'একেই কি বলে সভ্যতা' প্রহসনটির গঠন-কৌশল সম্পর্কে ব্যাখ্যা দাও।

‘একেই কি বলে সভ্যতা' মাত্র দুটি অঙ্কে বিভক্ত এবং অঙ্ক দুটিও মাত্র দুটি দৃশ্যে বিভাজিত। পঞ্চাঙ্ক নাটকের মতো ব্যাপ্তি না থাকলেও এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে মধুসূদন কীভাবে নাটকীয় দ্বন্দ্ব সংঘাতকে দক্ষতার সঙ্গে উপস্থিত করেছেন তা পর্যালোচনার অপেক্ষা রাখে। মূলত প্রহসনটির দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে আদর্শ-নিষ্ঠ রক্ষণশীল পিতার সঙ্গে প্রগতিপন্থী ভণ্ড, লম্পট, স্বেচ্ছাচারী পুত্রের সংঘাতের মধ্যে দিয়ে। একদিকের প্রতীক হচ্ছেন নবকুমারের পিতা অন্যদিকের প্রতীক হচ্ছে নবকুমার ও তার সাঙ্গপাঙ্গের দল। সংঘাতটা যদিও গুরুগম্ভীর নাটকের মতো তীব্র ও ভয়াবহ নয় তবুও তার উপস্থাপনা ও রসপরিণাম আমাদের মুগ্ধ বিবশ করে।


প্রথম দৃশ্যে কালীনাথ ও নবকুমারের প্রথম দুটি সংলাপ দর্শকের কৌতূহলের উদ্রেক করে। কারণ সংলাপ দুটি জানিয়ে দেয় বৃন্দাবন থেকে কর্তাবাবুর আগমন তাদের স্বেচ্ছাচারের পথের কণ্টক-স্বরূপ। তাদের সাধের ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী' সভায় স্ফূর্তি করার ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ। আর সঙ্গে সঙ্গে এ দুজনের চরিত্রের প্রকৃত স্বরূপটাই দর্শকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সহজেই বোঝা যায় এরা দুজন অর্ধশিক্ষিত, মাতাল, লম্পট এবং ভণ্ড। এর কিছু পরেই কর্তাবাবুর আগমনে বোঝা যায়, তিনি আদর্শ নিষ্ঠ সৎ বৈব এবং আপন পুত্রের ভবিষ্যৎ ভাবনায় ব্যাকুল। তারপর বাবাজির আগমনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নাটকের গতি কোন্ দিকে এগোতে পারে এরফলে দর্শকের মনে ‘Dramatic curiosity' কিছুটা বাড়িয়ে দেয়।


দ্বিতীয় দৃশ্যে উদ্‌ঘাটন পর্বের বিষয়টিকে আরও একটু বিস্তৃত করা হয়েছে। প্রথম দৃশ্যে নবকুমারের ও কালীনাথের কথোপকথনের মধ্যে যে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার’ উল্লেখ আছে, সেই সভার আসল চেহারাটা কী, দর্শকদের সামনে তা তুলে ধরার জন্য এই দৃশ্যের অবতারণা। কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা এই দৃশ্যটি রচনায় নাট্যকার চরিত্র-চিত্রণ ও পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে অসামান্য দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।


এরপর দ্বিতীয় অঙ্ক। প্রথম অঙ্কটি সম্পূর্ণভাবে উদ্‌ঘাটন পর্বের পিছনে ব্যথিত হওয়ায় নাটকীয় গঠনরীতি অনুযায়ী রাইজিং অ্যাকশান থেকে ক্লাইম্যাক্স এবং তার চূড়ান্ত পরিণতি সবকিছুই তাঁকে সম্পন্ন করতে হয়েছে দ্বিতীয় অঙ্কের স্বল্পতম পরিসরের মধ্যে। আলোচ্য প্রহসনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের দিক থেকে বিচার করলে এই অঙ্কের প্রথম দৃশ্যটিকে কেন্দ্রীয় দৃশ্যরূপে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। কারণ, পতিতালয়ের বাস্তবানুগ ছবি, লম্পট মাতালদের হল্লা, খেমটাওয়ালীদের কুরুচিপূর্ণ নাচগান, মদমাংস ভক্ষণ, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাতালদের ঝগড়া, ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে এক সংকর জাতীয় ভাষার ব্যবহার, সব মিলিয়ে এই দৃশ্যের নাট্যরস দর্শককে অভিভূত করে তোলে। যদিও প্রতিপক্ষের সাক্ষাৎ উপস্থিতি নেই তবু নাটকের রাইজিং অ্যাকশনের কাজটি এই দৃশ্যে আভাসিত হয়েছে নবকুমার ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের নানা কেচ্ছার মধ্য দিয়ে। এই কেচ্ছার সূত্র ধরেই যে সংঘাত তীব্রতর হচ্ছে তা অনুমান করা যায়।


নাটকের চরম মুহূর্ত এবং তার নিষ্পত্তি চিত্রিত হয়েছে দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে। এই দৃশ্যের সামাজিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। তৎকালীন কলকাতার উচ্চ মধ্যবিত্ত সমাজের অন্তপুরের দলিল সদৃশ বাস্তব ছবি মধুসূদন উপস্থিত করেছেন। নারী জীবনের ব্যর্থতা জনিত হাহাকার এবং কারুণ্যের সঙ্গে রঙ্গ ও কৌতুক রসের তরল প্রবাহের যুগপৎ মিশ্রণে, চরিত্র, চিত্রণের অসামান্য দক্ষতায়, ব্যঙ্গের বিদ্যুৎ ঝলক সৃষ্টির নৈপুণ্যে দৃশ্যটি বাংলা নাট্য সাহিত্যে একটি বিরল দৃশ্য বলে বিবেচ্য। বিশেষ করে প্রহসনের অস্তিমপর্বে পুত্রের অধঃপতনে ক্রুদ্ধ বিচলিত পিতা পুত্রকে যখন তিরস্কার করেছেন এবং বৃন্দাবনে চলে যাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন, তখন মাতাল নবকুমারের “হিয়র, হিয়র, আই সেকেন্ড দি রেজোলুসন” কথাগুলো পিতার বৃন্দাবন যাত্রার ঘোষণাকে নাটকের শেষ পরিণতি রূপে নির্দেশ করেছে।


সুতরাং একথা বলা যেতে পারে, মোট চারটি দৃশ্য সমন্বিত দুটি অঙ্কের এই স্বল্পতর পরিসরে পঞ্চাঙ্ক নাটকের রস নিষ্পত্তির স্তর পরম্পরাকে সুবিন্যাস্ত করে মধুসূদন অপূর্ব শিল্প নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।