ঘটেছে। ড. নীহাররঞ্জন রায় এই বিবর্তনের পরিচয় দিয়েছেন : “শ্মশান আন্তর-পর্বতের রিক্ত দেবতা একান্তেই দ্রাবিড় ভাষীদের শিবন। যার অর্থ লাল বা রক্ত এবং শেম্বু যাহার অর্থ তাম্র, ইনিই ক্রমে রূপান্তরিত হইয়া আর্যদেবতা রুদ্রের সঙ্গে এক হইয়া যান। পরে শিবন=শিব, শোম্বুশম্ভু, রুদ্র=শিব এবং মহাদেবে রূপান্তর লাভ করেন” (“বাঙ্গালীর ইতিহাস”)।


শিবায়নের সঙ্গে মঙ্গলকাব্যের পার্থক্য

(ক) মঙ্গলকাব্যের মতো শিবের পূজা ও মাহাত্ম্য প্রচার শিবায়ন কাব্যে দেখা যায় না। কোন অনিচ্ছুক ব্যক্তিকে ভয় বা প্রলোভন দেখিয়ে শিবভক্তে পরিণত করার প্রথানুগ বৈশিষ্ট্য শিবায়ন কাব্যে বিরলদৃষ্ট। কোন শাপভ্রষ্ট দেব-দেবীর সাহায্যে পূজা প্রচারের পরিকল্পনা এখানে দেখা যায় না।


(খ) অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে নায়কের বাণিজ্য বা শিকার পেশার পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে কৃষিজীবী বৃদ্ধ দরিদ্র শিব নীতিহীন ধূলিমাখা মর্তমানব মাত্র।


শিবায়নের কবি

শিবায়ন কাব্যে আছে দুটি ধারা—একটি চট্টগ্রামে প্রাপ্ত মৃগলুব্ধ-মূলক উপাখ্যান, বা শিবমাহাত্ম্য কাহিনী, অন্যটি শিবপুরাণ-নির্ভর শিবায়ন কাব্য।


চট্টগ্রাম থেকে প্রাপ্ত শিব মাহাত্ম্য জ্ঞাপক কাব্যের সংখ্যা দুটি। একটি দ্বিজ রতিদেবের ‘মৃগলুব্ধ’, অন্যটি রামরাজার ‘মৃগলুব্ধ সংবাদ'। দুটিরই প্রকাশ কাল ১৩২২ বঙ্গাব্দ। আবিষ্কারক আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ। তাঁর সংগ্রহে ছিল আরো একটি নাম পরিচয়হীন পুঁথির অংশ বিশেষ। দীনেশচন্দ্রের মারফৎ ‘রঘুনাথ রায়' নামে আরো এক কবির নাম পাওয়া যায়, যদিও তার অস্তিত্ব পুঁথি-সমর্থিত নয়।


রতিদেব :

করিম সাহেবের মতে, রতিদেব অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের কবি। রতিদেব চট্টগ্রামের চক্রশালা পরগনার অন্তর্গত সুচক্রদণ্ডী গ্রামে ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। কবি আত্মপরিচয় দিয়েছেন এইভাবে

“পিতা গোপীনাথ মাতা মধুমতী 

জন্মস্থান সুচক্রদণ্ডী চক্রশালা খ্যাতি ৷৷”


রতিদেবের নামে প্রচলিত দুখানি পুঁথির একটি অনুলিখিত ১২০৩ ও অপরটি ১২১৩-তে) সন-তারিখ এবং ভাষা ও রচনাপ্রণালীর ভিত্তিতে তার যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত স্থাপন। কাব্যে আছে

“রস অঙ্ক বাউশশী শাকের সময়।

তুলা মাসে সপ্তবিংশতি গুরুবার হএ ॥”


অর্থাৎ ১৫৯৬ শকাব্দের কার্তিকমাসে (১৬৭৪ খ্রীস্টাব্দে) এই কাব্য রচিত হয়। রামরাজার ‘মৃগলুব্ধ সংবাদের' দু'খানি পুঁথির একটি ১১৪২ মাঘীসনে, অপরটি ১১৯৬ মাঘীসনে অনুলিখিত।


রামরাজা :

রামরাজার ব্যক্তিপরিচয় মাত্র ভণিতাতেই সমাপ্ত—“শঙ্কর কিঙ্কর রামরাজা”। ড. সুকুমার সেনের মতে কবির নাম শিশুরাম রায়। কারণ ‘শঙ্কর কিঙ্কর’ রামরাজ গাত্র'। তবু শেষ পর্যন্ত সবই অনুমান, অনুমান করিম সাহেবের কবিকে মগ বংশদ্ভূত বলে প্রমাণের প্রচেষ্টা পর্যন্ত। বিপরীতভাবে রতিদেবের কাব্যে পারিবারিক পরিচয় বিস্তৃত—পিতা গোপীনাথ, মাতা মধুমতী, জ্যেষ্ঠ ভাই দুজন চন্দ্ররাম, নারায়ণ ইত্যাদি। জন্মস্থান চন্দ্রশালা বা পটিয়া বাকলা গ্রাম।


রামরাজা ও রতিদেবের কাব্যের বিষয়বস্তু একই প্রকার, ঘটনা-বিন্যাসেও সাদৃশ্য বর্তমান। বলা হয় রতিদেব রামরাজার অনুকরণকারী। তবু একথা ঠিক, রামরাজা অপেক্ষা রতিদেবের কাব্যে কাহিনী অনেক সংহত এবং প্রসাদগুণ মণ্ডিত।


রামেশ্বর ভট্টাচার্য :

কাব্য লিখে বড়ো উপার্জন জনপ্রিয়তা যাঁর রচনার সম্পদ, তিনি শিবায়ন কাব্যধারার সবচেয়ে খ্যাতিমান কবি, নাম– রামেশ্বর ভট্টাচার্য (চক্রবর্তী)। শিবায়ন ছাড়া তাঁর খ্যাতি অদ্ভুত সত্যপীরের ব্রতকথা লেখার কারণেও প্রতিষ্ঠিত।


কবির জন্মস্থান মেদিনীপুর জেলার ঘাটালের অন্তর্গত বরদা পরগনার যদুপুর গ্রাম (কবির নিজস্ব উক্তি— “সার্কিন বরদাবাটী যদুপুর গ্রাম')। বেদজ্ঞ পণ্ডিত পিতামহের নাম গোবিন্দ চক্রবর্তী, যদিও মূলতঃ তারা শাণ্ডিলা গোত্রোদ্ভূত বন্দ্যোপাধ্যায় পদবীধারী ব্রাহ্মণ, যজন-যাজনের জন্য ‘ভট্টাচার্য' পদবী গ্রহণ। পিতা লক্ষ্মণ, মাতার নাম রূপবতী, দুই পত্নী সুমিত্রা ও পরমেশ্বরী। পুঁথি প্রকাশক ড. পঞ্চানন চক্রবর্তীর মতে, কবির জন্মকাল ১৬৭৭ খ্রীস্টাব্দ। তার এই অনুমানের কারণ, ভূস্বামী শোভাসিংহের ভ্রাতা হেমৎ বা হিম্মৎ সিংহের হাতে কবির নিগ্রহ এবং কর্ণগড়ে রামসিংহের সভায় আশ্রয়লাভ সম্ভবতঃ ১৬৯৭-৯৮ খ্রীস্টাব্দের ঘটনা। রামসিংহের পুত্র যশোবস্ত সিংহের রাজসভায় সভাকবির সম্মান পেয়েছিলেন কবি রামেশ্বর। কবির গুরুবংশের রোজনামচার ভিত্তিতে ড. চক্রবর্তী আরো মনে করেন ১৭৪৪ খ্রীস্টাব্দে কবির তিরোধান হয়। ড. পঞ্চানন চক্রবর্তীর মতে, রামেশ্বরের উপাধি ছিল 'কবিকেশরী’। কেননা সত্যপীরের একটি পুঁথিতে আছে

“উদ্দেশ্যে অষ্টাঙ্গে দ্বিজ করিল প্রণাম।

কহে কবিকেশরী কেশরকোণি রাম ৷৷”


তবু এটি অনুমান মাত্র। আনুমানিক ১৭১২ খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে কাব্যটি রচিত হয়। রামেশ্বরের ‘শিবকীর্তন’ কাব্য সাতটি পালা সংযুক্ত। প্রথম থেকে তৃতীয় পালার মাঝামাঝি পর্যন্ত কাহিনী পদ্মপুরাণ, স্কন্দ, নন্দীকেশর, লিঙ্গ প্রভৃতি পুরাণ এবং কালিদাসের কুমারসম্ভব কাব্যের পৌরাণিক উপাদান নির্ভর; যেমন সৃষ্টি ও উৎপত্তি বর্ণনা, দক্ষযজ্ঞ ও সতীর দেহত্যাগ, দক্ষের ছাগমুণ্ডলাভ, মদনভস্ম, রতিবিলাপ, গৌরীর তপস্যা প্রভৃতি প্রসঙ্গ। তৃতীয় পালায় হরগৌরীর বিবাহ বর্ণনার পর থেকে কাহিনীর গতিমুখ লৌকিকতার পথে চলেছে। সম্পাদক ড. চক্রবর্তীও জানিয়েছেন—“পুরাণখণ্ডে’ তাহার কাব্যের বিশেষ কোন বৈচিত্র্য নাই, কেবল পুরাতনের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু এই লৌকিক অংশে দরিদ্র শিবের গার্হস্থ্যজীবন, দাম্পত্য কলহ, চাষ-বাস, মাছ-ধরা প্রভৃতি বর্ণনার বাস্তবতায়, পরিচয়দানে কবির কৃতিত্ব দেখা যায়। শুধু কৃপণ শিবের দারিদ্র্য জর্জর বস্তুচিত্র নয়, বিয়ের পর কন্যা-বিদায়ের মুহূর্তে কন্যার জননীর জামাতার প্রতি উপদেশ

“কুলীনের পোকে আর কি বলিব আমি।...

আঁটু ঢাক্যা বস্ত্র দিও পেট ভরা ভাত। 

প্রীত্য কর যেমন জানকী রঘুনাথ ।।”


রামেশ্বরের রচনায় অনুপ্রাসের অতিবাদ এবং তৎসম শব্দের বহুল উপস্থিতি দেখা যায়, যা প্রায় ত্রুটি রূপে গণ্য— “ঠাকুরাণীর ঠেকিতে ঠাকুর ঠেক্যা হন”, “কান্তের লাগিয়া কঁাদ্যা কাকুবাদ করে।” কিছু কিছু বাক্য-বিন্যাসে কবির প্রাজ্ঞতা পরিস্ফুট হয়— “দিনে হও ব্রহ্মচারী রাতে গলা কাটা”, “অনর্থের বীজ অর্থ মত্ততার ঘর”, “নামের নিমিত্তে লোকে নানা কর্ম করে” ইত্যাদি। রামেশ্বরের কাব্যের রুচি অনেক স্থলে শুচিস্নিগ্ধ নয়। যেমন কোঁচপল্লীতে শিবের যাত্রা বর্ণনা বা বৃদ্ধ হর ও দুর্গার বাসর বর্ণনার অংশ। বাগদিনীবেশী দেবীকে দেখে হরের কামোন্মত্ততার মধ্যেও গ্রাম্য মনোভাব সোচ্চার।


রামচন্দ্র কবিচন্দ্র :

জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে স্বীকৃত সম্মান না পেলেও শিবায়ন কাব্যধারার স্মরণীয় ব্যক্তি রামচন্দ্র রায় কবিরত্ন। দুখানি মাত্র পুঁথির ভিত্তিতে তার কাব্য সম্পর্কে পরিচয় লাভ। তার মধ্যে একটি খণ্ডিত এবং খুবই অর্বাচীন কালে লিপিকৃত।


রামচন্দ্রের প্রথম পুঁথিটির আবিষ্কারক বিশ্বকোষ পর্যায়ের তত্ত্বাবধায়ক নগেন্দ্রনাথ বসু। ১৩০৬ বঙ্গাব্দে মৃণালকান্তি ঘোষের সহযোগিতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় তার এই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার সূত্রপাত। পুঁথিটির লিপিকাল—১০৯১ বঙ্গাব্দ ১১ই শ্রাবণ (১৬৮৪ খ্রীস্টাব্দ)। কিন্তু পরবর্তী গ্রন্থ সম্পাদক ড. দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ও ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য এই তারিখ মানতে অনিচ্ছুক। দ্বিতীয় পুথিটির আবিষ্কারক কবির বংশধর শ্রীযুক্ত পাঁচুগোপাল রায়। তার পুঁথিটির লিপিকাল—১৩৪৮ বঙ্গাব্দ (১৭২৬ খ্রীস্টাব্দ)। পুথিটি প্রামাণিক এবং পূর্ণাঙ্গ।


কবির পূর্বপুরুষের আদি বাসস্থান— হাওড়া জেলার আমতার কাছে দামোদরের তীরে অবস্থিত রামপুর গ্রাম। তারা দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ বংশীয়, কৌলিক উপাধি দেব, পরে ‘রায়’ উপাধি ধারণ। শিবায়নের আর এক কবি রামকৃষ্ণ রায়ের পুঁথি থেকেই জানা যায়, কাব্যরচনার পূর্বেই রামকৃষ্ণ ‘কবিচন্দ্র’ খ্যাতি অর্জন করেন : “শ্রীকবিচন্দ্র বিরচিতা শিবসঙ্গীত পুস্তক সমাপ্ত” (পুষ্পিকা)। কবির পিতার নাম কৃষ্ণ রায়। পিতামহ যশশ্চন্দ্র রায়। মাতা রাধাদাসী, মাতামহ সূর্য মিত্র। পিতার পাণ্ডিত্যের দুর্লভ উত্তরাধিকার রামকৃষ্ণ অর্জন করেন। সম্ভবতঃ পরিণত যৌবনেই তার কাব্য রচিত হয়।


বাড়িতে রক্ষিত দলিল-পত্রাদির ভিত্তিতে পাঁচুগোপাল বাবুর অনুমান, কবির জন্ম ১৬১৮ খ্রীস্টাব্দেরও আগে। কিন্তু গ্রন্থ সম্পাদকদ্বয়ের মতে, ১৫৯০ খ্রীস্টাব্দের দিকে কবির জন্ম, মৃত্যু ১৬৮৪ খ্রীস্টাব্দে। মৃত্যুর কারণ বর্ধমানের রাজা কৃষ্ণরামের রসপুর গ্রামে কবির গৃহদেবতাকে বলপূর্বক হরণ, শোকে-লজ্জায় অপমানে কবির মৃত্যু হয়।


রামচন্দ্রের কাব্যের নাম লিপিকরের বিচারে 'শিবসঙ্গীত’। কিন্তু মুদ্রিত কাব্যের মধ্যে ‘শিবমঙ্গল’ এবং ‘শিবায়ন' নামটিও মাঝে মাঝে চোখে পড়ে— “রামকৃষ্ণ দাস গান শিবের মঙ্গল”, “রামকৃষ্ণদাস গায় গীত শিবায়ন।” কাব্যটির কাহিনী দীর্ঘায়ত, মোট ছাব্বিশটি পালায় বিভক্ত। প্রথম তিনটি পালায় সৃষ্টিতত্ত্ব, কালবিভাগ ও তীর্থমাহাত্ম্যের বিস্তারিত বর্ণনা, চতুর্থ ও পঞ্চম পালায় সতীর দেহত্যাগ ও দক্ষযজ্ঞ বিনাশ, ষষ্ঠ-সপ্তম অষ্টম পালায় তারকাসুর বধ, মহাদেবের তপোভঙ্গ, মদনভষ্ম, পার্বতীর তপস্যা, মহাদেবের গৌরীলাভের ইচ্ছা পর্যন্ত বর্ণিত। নবম থেকে বিশ পর্যন্ত পালায় হরগৌরীর বিবাহ, মনসার উপাখ্যান, সমুদ্রমন্থন, বলিরাজার কাহিনী, সগর রাজা ও গঙ্গার কাহিনী আছে। বাকী ছ'টি পালাতে আছে ত্রিপুরাসুর ও তারকাসুর আখ্যান, শিবদুর্গার ঝগড়া, অন্ধকের গল্প, অন্ধকবধ, পরশুরাম ও রাবণের কথা, বাণরাজের কন্যা ঊষা ও কৃষ্ণ নন্দন অনিরুদ্ধের মিলনে কাব্য সমাপ্ত হয়েছে।


রামচন্দ্রের সুবিশাল কাব্যটির মধ্যে মোটামুটিভাবে তিনটি ধারা লক্ষণীয়—প্রথমত, মন্বন্তর সৃষ্টি রহস্য প্রভৃতি শাস্ত্রোক্ত ধারা। দ্বিতীয়ত, শিবকাহিনী এবং তার আনুষঙ্গিক পৌরাণিক উপকাহিনীর ধারা। তৃতীয়ত, লৌকিক শিবায়ন শ্রেণীর রঙ্গধামালি। পৌরাণিক প্রজ্ঞা ও লৌকিক ভাবনায় প্রকাশ থাকলেও দেখা যায় চিরায়ত পুরাণের প্রতি কবির ঝোক বেশি। শৈব-শাক্ত পুরাণের সঙ্গে বৈষ্ণব পুরাণপাঠের অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। হরি হরের মিলন প্রচার ছিল তাঁর কাব্যের অন্যতম উদ্দেশ্য“হরিহর দোঁহে এক শরীর অভেদ”। তবু সামগ্রিকভাবে ব্রহ্মের প্রতি এবং মীননাথ-গোরক্ষনাথ-চৈতন্যদেব নিত্যানন্দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশে কবি ছিলেন অকুণ্ঠিত।


শিবায়ন কাব্যধারার মধ্যে রামচন্দ্রের কাব্যটির প্রধান লক্ষণীয় বিশেষত্ব, প্রচলিত লৌকিক শিবকাহিনী ছেড়ে যথাসম্ভব পৌরাণিক কাহিনীর অনুসরণ। এই কাব্যধারায় অপর দুই কবি রামেশ্বর এবং শঙ্কর কবিচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর স্বাতন্ত্রের একটি অন্যতম কারণ এখানেই নিহিত। হরগৌরীর বিবাহ-প্রসঙ্গ ছাড়া দেবীর বাগ্দিনীরূপে শিবকে ভুলনা, শিবের কুচনী পাড়ায় যাত্রা প্রভৃতি লৌকিক কাহিনী রামকৃষ্ণের কাব্যে একেবারেই লক্ষণীয় নয়। তার কাব্যের রুচি সমুচিত, সংহত এবং রীতিমত প্রশংসনীয়। পুরাণের আবহে নানা নীতি, তত্ত্ব ও দর্শনের পটভূমিতে বহু উপকাহিনী পরিব্যাপ্ত। এই বিদগ্ধ কাব্য যতখানি উপলব্ধির বিষয়, ততখানি উপভোগের নয়।


রামকৃষ্ণের কাব্যের দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিশেষত্ব ভাষা, শব্দসম্পদ এবং ছন্দ-ব্যবহারে নিপুণতা। যেমন কৃষ্ণ-প্রশস্তি বর্ণনা

“নীপ সমীপ    নব নীরদ

তড়িতলতা তথি অঙ্গ।

রাধা অঙ্গে    অঙ্গ অবলম্বন

পীতাম্বর তিরিভঙ্গ ৷৷”

‘কুমারসম্ভব কাব্য’ অনুসরণে রতিবিলাপ অংশও—

“অনাথ করিয়া মোরে যাও প্রভু কোথাকারে

আর না দেখিব চান্দমুখ....”


পাণ্ডিত্যের অতিবাদিতায় রচনাভঙ্গী মাঝে মাঝে যে বেশ নীরস এবং তত্ত্বমুখ্য হয়ে উঠেছে, একথা অনস্বীকার্য। কবি রামেশ্বরের কাব্যের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, বাংলা গদ্য ব্যবহারের প্রথম প্রয়াস এখানে দেখা যায়। পয়ার ত্রিপদীতে কাব্যঘটনা বলতে বলতে তিনি পরিচ্ছন্ন অন্বয় এবং স্বাভাবিক বাক্যবিন্যাসে গদ্য ব্যবহার করেছেন— যেমন “মহিষ পর্বতে গিয়া পূর্বকল্পের কথা ক্রৌঞ্চকে কহিতেছেন, অবধান করহ।” অথবা “পার্বতী ভাগীরথী স্নান করিতে গেলেন, এমত সময়ে শঙ্কর মনের দুঃখে নারদকে কহিতেছেন, অবধান করহ” ইত্যাদি। বাংলা সাধুগদ্যের প্রথম স্রষ্টার সম্মান তাঁকে দেওয়া যায়।


শঙ্কর কবিচন্দ্র :

সপ্তদশ শতকের শিবায়ন কাব্যধারায় স্মরণীয় হয়ে আছেন শঙ্কর কবিচন্দ্র। কবি কৃষ্ণরামের মতো শঙ্করের কবিপ্রতিভা বহুকাব্য সৃষ্টিতে বিভক্ত। শিবায়ন ছাড়া ভাগবত, রামায়ণ, মহাভারত, শীতলামঙ্গল প্রভৃতি কাব্যেরও তিনি রচয়িতা। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বিষ্ণুপুরের এক ব্রাহ্মণ বংশে কবির জন্ম হয়। গ্রামের নাম পানুয়া। বিষ্ণুপুররাজ গোপাল সিংহের (১৭১৮-৪৮ খ্রীঃ) তিনি ছিলেন সভাকবি। আবার এই বিষ্ণুপুরের রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথের রাজত্বকালে (১৭০২ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে) তিনি রামায়ণ পাঁচালী রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।


শঙ্করের শিবায়ন কাব্যের পুরো পুঁথি পাওয়া যায় নি। তবে প্রাপ্ত ‘মচ্ছধরা পালা’ এবং মাখনলাল মুখোপাধ্যায় উল্লিখিত ‘শঙ্খপরা পালা'টি তার রচনা বলে জানা যায়। ‘মচ্ছধরা’ মৎসধরা পালাটি শিবায়নের লোকপ্রচলিত কাহিনীর প্রথম লিখিত রূপ বলা যায়। কৃষাণ ও জালিক শিবের প্রথম পূর্ণাঙ্গ চরিত্রাঙ্কনের কৃতিত্ব শঙ্কর কবিচন্দ্রের প্রাপ্য। বাগ্দিনীবেশিনী দেবীর বর্ণনা

“বাগ্দিনী বেশ করি উভ করি খোঁপা।

পুষ্পমালা তাতে শোভে সুবর্ণের ঝাপা । 

কান্ধেতে ঘুনসি জাল ইসাদের কড়ি। 

পরিপাটি কান্ধে সাজে মরে চুপড়ি ।”


পালাটির মধ্যে ভণিতা পাওয়া যায় একাধিক নামে— শ্রীকবিকঙ্কণ, শ্রীকবিশঙ্কর, সুকবি শঙ্কর, দ্বিজ কবিচন্দ্র প্রভৃতি। লিপিকর প্রমাদে কখনো কখনো ‘কবিচন্দ্র’ ‘কবিকঙ্কণে’ রূপান্তরিত হয়েছে।