“রস ও কাব্যের জগৎ অলৌকিক মায়ার জগৎ।"

অতিব দুর্বোধ্য হল কবিকর্ম ও কবিধর্ম। কবি যে তাঁর প্রতিভার মায়াবলে লৌকিক ভাব ও লৌকিক কারণের এক অলৌকিক কাব্যজগৎ সৃষ্টি করে পাঠক ও দর্শকবর্গের মনে রস সঞ্চারে সমর্থ হন তা তাঁর সমান অনুভূতিই প্রমাণ দেয়। ভাব ও রসের এবং বস্তু জগৎ ও কাব্য জগতের ভেদকে সুস্পষ্ট করার জন্য আলংকারিকগণ রস ও কাব্য জগৎকে অলৌকিক মায়ার জগৎ বলে অভিহিত করেছেন। এক্ষেত্রে এই রস বা অলৌকিক কথার তাৎপর্য কি জানা আবশ্যক?


সংক্ষেপে রস কথাটি বলতে বোঝায়—“রস্যতে স্বাদ্যতে ইতি রসঃ “যা আস্বাদিত হয় তাই রস। অর্থাৎ আনন্দ, কাব্য বলতে কবির বাঙনির্মাণ বা শব্দশিল্পকে বুঝায়। যে শক্তির বলে কবিগণ তাঁদের এই নিপুণ সৃষ্টিকর্ম করেন তার নাম প্রতিভা, যে যে প্রতিভার দ্বারা অপূর্ব বস্তু নির্মাণে সমর্থ হন তাই প্রতিভা। কবিবৃন্দ তাঁদের আশ্চর্য প্রতিভার শব্দে সমর্পিত করেন বস্তুরাশি, বিধাতার সৃষ্ট জগতের বাইরে যেন এক মায়ার জগৎ রচনা করেন। রসাত্মক অর্থাৎ আনন্দময় কাব্যের জগৎ তাই অলৌকিক, অপূর্ব।


রস বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আলংকারিকগণ মানসিক ও বাহ্যিক দুপ্রকারের উপাদান পেয়েছেন। ভাব নামে চিত্তবৃত্তি বা ইমোশানগুলি হল রসের মানসিক উপাদান, আর রসের বাহ্যিক উপাদান বাইরের লৌকিক সেখান থেকেই আসে রসের বাইরের উপাদান। আলংকারিকদের মতে কাব্য জগতের ওই বাহ্যিক উপাদানগুলি এমন ক্রিয়া সৃষ্টি করে যে মনের ভাব রূপান্তরিত হয়ে রসে পরিণত হয়। সুতরাং রস লৌকিক বস্তু নয় অলৌকিক। মনের যে সব ভাব রসে রূপান্তরিত হয় তারা অবশ্য লৌকিক। দৈনন্দিন জীবনের লৌকিক ঘরকন্নার জগতে তাদের অস্তিত্ব এবং সেই জগতের সঙ্গে তাদের কারবার। তাই ভাব বা ইমোশান, রস নয়।


উদাহরণস্বরূপ অতুল গুপ্ত মহাশয় বলেছেন, শোক একটি মানসিক ভাব বা ইমোশান, লৌকিক জগতের বাহ্যিক কারণে মনে শোক জাগলে মানুষ শোকার্ত হয়। কিন্তু শোকার্ত লোকের মনে শোক তার কাছে রস নয় এবং সে শোকের কারণটিও কাব্য নয়। কবি যখন তার প্রতিভার মায়াবলে এই লৌকিক শোক ও তার লৌকিক করণের এক অলৌকিক চিত্র কাব্যে ফুটিয়ে তোলেন তখনই পাঠকের মনে রসের উদয় হয়, যার নাম করুণ রস। এই করুণ রস শোকের ইমোশান নয়। শোক হচ্ছে দুঃখদায়ক; কিন্তু কবির কাব্যে মানুষের মনে যে করুণ রসের সঞ্চার করে তা চোখে জল আনলেও মনকে আনন্দে পূর্ণ করে। রবীন্দ্রনাথও তাই লিখলেন—“সাহিত্যের বাইরে এই সুন্দরের ক্ষেত্র সংকীর্ণ। সেখানে প্রাণতত্ত্বের অধিকৃত মানুষকে অনিষ্টকর কিছুতে আনন্দ দেয় না।”


লৌকিক অর্থাৎ ব্যবহারিক জগতের শোক হর্ষ প্রভৃতির নানা লৌকিক হেতু বা কারণ মানুষের মনে শোক হর্ষ প্রভৃতি লৌকিক ভাবের জন্ম দেয়। এর কোনোটি দুঃখের কোনোটি বা সুখের। কিন্তু এইসব লৌকিক ভাব ও তাদের লৌকিক কারণ কাব্যের জগতে এক অলৌকিক রূপ প্রাপ্ত হয় ও পাঠক কি সামাজিক বর্গের মনে এইসব লৌকিক ভাবে যে বৃত্তি বা বাসনা আছে তাদের রসরূপ এক অলৌকিক বস্তুতে পরিণতি দান করে। সাহিত্য দর্পণাকার বিশ্বনাথ কবিরাজ মহাশয় এ সম্পর্কে যা লিখলেন তার মর্মার্থ হল—“লোক সম্বন্ধ হেতু শোক হর্ষাদির কারণ হতে আগত বা উদ্ভুত শোক হর্ষাদি ভাবলোকে অলৌকিক আখ্যা পরিচিতি লাভ করে। আবার কাব্য সম্বন্ধ হেতু অলৌকিক বিভাররূপে পরিণত সেইসব হতে সুখ জন্মে। এতে কোনো ক্ষতি হয় না।


প্রসঙ্গক্রমে পাশ্চাত্য সমালোচক Oscar Wild (ওস্কার ওয়াইল্ড)-এর উক্তিটি বিশেষ স্মরণযোগ্য: "The only beautiful but things are things that do not concern as." আবার দার্শনিক কান্ট (Kant) ও বলেছেন : “What is beautiful artistically is the object of delight apart from any interest."


প্রজাপতিও স্রষ্টা কবিও স্রষ্টা। প্রজাপতি সৃষ্ট জগতে সুখের সঙ্গে দুঃখ আছে। কবির সৃষ্ট কাব্য জগতে আছে কেবল আনন্দ, রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন—“সাহিত্য ব্যক্তিবিশেষের নহে, তাহা রচয়িতার নহে, তাহা দৈববাণীর।" কাব্য প্রকৃতপক্ষে দৈব ব্যাপার, অলৌকিক, তাইতো শেলী সোচ্চার কণ্ঠে ঘোষণা করলেন— “Poetry is indeed something divine." অর্থাৎ কবি তাঁর নব নবোন্মেষ শালিনী ও অঘটন ঘটনপটীয়সী প্রতিভার অলৌকিক মায়ার জগৎ এক দিব্য কাব্যজগতের সৃষ্টি করেন।


পদ্মের সঙ্গে কাব্যের জগতের তুলনা একান্ত সঙ্গত বলেই মনে হয়। পঙ্কজাত পদ্ম বিকশিত হয়ে শতদল শোভা প্রকাশ করে, প্রকাশ করে তার সৌরভ। মানুষের মন তার সুষমা সৌরভে পুলকিত হয়ে ওঠে। লৌকিক জগতের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ-বেদনা ক্রোধ ভয় ইত্যাদি অতি সাধারণ উপাদান নিয়ে রচিত হয় কাব্য। কিন্তু কবি প্রতিভার এমনি মায়া যে লৌকিক উপাদানের সেই সৃষ্টি মানুষকে অলৌকিক, অনির্বচনীয় আনন্দের আস্বাদ দেয়।