“আঠারো শতকে বাঙালির জাতীয় জীবনে যে সর্বব্যাপী অবক্ষয় দেখা গিয়েছিল তার ছায়া সরাসরি পড়েছিল শাক্ত পদাবলিতে।" -তোমাদের পাঠ্যপদ অবলম্বনে মন্তব্যটি বিচার করো।

চৈতন্যদেব সমগ্র বাংলাদেশে একটা নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। তাঁর ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি 'বৈষ্ণব-পদাবলি' রচনার মধ্য দিয়ে একটা সমুন্নত এবং আধ্যাত্মিক আদর্শ স্থাপন করেছিল। তারপরই সমগ্র বাংলাদেশ রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ফলে একটা অবক্ষয় যেমন সমাজে দেখা গিয়েছিল তেমনই দেখা দিয়েছিল পদাবলি সাহিত্যেও। মধ্যযুগের সর্বশেষ সৃষ্টি হল শাক্ত পদাবলি। শাক্ত পদাবলির বিকাশ ঘটেছে ফ্রান্তিকালে ভাঙা-গড়ার যুগে, অবক্ষয়ের যুগে। এ ধারা এসেছে একালেও অর্থাৎ আধুনিক যুগেও।


বিভিন্ন কারণেই শাক্ত পদাবলি বিশিষ্টতা অর্জন করেছে। সাধারণত এগুলি গীতিকবিতা হিসাবে আখ্যাত। বৈষ্ণব পদাবলিকে পাঠ করলে যেমন রসানুভূতিতে পাঠকচিত্ত বিমুগ্ধ হয় শাক্ত পদাবলির ‘কন্তু তেমন ক্ষমতা নেই। এখানেই শাক্ত পদাবলির দুর্বলতা। অষ্টাদশ শতকের সামগ্রিক ইতিহাসের ফলশ্রুতি শাক্ত পদাবলি ; সংসারে দুঃখদৈন্য-অভাব-অভিযোগ পীড়িত শাক্ত কবিদের আর্তনাদ সমকালীন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দুর্দশাগ্রস্ত মানুষেরই আর্তনাদ।


সামাজিক অবক্ষয়ের ফলেই ব্যক্তিগত জীবনে শক্তির উজ্জীবন প্রয়োজন। শাক্ত গীতি একদিকে অষ্টাদশ শতাব্দীর দুর্যোগে নিমজ্জমান মানুষের আধ্যাত্মিক সাধনা, অন্যদিকে পরাজিত মানবাত্মার মাতৃচেতনা প্রকাশিত হয়েছে।। 'আগমনী-বিজয়া’ ব্যতীত সমস্ত শাক্তপদে শক্তিরই প্রাধান্য। কখনও তিনি অসুর বিনাশিনী দুর্গতিনাশিনী ভয়ংকরী আবার কখনও তিনি চলা বালিকা, লীলাময়ী, করুণাময়ী।


বৈষ্ণব কবিতার ছাঁচে রচিত বলেই শাক্ত পদাবলি বৈষ্ণব পদের মতোই বাল্যলীলা, গোষ্ঠ, রাস ইত্যাদি বর্ণিত আছে। তা সত্ত্বেও একথা স্বীকার করতে হয় শাক্তপদে ধরণীর ধূলিমাখা জীবনের প্রতি যে গভীর মমত্ববোধ আছে তা বৈষ্ণব পদাবলিতেও নেই। তাই ‘আগমনী-বিজয়া’ পদে মা মেনকার কণ্ঠে শোনা যায়-

“চারিদিকে শিবা রব হে। 

তার মাঝে আমার উমা একাকিনী শ্মশানে।।”


'ভক্তের আকুতি’ পর্যায়ের শাক্ত পদাবলিতে সমসাময়িক সমাজের যে অবক্ষয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তার সম্যক পরিচয়ের জন্য সে কালের ঐতিহাসিক পটভূমির সঙ্গে একটু পরিচয় থাকা প্রয়োজন। অষ্টাদশ শতকের প্রারম্ভকাল থেকেই সমগ্র দেশজুড়ে চলছিল একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা। রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলার সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। মুর্শিদাবাদের নবাবদের অত্যাচার ও নিপীড়ন তো ছিলই সেইসঙ্গে ভূ-স্বামী সামস্ত প্রভুদের শোষণ ও নিপীড়ন কিছু কম ছিল না; তাছাড়া তাদের নিজের মধ্যেও নানা স্বার্থের বিরোধ, নানা ব্যক্তিগত আক্রোশ বিদ্যমান ছিল। নিজেদের প্রভুত্ব ও ঐশ্বর্য অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টাই ছিল তাদের নিত্যকর্ম।


দেশের যখন এই অবস্থা তখন রামপ্রসাদের মতো সাধকের আবির্ভাব ঘটে। তিনি আশাহীন, নিরানন্দ জীবনে মাতৃচরণে আশ্রয় গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। সেকালের মানুষের মনে যে বিক্ষোেভ পুঞ্জিভূত হয়েছিল তা রামপ্রসাদের পদে প্রতিভাত হয়েছিল।

করুণাময়ী কে বলে তোরে দয়াময়ী। 

কারো দুগ্ধেতে বাতাসা, (গো তারা আমার এমনি দশা

শাকে অন্ন মেলে কৈ।


আরও একটি পদে বলেছেন—

“কেহ যায় মা পাল্কী চড়ে, কেহ তারে কাঁধে করে। 

কেহ গায় দেয় শালা দোশালা, কেহ পায় না ছঁড়া টেনা।”


অতএব বিচার করলে দেখা যায়, শাক্ত কবিরা সমাজ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন বলেই বাঙালি জীবনের পারিবারিক এবং জগজ্জননীর রূপ স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছিলেন।