চন্ডীদাস নাকি সুখের মধ্যে দুঃখ আর দুঃখের মধ্যে সুখ দেখতে পেয়েছেন। তোমাদের পাঠ্য চন্ডীদাসের পদগুলি অবলম্বনে এরকম ধারণার যৌক্তিকতা বিচার করো।

চন্ডীদাস বলেন, প্রেমে দুঃখ আছে বলেই প্রেম ত্যাগ করার নয়। প্রেমের যা কিছু সুখ সমস্তই দুঃখের মন্ত্রে নিঙড়ে নিয়ে বের করতে হয়। বৈষ্ণবের ধর্ম ভালোবাসার ধর্ম। তাকে চণ্ডীদাস সৌন্দর্যের আদর্শে বেঁধে রেখেছেন। শুধু রাধার দেহের লাবণ্য বর্ণনাই নয়, কৃষ্ণের রূপযৌবন বর্ণনায়ও কবি ভারি চাতুর্য দেখিয়েছেন। কৃষ্ণের রূপলাবণ্যকে দেখে রাধার প্রেমের যে আর্তি, তাকে অপূর্ব কবিত্বপূর্ণ ভাষায় প্রকাশ করেছেন কবি। শ্যামের নাম শুনেও রাধার কাতর-

“সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম 

কানের ভিতর দিয়া   মরমে পশিল গো

আকুল করিল মোর প্রাণ।”


চণ্ডীদাসের কবিতার সম্যক স্ফূর্তি দুঃখ-বিরহের বর্ণনায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বিদ্যাপতি বিরহে কাতর হয়ে পড়েন, চণ্ডীদাসের মিলনেও সুখ নেই। চণ্ডীদাস জগতের মধ্যে প্রেমকে রমণীরূপে দেখেছেন। বিদ্যাপতি ভোগের কবি, চণ্ডীদাস সহ্য করবার কবি। চণ্ডীদাস সুখের মধ্যে দুঃখ এবং দুঃখের মধ্যে সুখ দেখতে পান, চণ্ডীদাসের প্রেম “কিছু কিছু সুধা বিষগুণ আধা” তাঁর কাছে শ্যাম যে মুরলী বাজান, তাও বিষামৃতে একত্র করে। তাই তো তাঁদের মিলনে—

দুষ্টু ক্রোড়ে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।”


রবীন্দ্রনাথ চণ্ডীদাসকে বলেছেন—“দুঃখের কবি, ভাবের কবি।” আক্ষেপানুরাগ পর্যায়ের পদাবলীতে কবি সর্বাধিক নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন, বিপ্রলম্ভ রসের বেদনা মাধুরীর স্পর্শে।


আক্ষেপানুরাগের প্রতিটি পদের মধ্যে দুঃখব্রতী আত্মনিবেদিত প্রেমের গভীরতম ব্যঞ্জনা বর্তমান। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. শঙ্করীপ্রসাদ বসুর উক্তিটি তাৎপর্যপূর্ণ—“আক্ষেপানুরাগের অশ্রুর অগ্নিকে শেষবারের মতো জ্বালাইয়া নিজেকে জাগাইয়া অবশেষে নিষ্ঠুরের পদপ্রান্তে লুটাইয়া পড়িবেন। তাহার নাম আত্মনিবেদন।” সেইখানেই রাধাকে বলতে হয়—

“বঁধু কি আর বলিব আমি 

জীবনে মরনে জনমে জনমে

প্রাণনাথ হৈও তুমি।”


ক্ষণকালের মিলনের পর যে বিচ্ছেদ; তাকে বলে আক্ষেপানুরাগ। এই পদের মধ্যে রাধার অন্তর্দাহের আর্তি অত্যন্ত সংযত সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। যেমন—

“কে বলে পিরীতি ভাল।

হাসিতে হাসিতে  পিরীত করিয়া

কাঁদিতে জনম গেল।”


রাধার প্রেমানুরাগের ব্যাকুলতার মধ্যে দুঃখের গভীরতা দিয়ে কবি রাধার প্রেমের গভীরতার পরিমাপ করেছেন। নিজের হৃদয়কে—

“যত নিবারিয়ে চায় নিবার না যায় রে।

আন পথে যাই সে কানু পথে ধায় রে।।”


চণ্ডীদাস প্রেমের কবি সত্য, কিন্তু তাঁর প্রেমের চতুর্দিকে ঘিরে রয়েছে দুঃখের অশ্রু। কবির কথায় “পিরীতিরসের রসিক নাহলে কি ছবি জীবনে তার” আবার বলেছেন “পরাণে ছাড়িলে পিরীতি নাছাড়ে পিরীতি গরল কে?” চণ্ডীদাসের এই ‘পিরীতি' শব্দটির কমনীয়তা এবং মাধুর্য প্রয়োজনে পুণ্যের চাতুর্যে আরও মনোরম হয়ে উঠেছে। কবি বহুস্থলে পিরীতিকে আস্বাদন করতে গিয়ে বিষাদের হাহাকারে তাকে মিলিয়ে দিয়েছেন—

“মধুর বলিয়া যতনে খাইনু তিতায় তিতিল দে।”


প্রেমের মাদকতায় রাধা বিহ্বল হয়ে পড়ে কৃষ্ণের বিমুখতা দেখে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন—

“কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান।

অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন।।"


এই প্রেমের আর্তি বহু কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে। পঞ্চন্দ্রিয় রুদ্ধ করেও রাধা শ্যামের অনুভব থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না। কালো কিছু দেখলেই বা শুনলেই কৃষ্ণের কথা মনে পড়ে। এই প্রাপ্তিতেও তাঁর ঘুম নেই—

“এই ভয় উঠে মনে এই ভয় উঠে।

না জানি কানুর প্রেম তিলে যেন টুটে।।”


চণ্ডীদাসের এই প্রেম নরনারীর হৃদয়ানুভূতিকে আশ্রয় করে রাধাকৃষ্মের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে সত্য। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত মানবের জয়গানে পর্যবসিত হয়েছে—

“শুনহ মানুষ ভাই

সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।”


অতএব বিরহের জন্য চণ্ডীদাস অধিক পদরচনা করেননি। কারণ পূর্বরাগ থেকেই তো তার বিরহের শুরু। বিদগ্ধ সমালোচকের ভাষায়—“পূর্বরাগ হইতে চণ্ডীদাসর বিরহ শুরু হইয়াছে, আক্ষেপানুরাগে তাহার বৃদ্ধি, পর্যায়ের পর পর্যায়ে অগ্রসর হইয়া চণ্ডীদাস ভাবসম্মিলনের আনন্দমুহূর্তেও বিচ্ছেদের অন্তিমতম বেদনাকে প্রকাশ করিয়া দিলেন—

“বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে।

দেখা না হইত পরাণ গেলে।।

দুখিনীর দিন দুখেতে গেল।

মথুরা নগরে ছিলে তো ভালো।


করুণ, মর্মস্পর্শী, কোনও বিশেষণেই এই অনুভূতিকে আর অন্যভাবে প্রকাশ করা যায় না। চণ্ডীদাসের মতো এত সুন্দরভাবেও হৃদয়ের মর্মস্পর্শী বাণী অন্য কোনও বৈষ্ণব ব্যক্ত করতে পারেননি।