সতীনাথ ভাদুড়ীর চরণদাস এম. এল. এ. গল্পে সাম্প্রতিককালের যে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের নিন্দনীয় স্বরূপ উদঘাটিত হয়েছে তা আলোচনা করো।

নীতির রাজা হল রাজনীতি, কিন্তু সেই রাজনীতি পরিচালকদের অন্ধ স্বার্থপরতায় তা যে ভিখারি নীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং হচ্ছে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আলোচ্য গল্পটি। এখানে যিনি নায়ক জনসাধারণের ভোটাভুটিতে ভাগ্যবলে এম, এল, এ, পদে অভিষিক্ত হয়েছে। এই পদে অভিষিক্ত হওয়ার প্রাক পর্বে এবং পরবর্তী পর্বে চরণদাসের জীবনে যে আমূল পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে এবং তা যে রাজনীতির আনুকূল্যে তা সুন্দরভাবে বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। এই চরণদাস সম্পর্কে স্রষ্টার কৌতুকপূর্ণ অভিমত “মা বাপের কাছ থেকে পাওয়া নাম চরণদাস। এক সময় লোকে ভালোবেসে ডাকত চরণদাসজী বলে। পরিস্থিতি বদলেছে। আজকাল সরকারি দপ্তরে তাঁর নাম শ্রীচরণ দাস, এম, এল, এ। সাধারণ লোকের মধ্যে যারা নিজেদের ইংরাজি জানা ভাবে, তারা আজকাল ডাকে ইথেমিয়েলিয়ে সাহাব বলে, আর যাদের ইংরেজি জানবার কোনোরকম দাবি নাই তারা ডাকে মায়লেজী বলে।”


এই চরণদাসজী ওরফে মায়লেজী বছর চারেক পর এসেছেন তাঁর পুরানো পার্টি অফিসে। অর্থাৎ গ্রামে। এই গ্রামেই পূর্বে তার বাড়ি ছিল। রাজনীতির দাক্ষিণ্যে এবং চোরা পথে প্রচুর অর্থাগমে গ্রামের গেঁয়ো স্বভাব পরিবর্তন করে শহুরে আদব কায়দা রপ্ত করতে পাকাপাকি ভবে শহরে এসে আস্তানা গাড়ে এবং অল্পদিনেই শহরের আর পাঁচটা ধনী ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়। পয়সার জোরে অল্পেই শহুরে আভিজাত্য রপ্ত হয়ে যায়, ছেলেমেয়েরা দামি দামি স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়, ফ্ল্যাট বাড়ির বাসিন্দা হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। বছর চারেক পর হঠাৎ শহর ত্যাগ করে চরণদাসের পদচিহ্ন পড়ে তার জন্মভূমি অঞ্চলে। অবশ্য হেতুও আছ। আর কয়েক মাস বাদে ইলেকশান। যাদের ভোটে জয়ী হয়ে তার ভাগ্য ফিরেছে আবার তারা না সমর্থন জানালে ভাগ্যের চাকাটাও উলটে যাবে। কাজেই এই সময় যদি পদমর্যাদার কথা ভুলে যদি সাধারণের মাঝে নিজেকে মিশিয়ে দেওয়া যায় এবং সমর্থন আদায় করতে পারে তাহলে আগামী চার বছর আর তাকে কোনো দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে না। অর্থাৎ আর যে ক-টা দিন বাকি আছে ইলেকশান হতে এই ক-টা দিন কাজে লাগাতে চরণদাসের আগমন ঘটে এমনভাবে।


কিন্তু চরণদাস যে সংকল্প নিয়ে গ্রামে এসেছে তা বুঝি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কারণ, চার বছর আগে, এখানকার মানুষজন তাকে নিয়ে কত আদর কদর সম্মান প্রদর্শন করতো, কর্মসূত্রে যেই তাকে শহরে যেতে হয়েছে তথায় গ্রামে খেটেখেকো মানুষগুলো তাকে ভুলতে বসেছে। বড়ো আশ্চর্যের বিষয় আগে যারা দেখা হলেই তাকে ছাড়তে চাইতো না, কথা হাসি আর গল্পের ফোয়ারা ছোটাত, আজ তারা কেবল কাজে চলে যাচ্ছে। সত্য অভাবনীচ্ছ। অবশ্য চরণদাসও স্বীকার করেছে। এ বিষয়ে তারও ত্রুটি আছে। বিগত ইলেকশানে সে গ্রামের মানুষদের বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু ইলেকশানে জেতার পর সে প্রতিশ্রুতি সে রাখতে পারেনি। হতে পারে, এখন তো প্রত্যেক রাজনীতিবিদ ভোটের আগে কল্পতরু হয়ে যায়, আর ভোটে জেতার পর সব ভুলে যায়। কিন্তু চরণদাস একটা বিষয়ে বিশেষ অবাক হয়ে যায়, গ্রামের এই সকল মুখ্য মানুষরা সহজতা সরলতা হরিয়ে তারা এত বুঝতে শিখল করে থেকে? তারা যে চারণদাসের কাছ থেকে প্রবঞ্চিত হয়েছে এমন আচার আচরণে জানানোর কৌশল রপ্ত করলো কেমন করে ?


কিন্তু এমন এক সংকটময় পরিস্থিতিতে মাথা গরম করলে চলবে না। এম, এল, এ, হয়ে হয়তো চরণদাসের পক্ষে এই সকল গ্রাম্য মানুষের আচার আচরণ সহনীয় নয়, তথাপি কয়েকদিনের জন্য এ সবই মনে ঠাঁই না দিয়ে যাতে উদ্দেশ্য সফল হয় সেদিকেই লক্ষ্য রাখাই শ্রেয়। চরণদাস সহাস্যে সবার সঙ্গে থেকে আলাপ জমাতে থাকে, গ্রামের মানুষও বুঝে নিয়েছে চরণদাসের কেন আগমন এবং কেন এত মিষ্টি ব্যবহার। তবে তারা যে আর চরণদাসের মিথ্যে স্তোকবাক্যে ভুলছেন এটা ভেবেই নিয়েছে। কিন্তু চরণদাসও ছাড়বার পাত্র নয়, সে যত বড়ো পদমর্যাদাধারী লোক হোক না কেন। ভোট আদায় করতে তাকে ছোটো হতেই হবে। তাই মুখে হাসি নিয়ে আবার গ্রামের মানুষ সেজে সবার দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকে।


চরণদাসের কর্মপথে বাধা হয়ে দাঁড়ার এক মৌলবি সাহেব। যিনি জনগণনার কর্মী হয়ে সরকারি নির্দেশে গ্রামে আসে জনগণনা করতে। অমোঘ নিয়মে হয়ে যায় চরণদাসের মুখোমুখি। নিয়মানুযায়ী যত বড়ো পদমর্যাদাধারী লোক হোক না কেন এই শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর নিকট সঠিক পরিচয় দাখিল করতে সে বাধ্য, চরণদাস এতে নারাজ, মৌলবি সাহেব নাছোড়বান্দা। উভয়ের হাতাহাতি হবার উপক্রম। শেষে এম, এল, এ-র ক্ষমতা বলে চরণদাস মৌলবি সাহেবকে বরখাস্তের হুমকি দিলে মৌলবি সাহেবও পাল্টা হুমকি জারি করে। সাময়িকের জন্য গ্রামের মানুষের মধ্যস্থতায় বিষয়টা মিটমাট হয়ে গেলেও চরণদাস হঠাৎ বুঝতে পারে এখন কারো সঙ্গে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখা উচিত হবে না, কারণ, এমনটি চলতে থাকলে সংখ্যা লঘু বহু ভোট কাটা যাবে। তাই দ্বন্দ্ব মেটাতে পরদিনই চরণদাসের চরণ পড়ে মৌলবি সাহেবের আঙিনায়।


বাস্তববাদী গল্পকার এমনি ভাবেই বর্তমান রাজনীতি ও রাজনীতিকদের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে বোঝাতে সমর্থ হয়েছেন, রাজনীতির মতো কদর্য স্থান বুঝি আর নেই। এটি হল স্বার্থপরতার অন্ধ ঘাঁটি।