মানবিক নির্মিতির প্রধান উপজীব্য সময়—“আদাব” গল্পে সময়ের বিচিত্র চলচ্ছবি তুলে ধরো।

সন্দেহ নেই, রাজনৈতিক স্বাধীনতার অছিলায় বাংলা ভূখণ্ড বিভাজনের ফলে হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গায় পায়ের তলার মাটি হঠাৎ সরে গেল তখন সবাই একে অপরকে আড়চোখে দ্যাখে আর 'মানুষের রক্ত চায় মানুষের ভাই'। ধ্বংস আর ধসের সামনে, যখন নেতাদের স্বার্থপরতায় সাম্প্রদায়িক বাটখারায় খসে যায় সম্প্রীতির পলেস্তারা—তখন রক্তাক্ত সময়ের অন্ধকার উৎসে মনুষ্যত্বের পুনরুত্থানের আলো আনেন সাহিত্যিক। সমরেশ বসুর ১৯৪৬-এর “আদাব” আলোয় আলোকিত।


“What a poet starts from his time”—সময়ের দাবি সাহিত্যিককে মানতেই হল, Eliot-এর এই দাবি পুরোমাত্রায় মেনেছেন লেখক। ১৯৪৬-এর দাঙ্গা যেমন “১৯৪৬-৪৭ জীবনানন্দের কবিতায়, কিংবা “জল দাও” বিষ্ণু দে-র কাব্যে, কিংবা সুনীলবাবুর “অর্জুন” এ, তেমনি তার সূচনা এই “আদাব”-এ। হিন্দু মুসলমান চিরকাল পাশাপাশি থেকেছে, হিন্দু নায়েবের টাকায় মুসলমান মাঝি মাসের খোরাক চালিয়েছে। আজও সেই রক্তবীজ ভর করেছে তাদের মাথায়—“blood and iron” নীতি নিয়েছে তাই-ভাই বাস করা দুই জাতি। আশ্চর্য দক্ষতায় সেই “শতাব্দীর রাক্ষসী” বেলা চিত্রিত হয়েছে “আদাব”-এ।


“শহরে ১৪৪ ধারা আর কারফিউ অর্ডার জারি হয়েছে। দাঙ্গা বেঁধেছে হিন্দু আর মুসলমানে। মুখোমুখি লড়াই দা, শড়কি, ছুরি, লাঠি নিয়ে। তাছাড়া চতুর্দিক ছড়িয়ে পড়েছে গুপ্তঘাতকের দল—চোরাগোপ্তা আঘাত হেনেছে অন্ধকারকে আশ্রয় করে। লুঠেরারা বেরিয়েছে। তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সৈনবাহী গাড়ি।” শেলির “Mask of Anarchy" বা “অরাজকতার মুখোশ” কবিতার “Hood of blood” যেন। সংশয়কে কাহিনি করে এবার দেখানো হয়েছে অনায়াস দক্ষতা, দুজনে দুজনকে সন্দেহ করে–সুতা মজুর আর মাঝি। মাঝির “সোহান আল্লা” ধ্বনি তার “জাত” চিনিয়ে দেয় তার পুঁটলির জামা-শাড়ি অস্ত্রের চেহারা নেয় সুতামজুরের চোখে। সাম্প্রদায়িকতার অবিশ্বাস কুসুমিত হয়েছে এদের মনে।


মধ্যযুগীয় এই ভয়ার্থ আবর্তে সেই নামহীন হিন্দু ও মুসলমান এরপর কাছে আসে, পরস্পরকে রক্ষা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে “মানবিক” সম্পদে উজ্জ্বল দুটি মানুষ। তারা নামহীন—কেননা ‘জাতি’-তে তাদের পরিচয় নয়, তারা মানুষ। মানবিক নির্মিতিতে সেই রক্তাক্ত সময়ে শুভ সম্প্রীতির সূচনা হয় এভাবেই। একদিকে ছিন্নমস্তা রাজনীতিতে অনাস্থা—বলা উচিত তীব্র ঘৃণা—“নেতারা হোই সাততলার উপুর পায়ের উপর পা দিয়ে হুকুম জারি কইরা বইঠা রইল, আর হালার মরতে মললাম আমরাই।" তাদের এই দাঙ্গায় লাভ কী? দীর্ঘশ্বাস পড়ে দুজনের—“এমনভাবে মানুষ নির্মম নিষ্ঠুর হয়ে উঠে কীভাবে? কী অভিশপ্ত জাত ?” তারপর হৃদয়ের কাছ আসে দুটি প্রাণ। দাঙ্গা মরে, বাঁচে মানুষ। মুসলমান মাঝি ‘কুত্তাদের হাত থেকে বাঁচাতে হিন্দুকে পথ দেখায়, তারপর “মুসলমানের পাড়া” ইসলামপুরের ফাঁড়ি থেকে ফিরে যেতে বলে হিন্দু সুতামজুরকে। সে কিন্তু যাবেই বাদামতলির ঘাট পেরিয়ে ঘরে—কাল যে ঈদ। অপূর্ব মানবিকতার প্রকাশ এখানে।


“যদি তোমায় ধইরা ফেলায়। ভয়ে আর অনুকম্পায় তার গলা ভরে ওঠে।

—পারব না ধরতে ডরাইয়ো না। এইখানে থাইকো য্যান উইঠো না। 

...যাই, ভুলুম না ভাই এই রাত্রের কথা। নসিবে থাকলে আবার তোমার সাথে মোলাকাত হইব। আদাব।

—আমিও ভুলুম না ভাই।—আদাব।”


দাঙ্গাপীড়িত সেই পটভূমিকায় দুটি মানুষ। রক্তাক্ত সেই সময়ে একমাত্র সৃজনের আপোসহীন অঙ্গীকার, মানব সম্পদের জয়যাত্রাই, উপমহাদেশের ওই রৌরবপর্বকে কশাঘাত করে। তাই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কাটিয়ে সেই সময়ে মানুষ জয়ী হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'অর্জুন' উপন্যাসের অর্জুন বলে—“এই দুর্বার ওরা আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কিছুতেই পারবে না। কোনও দিন পারবে না। আমি বেঁচে থাকব। দাঙ্গায় ‘মাঝি' মরে, বেঁচে থাকে “মানুষ”।