শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’।

পরিচিতি : শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ সংস্কৃত নাটকের আঙিনায় নানাদিক থেকে একটি ব্যতিক্রমী রচনা। শৌখিন ভাবাবেশ বর্জিত কঠিন বাস্তব জগতের ঘটনা ও লোকজন নিয়ে এর কারবার। স্বভাবতই দেবদেবী, রাজরাজড়া রাজকন্যাদের নিয়ে গড়ে তোলা কল্পলোকের বিপরীতে তার অবস্থান। প্রচলিত ঐতিহ্যধারা ও ভাবপরিমণ্ডলের বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের এই নাট্যকৃতিটি এতকাল দর্শক নাটক চিত্ত জয় করে শুধু টিকে ছিল তাই নয়, তা যেন উত্তরোত্তর বেশি জনপ্রিয় হয়ে আজকের সমাজমনস্ক, নাট্যামোদী মানুষকে পর্যন্ত তৃপ্ত করেছে, একথা ভেবে আশ্চর্য বোধ হয়। রীতি-নীতি, সংস্কার ভাণ্ডার নজির এখানে অনেক। এমনকি সূচনায় ঘটা করে সূত্রাধারের মুখে নাট্যকার পরিচিতি দেওয়ার মধ্যেই নূতনত্ব লক্ষ্য করার মতো। এখানকার বিবরণ অনুযায়ী (নাট্যকার শূদ্রক একজন রাজ্যশাসক, নরপতি, তিনি একজন প্রধান ক্ষত্রিয় বা ব্রাহ্মণ ও প্রসিদ্ধ কবি। মানসিক ঐশ্বর্যে তিনি ধনী, সুধাম আকৃতি, পূর্ণিমার মতো মুখ, চকোরের মতো চোখ, গজরাজের মতো গতি এবং সেই সঙ্গে রণনৈপুণ্য, সাবধান সতর্কতা ও শত্রুর মোকাবিলায় সর্বদা প্রস্তুতি তাঁকে তাঁর রাজকীয় মর্যাদায় ভূষিত করেছিল। তেমনি ঋগ্বেদ, সামবেদ, গণিত, ললিতকলা, হস্তবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে গভীর জ্ঞান, বিবেক দৃষ্টি, অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান ও তপশ্চর্যার গুণে ধার্মিক ও বিদ্বদ গোষ্ঠীতেও তাঁর স্থান ছিল সুনির্দিষ্ট। শতবর্ষব্যাপী জীবনে তিনি তাঁর পুত্রকে রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত দেখে যেতে পেরেছিলেন। শতাব্দী পেরিয়ে দশ দিনের মাথায় তাঁর মৃত্যু হয়।


নাটকের নামকরণ : নাটকটির নামকরণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। নাটকের ষষ্ঠ অঙ্কে একটি আপাত তাৎপর্যবাহী পূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই নামকরণ বর্ণিত হয়েছে। নায়ক নায়িকার মিলনের পর বসন্তসেনা পুনশ্চ চারু দত্তের সঙ্গে উদ্যানে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন, এমন সময় চারুদত্তের পুত্র রোহ সেনের কান্না শুনতে পেলেন, কারণ জিজ্ঞাসা করে তিনি জানতে পারলেন রোহ সেনের এক বন্ধু সোনার খেলনা গাড়ি নিয়ে তার সঙ্গে খেলা করছিল এখন সে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে—তাই ছেলের কান্না। তাকে সান্ত্বনা দিতে দামি একটা মাটির গাড়ি এনে দিয়েছে কিন্তু তাতে রোহসেনের মন ভরেনি। বসন্তসেনা তার দুঃখে সহানুভূতি জানালে রোহ সেন তার পরিচয় জানতে চাইল। উত্তরে বসন্তসেনা তাকে তার মা বলে পরিচয় দিলে শিশু অস্বীকার করে। কারণ তার মা কখনো বসন্তসেনার মতো অত অলংকার পরে না। তার মাতৃপদলাভে আকাঙ্ক্ষায় এবং শিশুকে সান্ত্বনা দিতে বসন্তসেনা তার সমস্ত গহনা খুলে ওই মাটির গাড়িতে চাপিয়ে দিয়ে বললেন—'যাও, এই অলংকার দিয়ে সোনার খেলনা গাড়ি নাও গে। খেলনার মাটির গাড়িটি প্রতীকরূপে নাটকে উপস্থাপিত—নায়ক দরিদ্র, নায়িকা ধনী, তাকে নাটকের পাশে আসতে নিরলঙ্কৃত হতে হবে। আর যে দরিদ্র সে যদি সৎ হয় তবে তার অন্তরে অনন্ত ঐশ্বর্য সঞ্চিত থাকে। মাটির‌ গাড়িতেও সোনা আছে—মঞ্চে মাটির গাড়িতে সোনা ভরে দর্শককে সেই কথাটাই নাটকে বোঝাতে চেয়েছেন—এইজন্য নাটকের নাম মৃৎ-সশকটিক বা মৃচ্ছকটিক।


নাট্য পরিচিতি : দশ অঙ্কে বিরচিত ‘মৃচ্ছকটিক’ এক ‘প্রকরণ' নাটক। সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রের নির্দেশ প্রকরণের কাহিনি হবে কবিকল্পিত, নায়ক বিপ্র, বণিক অথবা অমাত্য, নায়িকা গণিকা অথবা কুলস্ত্রী উভয়ই হতে পারে। অঙ্ক সংখ্যা পাঁচ থেকে দশ পর্যন্ত হওয়া সম্ভব। মৃচ্ছকটিকে এ সব লক্ষণই মানা হয়েছে, উপরন্তু এই নাটকে যে বাস্তবধর্মী বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়, তাতে এটিকে সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমধর্মী নাটক বলা যায়।


এ নাটকের কাহিনি অতি মনোমুগ্ধকর প্রায় আধুনিক গল্প উপন্যাসের মতো। এ নাটকের নায়ক চারু দত্ত, একজন সচ্চরিত্র, সুশীল উদার হৃদয় গৃহস্থ বণিক। তার চরিত্রে অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে। সে বিবাহিত ও পুত্রবান এবং স্ত্রীর প্রতি উদাসীন নয়, তবু গণিকা বসন্তসেনার প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করেছে, যদিও সামাজিক নিয়ম ও অর্থাভাবে তার বাসনা চরিতার্থতার পথ রুদ্ধ। ওদিকে বসন্তসেনাও তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে কিন্তু তার আকর্ষণ দেহের নয়, মনের। এছাড়া নানা উপকাহিনির মাধ্যমে মূল কাহিনির নায়ক নায়িকার চরিত্রের মাহাত্ম্যের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। নাটকের পঞ্চম অঙ্কে এদের ক্ষণিক মিলন ঘটেছে, তার পরের পাঁচটি অঙ্কে বিরহ ও বহু প্রতিকূল অবস্থা বিপর্যয়ের মধ্যে দুজনে দুঃখের মূল্যে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবনে প্রেমের সার্থকতা উপলব্ধি করে। এ নাটকে বহু পার্শ্বচরিত্র বিদ্যমান, যেমন—আর্যক, স্থাবরক, শর্বিলক সংবাহক, চন্দনক ইত্যাদি কিন্তু বিদূষক মৈত্রেয় ও শ’কার-এর পণ্ডিত বিদূষক ‘বিট’ চরিত্র দুটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। শর্বিলক ব্রাহ্মণ হয়েও ঘটনাচক্রে চোর হয়েছে বটে কিন্তু তার প্রেমিকসত্তা.জাগ্রত, সর্বোপরি বন্ধুত্বের জন্য ত্যাগ প্রশংসাযোগ্য। তাইতো সমালোচক বলেছেন : “মৃচ্ছকটিক নাটক সজীব মানুষের চিত্রশালা, নিম্নবিত্ত সমাজের অমর আলেখ্য ও জনসাধারণের মুখের ভাষা প্রাকৃতের মহামূল্য ভাণ্ডার।”


মৃচ্ছকটিকের অনন্যতা :

(ক) মৃচ্ছকটিক সংস্কৃত সাহিত্যে একক এবং অনন্য রচনা। এ নাটকে নাট্যকার আমাদের কঠোর বাস্তবের দৃঢ় ভূমিতে এনে দাঁড় করিয়েছেন। এটি একটি সামাজিক প্রেমমূলক বাস্তবধর্মী নাটক। এখানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষেরই প্রতিনিধিত্ব লক্ষিত হয়—ধনবতী গণিকা বসন্তসেনা, হৃতগৌরব দরিদ্র সৎ ব্রাহ্মণ চারু দত্ত, হঠাৎ ধনী মূর্খ সংস্থাপক, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণে চোর শর্বিলক, ঔদরিক বিদূষক ব্রাহ্মণে মৈত্রেয়, ভৃত্য, স্থাবরক, দাসি মদনিকা, দরিদ্র, চণ্ডাল প্রভৃতি উচ্চ মধ্য ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির নানা চরিত্র নির্বাচন করে নাটকটিকে লেখক একটি চরিত্রের চিত্রশালায় পরিণত করেছেন।


(খ) ঘটনা গ্রন্থনে শূদ্রক বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখে। দশ অঙ্কে বিভক্ত এ নাটকটি ঘটনাবহুল। নাটকে প্লটের জটিলতা বিশেষ লক্ষণীয়, নানা উপকাহিনি যেমন—জয়ার খেলার বৃত্তান্ত, সিঁদকাটার বর্ণনা, মত্ত হাতির কথা এতে যুক্ত হয়েছে কিন্তু এগুলো মূল কাহিনির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত থেকে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। প্রেমমূলক এই নাটকে নাট্যকার যে গণ-অভ্যুত্থানের ব্যাপার দেখিয়েছেন তাও এ নাটকের মুখ্য বক্তব্য।


(গ) নাটকে করুণরস ও হাস্যরস সৃষ্টিতে নাট্যকার সফল হয়েছেন। চারু দত্তের পুত্রের কাছ থেকে বিদায়ের দৃশ্য এবং চণ্ডালদের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা কার্যকরী করতে বিলম্ব করার যুক্তির মধ্যে তার পরিচয় নিহিত। এছাড়াও নাটকের আরও একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য—এখানে অলৌকিকতার অনুপস্থিতি। সমস্ত কাহিনিধারাই হয়ে উঠেছে বাস্তবধর্মী।


(ঘ) নাটকে নাট্যকারের কবিত্ব শক্তির যথেষ্ট পরিচয় আছে—স্বভাবোক্তির সাহায্যে অলংকৃত ব্যঞ্জনা ঋদ্ধ কাব্য নির্মাণ করে শূদ্রক শ্রেষ্ঠ কবির কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছেন। পঞ্চম অঙ্কে চারু দত্তের উদ্দেশ্যে বসন্তসেনার বর্ষাভিসারের বর্ণনায় লেখক এই ধরনের কবিত্ব শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। সব মিলিয়ে তৎকালীন সমাজ জীবনের যে জীবন্ত আলেখ্যখানি নাট্যকার অঙ্কন করেছেন তাতে এটি প্রাচীন সাহিত্যের এক মূল্যবান দলিল হয়ে আছে।


সবশেষে এই নাটকে প্রকাশিত নাট্যকারের জীবন বোধের গভীরতার কথা। সংস্কৃত নাটক রাজরাজড়ার একরঙা চরিত্র অঙ্কনেই যেখানে শক্তি ক্ষয় করেছে শূদ্রক সেখানে অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনশীল সাধারণ মানুষের চরিত্র চিত্রণেই যত্নবান হয়েছেন। কবিত্বে কালিদাস শূদ্রকের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, বাগ্মীতায় ভবভূতি তাঁর চেয়ে অনেক বড়ো, কিন্তু বাস্তব চরিত্র চিত্রণে জীবনবোধের গভীরতায় শূদ্রক তাঁদের অতিক্রম করে গেছেন। কেউ কেউ মনে করেন কালিদাসের 'শকুন্তলা' কিংবা ভবভূতির ‘মাধব’ বিশেষভাবে ভারতীয়—ভারতবর্ষ ছাড়া এমন চরিত্র কল্পনা করা শক্ত, কিন্তু শূদ্রকের সংস্থাপক, মৈত্রেয় বা মদনিকা কোনও দেশকালে আবদ্ধ নয়, তারা পৃথিবীর অধিবাসী—অর্থাৎ শূদ্রক এই সকল চরিত্র চিত্রণে বিশ্বজনীন একটা দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিতে পেরেছেন— এখানেই ‘মৃচ্ছকটিকের' অনন্যতা।