বাংলা নাট্যাভিনয়ের ক্ষেত্রে নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিল উপস্থাপনার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করো। প্রসঙ্গত বিলটির বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য কী ছিল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

বাংলা নাটক ও নাট্যাভিনয়ের কণ্ঠরোধ করবার জন্য ব্রিটিশ সরকার এদেশে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বা Dramatic performances control Act (1876) চালু করে। তদানীন্তন বড়োলাট লর্ড নর্থব্রুকের আমলে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর এই আইনটি বিধিবদ্ধ হয়। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক এই আইন প্রণয়নের ইতিহাস উল্লেখযোগ্য। ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে নবজাগ্রত বাঙালি মানসে নানান চিন্তা-ভাবনার উন্মেষ তার কর্মে, আচরণে ও কথায় প্রকাশ পেতে থাকে। এই ভাবনার নবজাগৃতিতেই স্বাদেশিকতার প্রেরণা এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন বাঙালিকে ধীরে ধীরে উদ্দীপ্ত করে তোলে। সভাসমিতি করা, বক্তৃতা ও আলোচনা, অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এবং কাব্যে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে এই উদ্দীপনার প্রকাশ ঘটে। ১৮৭২ -র দুটি ঘটনা খুব উল্লেখযোগ্য। একদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকা প্রকাশ ; অন্যদিকে জাতীয় রঙ্গালয় বা ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা। বঙ্গদর্শনে তৎকালীন বঙ্গ মনীষীর মানসিক চিন্তার দাবি ও রঙ্গালয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানসিকতার উল্লাস লক্ষিত হয়। দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ' নাটক দিয়েই জতীয় রঙ্গালয়ের উদ্বোধন ঘটে, এবং এই নাটকের অভিনয় থেকেই ব্রিটিশ সরকার ভীত হতে শুরু করেছিল।


আইন প্রণয়নের কারণ : 

১। ভারতীয়দের মনে ক্রমেই ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠতে দেখে ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হচ্ছিল। তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ কিংবা শোষণের চক্রাত্তে কোনোরকম আগাত আসুক ব্রিটিশ তা চায়নি। নাটকের মাধ্যমে এই কাজ হচ্ছে দেখে তারা আরও বেশি চিন্তিত হয়। কেননা তারা জানে হবহাউসের (ব্রিটিশ আদালত) বিলের মধ্যেই রয়েছে, সর্বদেশের সর্বকালের নাটক ও মঞ্চের প্রভাবের কথা। বাংলা নাটক ও মঞ্জু সেই পথেই এগিয়ে চলেছে। তাই গোড়াতেই তাকে স্তব্ধ করে দিতে হবে, যাতে আর কিছুতেই বাংলা মঞ্জু ও নাটক ব্রিটিশ বিরোধী ভূমিকা পালন করতে না পারে। এটাই ছিল 'অভিনয় নিয়ন্ত্রণ' বিলের মুখ্য উদ্দেশ্য।


২। একদল নীতিবাগীশ ব্যক্তির আক্রোশ ছিল রঙ্গালয়ের ওপর। ১৮৭৩ সালে নাট্যাভিনয়ে স্ত্রীচরিত্রের জন্য অভিনেত্রীর আমদানি ঘটেছে মঞে। তারা ভদ্র শিক্ষিত ঘরের মেয়ে ছিল না, সবাই ছিল ‘বারাঙ্গনা'। তখনকার সামাজিক প্রেক্ষিতে অভিনয়ের জন্য ঘরের মেয়েদের পাওয়া সম্ভব ছিল না। রঙ্গমঞে এই বারাঙ্গনাদের আগমনে নীতিবাগীশ শ্রেণি ‘গেল’, ‘গেল' রব তুলেছিল। এই নীতিবাগীশরাই শাসকশ্রেণির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল।


৩। নীতিবাগীশের ইচ্ছার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তৎকালীন অভিজাত বাঙালি সম্প্রদায়ের নাটক শাসনের প্রয়াস। কারণ, অনেক ধনী বাঙালির এবং বড়ো ঘরের কেচ্ছাই প্রায়ই প্রহসন বা রঙ্গনাট্যের বা নকশার মাধ্যমে প্রকট করা হত। তার উতোর চাপানও চলত পরস্পর পক্ষের পয়সার মদতে। ড. জয়ন্ত গোস্বামীর প্রহসনের ইতিহাস গ্রন্থে এই ধরনের পাঁচ শতাধিক প্রহসনের পরিচয় আছে। প্রহসনগুলির অভিনয়ে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ভারে যাতে পর্যুদস্ত হতে না হয়, সেই উদ্দেশ্যে অনেক বাঙালি সস্তানই নাট্যজগৎ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে শাসকের হাত শক্ত করেছিলেন।


এই তিন প্রচেষ্টার যোগফল অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন। তবে উপলক্ষ্য হিসাবে দেখা দিল ‘গজদানন্দ ও যুব্রাজ’ প্রহসনের অভিনয়। যার পশ্চাৎপটে ছিল মহারানি ভিক্টোরিয়ার ছেলের কীর্তি। এই ঘটনা আইন প্রচলনকে ত্বরান্বিত করে তোলে। ১৮৭৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর কলকাতায় এলেন মহারানির পুত্র-‘প্রিন্স অফ ওয়েলস'। ইনি পরে সপ্তম এডওয়ার্ড হন। রানির ছেলের নানান খেয়ালের মধ্যে একটি হল, বাঙালি অভিজাত ঘরের অন্দরমহলের জেনানাদের দেখার ইচ্ছা। তৎকালীন বাঙালি ভদ্রঘরের পক্ষে এটি মারাত্মক প্রস্তাব। কেউ রাজি হলেন না। কিন্তু মহারানীর পুত্রের ইচ্ছা পূরণে এগিয়ে এলেন ভবানীপুর নিবাসী হাইকোর্টের উকিল এবং ব্যবস্থাপক সভার সদস্য জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়। তাঁর পুরনারীরা যুবরাজকে উলু দিয়ে বরণ করলেন। এই ঘটনায় কলকাতায় তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হল। সংবাদপত্রে লেখালেখি হল প্রচুর। এই ঘটনাকে নিয়েই নাটক লিখলেন উপেন্দ্রনাথ দাস— ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ'। এবং নাটক প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নাট্যকার পড়ে গেলেন রাজরোষে। প্রণয়ন হল নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিল।


আইনের বিধিনিষেধ : প্রথমে এই বিল পাশ হয় কলকাতায়, পরে সমগ্র ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সকল ক্ষেত্রেই আইন কার্যকরী হয়। এই আইনের বলে শাস্তিযোগ্য হবে সব পাবলিক থিয়েটার বা সাধারণ রঙ্গালয়। তার সঙ্গে যে কোনোভাবে যুক্ত অভিনেতা-অভিনেত্রী, নির্দেশক, মঞ্চাধ্যক্ষ, থিয়েটারের মালিক এবং নাট্যাভিনয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে-কোনো ব্যক্তি। তাদের কৈফিয়ৎ তলব করা হবে ; বিধিলঙ্ঘন প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার, জরিমানা, জেল প্রভৃতির ব্যবস্থা রাখা হোক আইনে। বিধিবহির্ভূত নাটকের অভিনয় হলে পুলিশ সেখানে ঢুকে গ্রেপ্তার এবং সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে বলপূর্বক। আইনের একটি মারাত্মক দিক হল, শাস্তিযোগ্য নাটকের অভিনয়ের সময়কালীন উপস্থিত দর্শকেরাও শাস্তিযোগ্য বিবেচিত হবে। ভয়ে এইরকম নাটক দর্শক দেখতে আসবে না এবং বাণিজ্যিক থিয়েটার দর্শক অভাবে বন্ধ হবে। এমন বিদঘুটে আইন আর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যায় না।


১৯৬৯ খ্রিঃ স্বাধীন ভারতের ‘পুলিশ দপ্তর'-এ প্রকাশিত তথ্য থেকে জান যায়—এই আইন প্রণয়নের ফলে মোট ১১৩৬টি নাটক পুলিশ দপ্তরে জমা পড়ে। তার মধ্যে তুলসীদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'রত্নাবলী' নাটক সবচেয়ে পুরোনো। রবীন্দ্রনাথের মোট ১৪টি ('বিসর্জন' সমেত) নাটকও জমা পড়ে। পুলিশ এইসব নাটক বিচার করে আইনানুগ ছাড়পত্র দিত। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ব্রিটিশের এই আইন বলবৎ রইল। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে ওই আইনটিকে বলা হয় “সংবিধান বহির্ভূত ও লজ্জাকর”। তা সত্ত্বেও ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওই আইনটিকে খানিকটা পালটে এবং নতুন কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে পুনরায় চালু করার চেষ্টা করে। নাম দেওয়া হল “ওয়েষ্ট বেঙ্গল ড্রামাটিক পারফরম্যান্সেস বিল” (১৯৬২)।


যাইহোক, ইংরাজ শাসক কর্তৃক নাট্যনিয়ন্ত্রণ বিল প্রণয়নের ফলে ক্রমেই রঙ্গমঞ্চ ও বাংলা নাটক যে বিট্রিশ বিরোধী প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেল তাই নয়, তার জায়গায় ইংরাজ প্রশস্তিমূলক নাটক রচিত ও অভিনীত হতে লাগল। ইংরাজ তোষণের এই নকল নাটক খুবই তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎকর। গিরিশের গীতিনাট্য ‘অশ্রুধারা' (১৯০১), রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যু উপলক্ষ্যে লেখা।‘হীরক জুবিলী’ (১৮৯৭) লেখা হয়েছিল মহারানির ষাট বৎসর রাজত্বকাল স্মরণে। ‘শাস্তি’ রূপক নাট্যে সপ্তম এডওয়ার্ডের জয়গান করা হয়েছে। অমৃতলালের ‘বৈজয়ন্ত ধাম’ ভিক্টোরিয়ার উপলক্ষ্যে লেখা। অমরেন্দ্রনাথ দত্তের ‘এস যুবরাজ’ ব্রিটিশ যুবরাজের ভারত আগমন স্মরণে লেখা। জাতীয় নাট্যশালার মাধ্যমে জাতীয়তাবোধের উদ্বোধন ও স্বদেশ প্রেমের উদ্দীপনা পরিণতিতে মহারানি কিংবা যুবরাজের প্রশস্তিতে এসে নেমেছে। ব্রিটিশ রাজভ ঔর চরমপরাকাষ্ঠা এই সময়ে দেখিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার ‘রয়াল' উপাধি লাভ করে। সব মিলিয়ে, জাতীয়তাবোধ এই আইনের ভয়ে পর প্রশস্তিতে সমাপ্তি ঘোষণা করল। জাতীয় জীবনে এর চেয়ে ট্র্যাজেডি কী আছে ?


পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই দেখা যায়, জাতীয়মুক্তি আন্দোলনে নাট্যশালার একটি বড়ো ভূমিকা থাকে। পরাধীন বাংলাতেও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসের গোড়ার দিকে দায়িত্ব পালনে অনেকেই এগিয়ে এসেছিল। ইংরাজ সরকার তাদের দেশের ইতিহাস এবং অন্য দেশের ইতিহাস থেকে ভালোভাবেই জানত যে, জাতীয়তাবোধের উন্মেষে, স্বাধীনতার দাবিতে নাট্যশালা কতবড়ো ভূমিকা নিতে পারে। শঙ্কিত ব্রিটিশরাজ শক্তি তাই অতি সত্ত্বর বঙ্গমঞ্চের এই প্রয়াসকে বন্ধ করে দিতে তৎপর হয়েছিল, কৌশলে অশ্লীলতার দোহাই পেড়ে ভেতরে ভেতরে শক্ত হাতে আইন করে সবদিক দিয়ে নাট্যশালার সব প্রয়াসকে বন্ধ করে দিয়েছিল। ব্রিটিশের মতো স্বাধীন দেশের সরকারও এই আইনকে ব্যবহার করে প্রয়োজনে নাটকের ও নাট্যশালার কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে। ব্রিটিশের এই আইন বাংলা মরে ও নাটকের পেছনে অশুভ ছায়ামূর্তির মতো ঘুরে বেড়িয়েছে। শৃঙ্খলিত বাংলা নাটক শৃঙ্খলমুক্ত হতে পারেনি। বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে এই শৃঙ্খলের দাগ মর্মান্তিকভাবে রয়ে গেছে।