‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' মূলত এক ব্যঞ্জনাধর্মী প্রহসন। উক্তিটির সত্যতা বিচার করো।

মাইকেল মধুসূদন কৃত প্রহসনটির প্রথম নাম ছিল ‘ভগ্ন শিবমন্দির’। যার মধ্যে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার প্রবণতা লক্ষিত হয়। পরে শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শানুক্রমে এর নামকরণ করা হয় ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ'। একদিকে ধর্মীয় ও দৈব আমরণের অনুষঙ্গ, অপরদিকে নারীকে একটি বিশুদ্ধ শক্তিরূপে লক্ষ্য করা এ নাটকের কাহিনি বিন্যাসের মূল পটভূমিকা। দুশ্চরিত্র ভক্তপ্রসাদ অত্যন্ত লঘুভঙ্গিতে নারী সম্পর্কে কয়েকটি মন্তব্য করেছে। এ মন্তব্য অসচ্চরিত্র ব্যক্তির মুখ্যভাষা রূপে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যমজকন্যা ফতেমা প্রসঙ্গে তাঁর উক্তি—“হ্যা, স্ত্রীলোক তাদের আবার জাতি কি ? তারা তো সাক্ষাৎ প্রকৃতি স্বরূপা।" শিবমন্দির প্রাঙ্গণে ফতেমাকে দেখে ভক্ত প্রসাদের উচ্ছ্বাস— “ছুঁড়ি রূপে যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। এ যে আস্তাকুড়ে সোনার চাঙ্গড়”। পঞ্চীকে দেখে তাঁর মন্তব্য—“কবিরা যে নবযৌবনা স্ত্রীলোককে মরালগামিনী বলে বর্ণনা করেন, সে কিছু মিথ্যা নয়।” এথেকে মনে হয় অসচ্চরিত্র ভক্তপ্রসাদও নারীর মধ্যে শক্তি সৌন্দর্যের কাব্যকে আবিষ্কার করেছেন।


পঞ্চীর রূপ বর্ণনায় ভক্তপ্রসাদ 'বিদ্যাসুন্দর'-এর বিদ্যার রূপবর্ণনা অংশ থেকে দুটি পঙক্তি উদ্ধার করেছেন। ফতেমাকে দেখেও ভক্তপ্ৰসাদ আওড়েছেন 'বিদ্যাসহ সুন্দরের রহস্য' অংশ। আর শিবমন্দিরের ধারণাটিও সম্ভবত 'অন্নদামঙ্গল' থেকেই পাওয়া। 'শিবের’ সব মিলিয়ে অতি তাৎপর্যপূর্ণভাবে অন্নদামঙ্গলের বিদ্যাসুন্দর পালাটি এই প্রহসনে স্থান করে নিয়েছে।


ভক্তপ্রসাদের অধঃপতন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই শিবের জাগরণ ঘটল 'নেপথ্যে গম্ভীর স্বরে' আকাশবাণীর মতো এক সাবধান বাণী উচ্চারণে। হানিফ নেপথ্য থেকে কণ্ঠদান করেছে বটে কিন্তু তার ভাষা বাচস্পতির রচনা ‘গম্ভীর স্বর' স্পষ্টতই দেবমহিমা যুক্ত। এইভাবে শিক্ষিত অশিক্ষিত উচ্চ-নীচ হিন্দু-মুসলমানদের সম্মিলিত শক্তির মাধ্যমে যখন শিবের উত্থান, জাগরণ ও প্রকাশ ঘটল, তখন বাচস্পতির মন্তব্য—“কলিদেব এতদিনেই যথার্থ রূপে এ ভারত ভূমিতে আবির্ভূত হলেন।” উক্তিটি একটি চমৎকার স্বাস্থ্যপ্রদ মনোরম Irony রূপে প্রতিভাত হয়। অথবা শিবের সঙ্গে কলির একটি সমীকরণ ঘটে যায়।


গ্রামজীবনের পটভূমিকায় যে নাট্যকাহিনি স্থাপিত, হঠাৎ আকস্মিকভাবে সেখানে কলকাতার তদানীন্তন সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের পটোতলনের নিশ্চয়ই একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নাটকের ছিল। এ শুধু পুত্রের নৈতিক অধঃপতনের আশঙ্কার কথা তুলে অধঃপতিত পিতার ভণ্ডামি প্রদর্শন মাত্র নয়। নাট্যকারের উদ্দেশ্য আরও গভীর। ‘আনন্দ’ ও ‘অম্বিকা’ নাম দুটির অর্থ লক্ষণীয়। আনন্দ আনন্দময় চরিত্র, কলকাতার সংবাদাদি অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে সততার সঙ্গে সে দিয়েছে। অম্বিকার কোনো নিন্দাই সে করেনি। বরং তাকে অধিকতর পড়াশোনার সুযোগ দিতে বলেছে।


পঞ্চীর প্রসঙ্গটি নাটকে একটি বিশেষমাত্রা পেয়েছে। পঞ্চীই যেন ফতেমার পূর্বরূপ। সংবাদে প্রকাশ, পঞ্চীর বাপ পীতাম্বর আজ গেছে কেশবপুরের হাটে, নুনের পাইকারি ব্যবসাদার সে। জাতিতে তেলী, নুন খেলে নাকি গুণ গাইতে হয়। কারও নুন খেলে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে নেই। ‘পীতাম্বর’ ও ‘কেশব'—দুটিই শ্রীকৃষ্ণের নামান্তর। ভক্তপ্রসাদ সে সংবাদ শুনে স্বগতোক্তি করেন—“কৃষ্ণ হে তোমার ইচ্ছা।” অর্থাৎ নাটকের মধ্যে একটি ধর্মীয় আচরণকে নৈতিকতার আদর্শে উন্নীত করা হয়েছে।


সর্বোপরি, ভক্তপ্রসাদের বিবেকবোধ তাঁর দ্বন্দ্ব সংশয় প্রকাশ পেয়ে প্রহসনটি অন্য মাত্রা পেয়েছে। নারীর রূপ সৌন্দর্য কামমোহিত ভক্তপ্রসাদের মধ্যে যে কাব্যদোলার সৃষ্টি করেছে, তা তাঁর দূরপনেয় কলঙ্করেখাকে ভগ্নাংশিক পরিমাণে হলেও স্খালন করেছে। তেমনি তাঁর বিবেক দংশন ও দ্বন্দ্ব সংশয় তাঁর পাষণ্ড প্রবৃত্তির নিরেট অন্ধকারের মধ্যে ঈষৎ আলোকের রেখাঙ্কন করেছে। এই দুটি দিক থাকবার জন্যই একটি মানসিক আবরণ এতে আপতিত হয়ে রচনাটিকে সাহিত্যিক সৌন্দর্যে ভূষিত করেছে। তাই সবদিক দিয়ে বিচার করে বলা যায়, আলোচ্য প্রহসনটির কাহিনি বিন্যাসে, পটভূমিকা নির্মাণে ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে নাট্যকার বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।