‘মুক্তধারা’ নাটকে যে তিনটি ভিন্নধর্মী ভাবনার চরিত্রের কথা বলা হয়েছে তা ব্যাখ্যা করো।

এ নাটকে যে তিনটি ভিন্নধর্মী ভাবনার চরিত্র সৃজন করা হয়েছে তারা যথাক্রমে যন্ত্রী, মন্ত্রী আর নিজের যন্ত্রে বন্দি মানুষ। পৃথিবী জুড়ে যন্ত্রী উচ্চারণ করে চলেছে— 'মার লাগিয়ে জয়ী হব। মন্ত্রী বলছে—'হে মন, মারকে ছাড়িয়ে উঠে জয়ী হও। নিজের যন্ত্রে বন্দি মানুষ প্রত্যয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করেছে—প্রাণের দ্বারা যন্ত্রের হাত থেকে মুক্তি পেতে হবে, মুক্তি দিতে হবে। 'মুক্তধারা' নাটকে এই তিনটি ভিন্নধর্মী শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছে বিভূতি, ধনঞ্জয় আর অভিজিৎ। বিভূতি হল যন্ত্রী, মন্ত্রী হল ধনঞ্জয়, আর মানুষ হল অভিজিৎ।


অভিজিৎ এবং বিভূতি দুজনেই উত্তরকূটের নাগরিক, অভিজিৎ যুবরাজরূপে এবং বিভূতি রাজশিল্পীরূপে রাজতন্ত্রের অনুগামী হবেন—এটাই স্বাভাবিক ও বাঞ্ছনীয়। বিভূতিসৃষ্ট যন্ত্রটি আসলে ধ্বংসমূলক দানবীয়তার দিকটি প্রদর্শন করায়; এযেন রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের জাজ্জ্বল্যমান অস্ত্র প্রতীক। রাজার আসুরিক শক্তির বাস্তব ও প্রত্যক্ষ প্রকাশ যেন বিভূতির তৈরি যন্ত্রাসুর। যন্ত্রশক্তি মানুষের সচল জীবন ধারার পথে বাধা। যন্ত্র যদি বড়ো হয়ে ওঠে, যন্ত্র যদি প্রাধান্য পায় তাহলে প্রাণ পীড়িত হয়, মানুষ নির্যাতিত হয়। যন্ত্র সংকীর্ণ জাতীয়তা ও রাষ্ট্রনীতির পরিপোষকতা করে।


উত্তরকূটের রাজার মধ্যে নিহিত সংকীর্ণ জাতীয়তাকেই রাজা বিপুল শক্তির ভিত্তিভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে তাঁর রাষ্ট্রনীতিকে রূপায়িত করতে চেয়েছিলেন। যন্ত্রকে আশ্রয় করে শিবতরাই-এ লোকেদের দমন করাই ছিল তাঁর মৌল উদ্দেশ্য। বিভূতি স্বাভাবিকভাবেই ভাবার অবকাশ পায়নি যে। তার সৃষ্ট যন্ত্রে সাধারণ মানুষ বিপন্ন হবে। কেননা, বিভূতি হল রাজষড়যন্ত্র রূপায়ণের মাধ্যম মাত্র। বিভূতি ভেবেছে যন্ত্রশক্তির মহিমার কথা—“আমি যন্ত্রশক্তির মহিমার কথা ভাবছি।” অর্থাৎ অত্যাচারী শাসকশ্রেণি চিরকাল মানবিক মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য করে, দলিত করে, তার স্বার্থবাদী, অহংকেন্দ্রিক লিপ্সা চরিতার্থ করতে চায়। যে আবিষ্কারে স্বার্থকেন্দ্রিকতা, সংকীর্ণতা, লোভ, লালসা, পার্থিববুদ্ধি ক্রিয়াশীল থাকে, সেখানে শুভবোধ, সামঞ্জস্যবোধ অনুপস্থিত থাকে। কল্যাণাদর্শবিহীন সৃষ্টির মূলে কোনো মানবতাবোধ ক্রিয়াশীল থাকে না। বিভূতি তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।


ধনঞ্জয় হল সেই ভাবনার মানুষ যে মারকে অতিক্রম করে জয়ী হতে চায়। ধনঞ্জয় হল সেই মন্ত্রী যে মন্ত্রণা দেয়। আর সে মন্ত্রণা হল মার খেয়ে মার সহ্য করার শিক্ষা। রাজশক্তির অন্যায়, নীতিহীন, পীড়নকারী প্রয়োগ তাঁর কাছে যথাযথ মনে না হওয়ায় তিনি শিবতরাইবাসীদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাজশক্তির বিরোধিতা করেছেন। শিবতরাই-এর নিরীহ অত্যাচারিত উৎপীড়িত জনগণকে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, অন্যায় অত্যাচার, অশুভ, অকল্যাণ সহ্য করেই সমস্ত কিছুর প্রতিকার করতে হবে। সময়ের স্রোতে, কালের গতিতে সমস্ত অন্যায় চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হয়ে যায়, নির্মূল হয়ে যায়। অশুভ, অকল্যাণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সেই পথ গ্রহণ করতে হবে, যার ফলে অন্যায়কারী, অত্যাচারীও ভীত হবে। কিন্তু অনেক অত্যাচারীতই অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পছন্দ করে না।


এ নাটকে ধনঞ্জয় চরিত্রের তত্ত্বগত তাৎপর্য ও ভূমিকা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে সমালোচক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মহাশয় জানিয়েছেন–“ধনঞ্জয় বৈরাগী বিজিত অত্যাচারিত জাতির আত্মিক প্রতীক। আত্মার শক্তি জড় শক্তি নয়, শারীরিক বল বা যন্ত্রের শক্তি নয়—সে শক্তি বৃহত্তর নীতির শক্তি। শত অত্যচার শত অপমান অন্তরাত্মাকে নিষ্পেষিত করিতে পারে না... ধনঞ্জয় সমগ্র অত্যাচারিত জাতির অন্তরাত্মাকে মুক্ত করিতে চেষ্টা করিয়াছে বৃহত্তর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শক্তির দ্বারা।” ধনঞ্জয় বৈরাগীর বহু উক্তিতে রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার ছায়াপাত ঘটেছে। পরাধীন ভারতবর্ষের অহিংস স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে ধনঞ্জয় বৈরাগীর আদর্শগত, চরিত্রগত ও কর্মপদ্ধতিগত বহু সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।


‘মুক্তধারা' নাটকে ধনঞ্জয়ের মতাদর্শ ও অবলম্বিত পন্থা কিন্তু অভিজিতের কাছে সর্বতোভাবে অনুকরণীয় বলে মনে হয়নি। অভিজিৎ অহিংসার পথকে অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারীর সঙ্গে আপোষ নিষ্পত্তির পথ বলে মনে করতে পারেননি। শক্তির বীভৎসতাকে তিনি উপেক্ষা না করলেও সর্বাত্মক পরিবর্তনের জন্য সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণে ব্রতী হয়েছেন। অভিজিৎ সঙ্গতভাবেই প্রজাতির সঙ্গে, তার সুরে ও ছন্দের সঙ্গে সম্পর্কান্বিত। তিনি লক্ষ্য করেছেন, রাজার যন্ত্র দেবতার প্রতি অতিবিশ্বাস ও অন্ধভক্তি প্রকৃতির দাক্ষিণ্য অবরুদ্ধ করেছে। যন্ত্রের বীভৎস রূপ অভিজিতের কাছে গ্রহণীয় বলে মনে হয়নি। অভিজিতের মতে, যন্ত্রের চেয়ে প্রাণ বড়ো, মানুষ বড়ে । প্রাকৃতিক ও মানবিক কারণেই অভিজিতের আত্মদানের সংকল্প। অভিজিতের আত্মদান একার্থে রাজা রণজিতের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত। রাজা রণজিৎ শিবতরাইয়ের জনপদের ওপর দিয়ে প্রবাঞ্ছিত জলধারা রোধ করে উত্তরকূটের মানুষের গর্ব ও ঔদ্ধত্যের প্রকাশ ঘটালেও, যন্ত্রদানবের প্রতিষ্ঠার জন্য আনন্দোৎসবে তাঁরই পালিত পুত্র আত্মাহুতি দিলেন। এ যেন রাজা রণজিতের অশুভ লালিত বিশ্বাসকে হত্যা করে তাঁর চিত্তে শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার, আত্মিক শক্তি আর বোধির জাগরণের প্রচেষ্টামাত্ৰ ৷