বৈষ্ণুব রসকীর্তনের প্রারম্ভে গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ সন্নিবিষ্ট করার কারণ বুঝিয়ে দাও। প্রসঙ্গ ক্রমে গৌরচন্দ্রিকার সঙ্গে সাধারণ গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদের প্রভেদ নির্দেশ করো। এই জাতীয় পদ রচনায় শ্রেষ্ঠ কবির কৃতিত্বের পরিচয় দাও।

নাটক হোক কাব্য হোক, গান হোক, তা বুঝতে গেলে আগে তার প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে হয়। যখন কোনও নাটক মঞ্চস্থ হয় তখন প্রারম্ভেই কিন্তু সূচনা হিসাবে একটা প্রেক্ষাপট স্থাপন করা হয় সেখানে ব্যক্তি চরিত্র থাকতে পারে বিষয়বস্তু থাকতে পারে আবার পরিবেশ বা সমাজের জীবন্তরূপ ফুটে উঠতে পারে। ঠিক তেমনই বৈষ্ণবপদাবলীর মধ্যে অনুপ্রবেশের জন্য সূচনার প্রয়োজন। বৈষ্ণব পদাবলীর মূলভাব রাধাকৃষ্মলীলা। পদাবলী গৌরাঙ্গের আলোচনায়ও সমৃদ্ধি লাভ করে। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ বিশ্বাস করেন যে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধাপ্রেমের স্বাদ এবং রাধা রূপে কৃষ্ণপ্রেমের স্বাদ গ্রহণ করার জন্যই গৌরসুন্দরের রূপ ধারণ করে নবদ্বীপধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। গৌরচন্দ্রিকায় গৌরাঙ্গের রূপবর্ণনায় রাধার ভাবটি সুস্পষ্ট হয়েছে। রাধা-কৃষ্ণের লীলা অবলম্বনেই মহাজন পদাবলী রচিত হয়ে থাকে, কিন্তু চৈতন্যের আবির্ভাবে তার মধ্যে আরও বৈচিত্র্য এসেছে। গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ রচনা করায় বৈষ্ণব পদাবলীকে আরও গতিশীল হয়েছে।


গৌর চন্দ্রিকা তো গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ, কিন্তু যে কোন গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদই গৌরচন্দ্রিকা নয়। শ্রীচৈতন্যদেবের রূপ ও মহিমার বর্ণনা, নদিয়া-নগরী ভাণের আশ্রয়ে রচিত পদগুলি গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ। কিন্তু ব্রজলীলার অনুসরণে যে সকল গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদরচিত হয়েছে একমাত্র ঐগুলোকেই গৌরচন্দ্রিকা বলা হয়। এছাড়াও গৌরাঙ্গদেবের লৌকিক জীবন, সন্ন্যাস ও নামকীর্তনের বর্ণনা, শচীমাতা ও বিষ্ণুপ্রিয়ার বিরহ অবলম্বনে, রচিত পদ এবং চৈতন্য সহচরদের ও সম্বন্ধে রচিত পদগুলো গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ—এদের গৌরচন্দ্রিকা বলা চলে না। বস্তুত রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বৈষ্ণুব কবিগণ যে সকল গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ রচনা করেছেন, গৌরচন্দ্রিকার মর্যাদা একমাত্র এদেরই প্রাপ্য। গৌরাঙ্গদেব রাধাভাবে ভাবিত ছিলেন যে সকল পদে সেগুলোকে গৌরচন্দ্রিকা বলা যেতে পারে। তাই তো-

“নীরদ নয়নে   নীর ঘন সিঞ্চনে

পুলক মুকুল অবলম্ব,”


পদটি গৌরচন্দ্রিকার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু গৌরাঙ্গের বাল্যলীলার পদ

“শচীর আঙ্গিনায় নাচে বিশ্বম্ভর রায়। 

হাসি হাসি ফিরি ফিরি মায়েরে লুকায়।।”

কেবল গৌরঙ্গাবিষয়ক পদ হিসাবে বিবেচিত।


কবি প্রতিভা : জ্ঞানদাসকে যেমন চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য বলা হয়, তেমনি গোবিন্দদাসকেও বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য বলে বিবেচনা করা হয়। বিদ্যাপতির পদের সঙ্গে গোবিন্দদাসের পদের ভাবসাদৃশ্য ও রূপসাদৃশ্য লক্ষ্য করলে তাঁকে ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ আখ্যায় ভূষিত করা তাৎপর্য উপলব্ধ হয়। গোবিন্দদাস রচিত অন্তত নয়টি পদের ভণিতায় বিদ্যাপতির নাম পাওয়া যায়। রাধামোহনঠাকুর অনুমান করেছিলেন— গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির অসম্পূর্ণ পদগুলি সম্পূর্ণ করে তাতে যুগ্ম ভূমিকা ব্যবহার করেছেন। কেউ কেউ অনুমান করেন গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির ত্রিচরণ পদের চতুর্থ পদ পুরণ করেছেন—

‘বিদ্যাপতি কহ    নিদারুণ মাধব

গোবিন্দদাস রসপুর।


গোবিন্দদাসের ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা অবিমিশ্র। অনেকের মতে এতে বাংলাভাষার মিশ্রণ ঘটেনি। তদ্ভব শব্দ কম থাকলেও অধিকাংশ শব্দই তৎসম বা অর্ধতৎসম। পদগুলির আগাগোড়া বিশ্লেষণ করলে গোবিন্দদাসকে যে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দান করা হয়েছে তা অসঙ্গত মন হয় না।


ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার প্রয়োগে বিদ্যাপতির সার্থক উত্তরসুরী গোবিন্দদাস। তাঁর রচনার প্রধান গুণ শ্রুতির মাধুর্য—

“বসনারোচন শ্রবণ-বিলাস ।

রচই রুচির পদ গোবিন্দদাস।।”


এপ্রসঙ্গে ড. সুকুমার সেন মন্তব্য করেছেন—“ইহার লেখায় ছন্দের বৈচিত্র্য যথেষ্ট আছে। অনুপ্রাসের ও উপমা রূপকাদির অর্থালঙ্কারের প্রয়োগ কবিরাজের মতো আর কোনো পদকর্তাই করিতে পারেন নাই। শব্দের ঝঙ্কারে এবং পদের লালিত্যে গোবিন্দদাস কবিরাজের গীতিকবিতাগুলি বাংলা সাহিত্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।”


গোবিন্দদাস ছিলেন সৌন্দর্যরসিক কবি। তাঁর রাধিকাকে তিনি তিলতিল করে সৌন্দর্যের সমারোহে তিলোত্তমা করে তুলেছেন। গোবিন্দদাসের রচনার একটি বড়োগুণ হল সঙ্গীতময়তা৷ এখানে তিনি বিদ্যাপতির ভাব শিষ্য নন, বৈষ্ণব কবিতার আদি পুরুষ জয়দেব গোস্বামীর কাছে থেকে যেন সুরের মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করেছেন। গোবিন্দদাসের রচনার আর একটি বিশেষগুণ— নাটকীয়তা ও চিত্রধর্মিতা। এই সমস্ত জ্ঞানাবলীর কারণে গোবিন্দদাসের পদগুলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ এবং এরজন্য তাঁকে উচ্চস্থান দেওয়া হয়ে থাকে।

গোবিন্দদাস কৃষ্ণলীলার নানা পর্যায়ের পদ রচনা করেছেন, তারমধ্যে গৌরচন্দ্রিকা, রূপানুরাগ এবং অভিসারের পদগুলি রচনাকরে বেশী খ্যাতিনাম হয়েছেন।