সনেটধর্মী কবিতা হিসাবে 'রবীন্দ্রনাথের প্রতি' কবিতাটি কতখানি যথার্থ হয়েছে আলোচনা করো।

কবিতার এক বিশেষ রূপই সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা। বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তই সনেটের প্রবর্তক। কবির এক অখণ্ড ভাব-কল্পনা সনেটে আত্মপ্রকাশ করে। ইটালিয়ান শব্দ 'সনেটো' থেকে সনেট শব্দটি এসেছে। সমালোচকের ভাষায়, “The Sonnet is a short lyrical poem complete is one stanza containing fourteen lines of five measured verse.'


চতুর্দশ শতাব্দীর ইটালিয়ান কবি পেত্রার্ক (১৩০৮-৭৪) সনেটের জন্মদাতা। দান্তে, ট্যাসো প্রমুখ কবিদের মতো ইংরাজি সনেট লেখকগণ অনেকেই কবিতার এই আঙ্গিকে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ইংরাজি ষোড়শ শতাব্দীতে ওয়াট এবং স্যারে প্রথম সনেট রচনা করেন। এরপর মিলটন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীট্স, রসেটির হাতে সনেট চরম উৎকর্ষ লাভ করেছে।


সনেটে চোদ্দটি পংক্তি বা চরণ থাকে। এই চোদ্দটি চরণ আবার দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম আচরণকে বলে অষ্টক, এবং শেষে ছয় চরণকে বলে ষটক, প্রথম আট চরণে ভাব কল্পনাটি রূপধারণ করে, এবং পরের ছয় চরণে ভাব কল্পনাটি ব্যাখ্যাত হয় এবং পরিণতি পায়। অষ্টকের আটচরণ আবার দুইভাগে বিভক্ত। প্রতি চার পংক্তির ভাগের নাম চতুষ্ক। পরের ছয় পংক্তি আবার দুই ভাগে বিভক্ত। এক্ষেত্রে প্রতি ভাগের নাম ত্রিপাদিকা। আঙ্গিকগত এই ভাগ সত্ত্বেও সমগ্র কবিতাটি একটি অখণ্ড ভাবের জন্ম দেয়।


পেত্রার্ক রচিত সনেটের চরণান্তিক মিলটি একটি নিয়মে বাঁধা। এই নিয়মটি হল (কখ খক + কখ + খক) (গঘঙ + গঘঙ) অথবা (ঘঘ)। মধুসূদনও সনেটের এই মিলবিন্যাসকেই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু শেকসপিয়র বহু ক্ষেত্রেই এই নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন। তিনি শেষ দুটি চরণকে দোহার রূপ দিয়েছেন। মাইকেল ও শেকসপিয়রের মতো অষ্টক ও ষটকেও মিল সর্বত্র রক্ষা করেননি।


মধুসূদন দত্তের পর রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, দেবেন্দ্রনাথ সেন, মোহিতলাল মজুমদার প্রমুখ কবিদের হাতেও বিভিন্ন সময়ের বাংলা সনেট সমৃদ্ধ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সনেটেও বিভিন্ন প্রকার বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। মধুসূদনের বাংলা সনেটের রূপ দাঁড়ায় অনেকটা এইরকম–(ককখখ + গগঘঘ) + (ঙঙচ + চছছ), (কখখক + কখখক) + (গগঘ + ভঘণ্ড), (কখখক + কখখক) + (গঘগ + ঘগঘ)।


একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ষটকে প্রথম দুই চরণে দোহার সৃষ্টি হয়, সনেটে একদিকে যেমন কঠিন বন্ধনের মধ্যে থাকতে হয় ফলে কবি কল্পনাকে সংকুচিত থাকতে বাধ্য করা হয়, অন্যদিকে উদ্দাম কাব্যচ্ছ্বাস এই বন্ধনে সংযত হয়ে অপূর্ব শ্রী ধারণ করে।


বুদ্ধদেব বসুর 'বাইশে শ্রাবণ' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত 'রবীন্দ্রনাথের প্রতি' কবিতাটি একটি চোদ্দ লাইনের ছোটো সনেটধর্মী কবিতা। অনেকগুলি সনেট তিনি রচনা করেছিলেন। রচিত সেই সনেটগুলি বিভিন্ন ভাবেই বাংলা কবিতার জগতকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। পাশ্চাত্য সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে বুদ্ধদেব পেত্রার্কের সনেটধর্মী কাব্যের সঙ্গে যেমন পরিচিত ছিলেন। তেমনি শেকসপিয়র, মিলটন, রসেটির সনেটধর্মী রচনার পাঠও তার মজ্জাগত। সনেটের আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নির্মাণে তিনি পেত্রার্কীয় সনেট রীতির সঙ্গে শেক্সপীয়র সনেটের মিলন ঘটিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সনেট সৃষ্টির পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি চোদ্দ চরণের সনেটকে অষ্টক ও ষটকের ভাগে বিন্যস্ত করে রচনা করেছেন। এগুলিতে যথাক্রমে আটচরণের বা ছয়চরণের দুটি স্তবক থাকে। কখনও অবশ্য তিনচরণের দুটি স্তবক নিয়ে ষষ্টক অংশ নির্মাণ করেছেন।


‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি' কবিতাটি পাশ্চাত্য কাব্য সাহিত্যের পেত্রার্কীয় সনেটের আদর্শে রচিত। আট এবং ছয় পংক্তির দুটি স্তবকে কবিতাটির শরীর নির্মিত। মিল বিন্যাসটি এরকম—কখখক + গঘঘগ + ঙচচঙ + ছছ। পাশ্চত্য সনেটের মিল সমগ্র কবিতায় পুরোপুরি বজায় থাকেনি। ভাবের গভীরতার কবিতাটিতে এসেছে অন্যতম প্রার্থনা ও শক্তি লাবণ্যের দ্যুতি। প্রথম স্তবকে শ্মশান শয্যায় শায়িত সভ্যতার মৃঢ়তার পরিচয়, দ্বিতীয় স্তবকে রবীন্দ্রবাণী স্মরণে জীবনের জয়ধ্বনি। কবিতাটির অন্ত্যমিলের বৈশিষ্ট্যটি পেত্রার্কীয় সনেট রীতিতে লক্ষ করা গেলেও এ কবিতায় তেমনভাবে আসেনি। অন্ত্যমিলনের ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও অসম শব্দের প্রয়োগ ঘটেছে। তবে তা বেমানান হয়ে ওঠেনি। কবিতাটিতে মধুসূদনের সনেট রীতির আদর্শও একস্থলে লক্ষ করা যায়। চরণের শেষে ছেদ না ঘটিয়ে মধ্যবর্তীস্থলে এই ছেদ ঘটিয়েছেন কবি। যেমন—

প্রাণ রুদ্ধ প্রাণ স্তষ্ক। 

ভারতের স্নিগ্ধ উপকূলে

লুব্ধতার লালা ঝরে।


এইভাবে পুরো কবিতাটিতেই প্রায় ৪টি চরণের মাঝখানে ছেদ ঘটিয়ে কবিতার প্রবহমানতাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন তিনি। প্রতিচরণে ১৪টি অক্ষরের পরিবর্তে ১৮টি অক্ষর বসিয়ে ৮ এবং ১০ মাত্রার চরণ সাজানোর মাধ্যমে নতুন ধরনের পরীক্ষার প্রভাব লক্ষণীয়।


এ কবিতার ভাবলোকের সাথে রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের কিছু কবিতার মিল রয়েছে। ‘নবজাতকে’র ‘প্রায়শ্চিত্ত' কবিতায় যে রবীন্দ্রবাণী আমাদের মর্মে প্রবেশ করেছিল এ কবিতাতেও তার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথের কবিতাটিতে ছিল ‘ক্ষুধাতুর আর ভূরিভোজীদের নিদারুণ সংঘাত ।‘পক্ষীমানব’ কবিতাটিও একই ভাবনার স্ফূরণজাত। আবার রোগশয্যায় কাব্যগ্রন্থের ৮ সংখ্যক কবিতা, জন্মদিনের ২১ সংখ্যক কবিতা, শেষ লেখার ৬ সংখ্যক কবিতাতে যে বেদনাময় পৃথিবীর চিত্র আছে সেই একই চিত্রানুভূতির টান লক্ষ্য করা যায় বুদ্ধদেব বসুর 'রবীন্দ্রনাথের প্রতি' কবিতায়। দারুণ দুঃসহ দিনে রবীন্দ্রনাথের মতো বুদ্ধদেবও বলেছেন,

“উদ্দীপ্ত তরুণ প্রাণে/ঘাতকের অস্ত্র যারা হানে/ 

মানুষের যে মূল্য পরম / তারে পদাঘাত করে 

যাদের বিক্রম/তাদের দুঃসহ পাপে তীব্র অভিলাপে

•••••••

…….তবে ব্যর্থ কবি জন্ম।”


এই আশ্চর্য মানবমন্ত্রের জয়গানেই ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি' কবিতাটির স্তর পরম্পরা সাজানো। ধ্বংসের পঙ্কশয্যা থেকে উঠে আসা কবি চৈতন্য কোনো নিরাশার অন্ধকারকে আমাদের সামনে তুলে আনেনি। মানব সংহিতার জয়গাথায়, মন্ত্রের দীক্ষায় সমগ্র মানবসমাজের সামনে তুলে এনেছেন বিশ্বাসকে উজ্জয়িনী করে তোলার ধ্বনিময়তা-

“অবশেষে লভেছি তব বাণী

তাইতো জানি না ভয়। 

জীবনেরই জয় হবে জানি।”