রস কাকে বলে? কাব্যের জগৎ অলৌকিক মায়ার জগৎ কেন? কাব্য নির্মাণ কৌশলের তিনটি ভাগ কী কী? সে সম্পর্কে আলোচনা করো।

ধ্বনিবাদীদের মতে কাব্য হচ্ছে সেই বাক্য, রস যার আত্মা। কোহয়ং রসঃ– এই ‘রস’ জিনিসটি আবার কী। এ বিষয়ে আলোচনা সুরু করবার আগে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে কাব্যের তত্ত্ববিচার কাব্যের কঙ্কাল নিয়ে নাড়াচাড়া। রসতত্ত্ব রস নয়, তত্ত্বমাত্র। কাব্যের রস বিচারে মানুষকে কাব্যরসের আস্বাদ দেয় না। সে আস্বাদ দরদী লোকের মন দিয়ে অনুভূতির জিনিস । আলংকারিকদের ভাষায় সে রস হচ্ছে ‘সহৃদয় হৃদয়সংবাদী' এবং কাব্যরসাম্বাদী সহৃদয় লোকের মনের বাইরে রসের আর কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ “ওই আস্বাদই হচ্ছে রস। যদিও আমরা বলি ‘রসের আস্বাদ'। রস ও স্বাদের মধ্যে একটা কাল্পনিক ভেদ স্বীকার করেই ওরকম বলা হয়। যেমন আমরা কথায় বলি ‘ভাত পাক হচ্ছে’ যদিও পাকের যা ফল তাই ভাত। তেমনি যদিও কথায় বলি 'রসের প্রতীতি বা 'অনুভূতি', কিন্তু ওই প্রতীতি বা অনুভূতিই হচ্ছে রস। সুতরাং বলা যেতে পারে, কাব্যরসের আধার কাব্যও নয়, কবিও নয়, সহৃদয় পাঠকের মন।


রস যখন এক রকমের মানসিক অবস্থা, তখন তার পরিচয় দিতে হলে প্রথমেই বলতে হবে কী করে মনে এ অবস্থায় উদয় হয়। মানুষের কী করে জ্ঞানের উৎপত্তি হয় একথা বোঝাতে গিয়ে দার্শনিক কাণ্ট দেখিয়েছেন যে তাতে দুরকমের অবদান আছে—মানসিক ও বাহিক্য। বাহ্যিক উপাদান ইন্দ্রিয়ের পথে মনে প্রবেশ করে, তারপর মনের কতকগুলি তত্ত্ব ওই বাহ্যিক উপাদানের ওপর ক্রিয়া করে তাকে এক বিশেষ পরিণতি ও আকার দান করে। এইভাবে বাহ্যিক উপাদান ও মানসিক তত্ত্ব এ দুয়ের সংযোগ হলে তবেই জ্ঞানের উৎপত্তি হয়।


জ্ঞানের মতোই রসের বিশ্লেষণেও দুরকমের উপাদান পাওয়া যায়। এই উপাদান দুটি মানসিক ও বাহ্যিক। রসের মানসিক উপাদান হল মনের ‘ভাব' নামক চিত্তবৃত্তি বা ‘ইমোশন' গুলি। আর রসের বাহ্যিক উপাদান হল কবির সৃষ্টি কাব্য। আলংকারিকদের মতে কাব্যজগতে ওই বাহিক্য উপাদানের ক্রিয়ায় মনের ভাব রূপান্তরিত হয়ে রসে পরিণত হয়। সুতরাং আলংকারিকদের মতে রস জিনিসটি লৌকিক বস্তু নয়। মনের যেসব ‘ভাব’ রূপান্তরিত হয় তারা অবশ্য লৌকিক। কিন্তু ভাব বা ইমোশন রস নয় এবং মানুষের মনে যেসব বস্তু বা ঘটনা এই 'ভাব'কে জাগিয়ে তোলে তাও কাব্য নয়। ‘শোক’ একটি মানসিক ভাব বা ইমেশান। লৌকিক জগতের বাহ্যিক কারণে, যেমন কোনো প্রিয়জনের মৃত্যুতে, মনে শোক জেগে মানুষ শোকার্ত হয়। কিন্তু শোকার্ত লোকের মনের ‘শোক তার কাছে রস’ নয় এবং সে শোকের কারণটিও কাব্য নয়। কবি যখন তাঁর প্রতিভাবলে এই লৌকিক শোক ও তার কারণের এক অলৌকিক চিত্র কাব্যে ফুটিয়ে তোলেন, তথাপি পাঠকের মনে রসের উদয় হয়। এই রসের নাম করুণরস। এই করুণ রস শোকের ‘ইমোশন' নয়। শোক ও তার কারণের এক অলৌকিক চিত্র কাব্যে ফুটিয়ে তোলেন, তখনি পাঠকের মনে রসের উদয় হয়। এই রসের নাম করুণরস। এই করুণ রস শোকের ‘ইমেশান’ নয়। শোক আমাদের মনকে দুঃখ দেয় কিন্তু কবির কাম্য মনে যে করুণরসের সঞ্চার করে, তা চোখে জল আনলেও মনকে পূর্ণ করে এক অপূর্ব আনন্দে। করুণরস যদি দুঃখেরই কারণ হত তবে নারায়ণ প্রভৃতি করুণরসের কাব্যের দিকেও কেউ যেত না। কিন্তু করুণরসের আনন্দ কাব্যরসিক মানুষকে নিয়তই সেদিকে টানছে। Our sweetest songs are those that tell of saddest thought—একথা বলেছেন পাশ্চাত্যের কবি। আলংকারিকেরা বলবেন, ঠিক কথা কিন্তু মনে থাকে যেন, tell of saddest thought যে বস্তুর ঘটনা মনে সোজাসুজি sad thought আনে, তা sweet ও নয়, song ও নয়। কবি যখন কাব্যে saddest thoght-এর কথা বলেন, তখনি তা sweetest song হয়।


ভাব ও রসের, বস্তুজগৎ ও কাব্যজগতের এই ভেদকে সুস্পষ্ট প্রকাশের জন্য আলংকারিকরা বলেন, রস ও কাব্যের জগৎ আলৌকিক মায়ার জগৎ। ব্যবহারিক জগতের শোক, হর্ষ প্রভৃতির নানা লৌকিক কারণ মানুষের মনে শোক, হর্ষ প্রভৃতি লৌকিকভাবের জন্ম দেয়। এর কোন্‌টি সুখের কোন্‌টি দুঃখময়। কিন্তু ওই সকল লৌকিক ভাব ও তাদের লৌকিক কারণ, কাব্যের জগতে এক অলৌকিক রূপ প্রাপ্ত হয়ে পাঠকের মনে ওইসব লৌকিকভাবের যে বৃত্তি বা ‘বাসনা' আছে, তাদের এক অলৌকিক বস্তু—‘রস’-এ পরিণত করে, রসের মানসিক উপাদান যে ‘ভাব’ তা দুঃখময় হলেও তার পরিণাম যে ‘রস’ তা সর্বদাই পাঠককে আনন্দদান করে।


কবি যে কাব্য সৃষ্টি করেন তার নির্মাণ কৌশলটি কী তা জানবার আগ্রহ পাঠকের যথেষ্টই আছে। কিন্তু এ প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দেওয়া কখনই সম্ভব নয়। কারণ প্রত্যেক কবির প্রত্যেক কাব্যের নির্মাণকৌশল অন্য সকল কাব্য থেকে অল্পবিস্তর পৃথক। তবুও কাব্যতত্ত্ব কাব্যনিৰ্মাণ কৌশলের যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় মাত্র দিতে পারে। সে পরিচয় কাব্যকৌশলের কঙ্কাল মাত্রের পরিচয়, কারণ দেহের রূপের ভেদ থাকলেও কঙ্কালের রূপ প্রায় একই।

আলংকারিকদের মতে, কাব্যনির্মাণ কৌশলের তিন ভাগ–বিভাব, অনুভাব ও সঞ্চারী বা ব্যভিচারী।


লৌকিক জগতে যা রতি প্রভৃতি ভাবের উদ্বোধক, কাব্যে বা নাটকে তাকেই বিভাব বলে। এই বিভাব আবার আলম্বন ও উদ্দীপন এই দুইভাগে বিভক্ত। যে বস্তু বা ব্যক্তিকে অবলম্বন করে রস সৃষ্টি হয় তাই আলম্বন বিভাব। লৌকিক জগতে যে সীতা ও তার রূপ, গুণ, চেষ্টা রামের মনে রতি, হর্ষ প্রভৃতি ভাবের উদ্‌বোধনের কারণ, তাই যখন কাব্য ও নাট্যে নিবেশিত হয় তখন তাকে আলম্বন বিভাব বলে। আবার নায়ক-নায়িকার রূপ ও অলংকার, দেশ-কালের বিশিষ্ট পরিবেশ, প্রকৃতির সৌন্দর্য প্রভৃতি উদ্দীপন বিভাবের কাজ করে।


মনে ভাব উদ্বুদ্ধ হলে, যে-সব স্বাভাবিক বিচার ও উপায়ে তা বাইরে প্রকাশ হয়, ভাবরূপ কারণের সেইসব লৌকিক কার্য কাব্য ও নাটকের অনুভাব। অর্থাৎ নায়ক-নায়িকার কার্যের মধ্য দিয়ে যখন অন্তরের ভাব প্রকাশিত হয় তখন তাকে বলে অনুভাব।


আচার্য অভিনবগুপ্ত কাব্যরসের সংজ্ঞা দিয়েছেন এইভাবে-রসে হচ্ছে নিজের আনন্দময় সম্বিতের (consciousness) আস্বাদরূপ একটি ব্যাপার। মনের পূর্ণবিশিষ্ট রতি প্রভৃতি ভাবের বাসনা দ্বারা অনুরঞ্জিত হয়েই সন্বিৎ আনন্দময় সৌকুমার প্রাপ্ত হয়। লৌকিক ‘ভাব’-এর কারণ ও কার্য কবির গ্রথিত শব্দে সমর্পিত হয়ে, সকল হৃদয়ে সমবাদী যে মনোরম বিভাব অনুভব রূপ প্রাপ্ত হয়, সেই বিভাব ও অনুভাবই কাব্যপাঠকের অন্তর্নির্বিষ্ট ভাবগুলিকে উদ্বুদ্ধ করে। অভিনবগুপ্ত বিভাব ও অনুভাবকে বলেছেন, ‘সকল হৃদয়ে সমবাদী'। কারণ যে লৌকিক ভাবের তারা রসমূর্তি, সে লৌকিক ভাব ব্যক্তির হৃদয়ে আবদ্ধ, তা সামাজিক নয়। প্রেমিকের মনে যে প্রেমের উদ্‌বোধ, তা রস নয়। কারণ তা প্রেমিকার নিজ হৃদয়ে আবদ্ধ, সূতরাং পরিমিত ; তা লৌকিক সুতরাং প্রেমের রসবোধের অন্তরায়। কবি তাঁর প্রতিভার মায়ায় এই পরিমিত লৌকিক ভাবকে ‘সকলহৃদয়সংবাদী' অলৌকিক রসমূর্তিতে রূপান্তরিত করেন। কাব্যের বিভাব ও অনুভাবের মধ্যে এমন একটি ব্যাপার আছে, যাতে কাব্যচিত্রিত চরিত্র বা ভাব এবং পাঠকের মধ্যে একটি সাধারণ সম্বন্ধের সৃষ্টি হয়, যার ফলে কাব্যপাঠকের মনে হয় কাব্যের চরিত্র ও ভাব পরের কিন্তু সম্পূর্ণ পরের নয়। আমার নিজের কিন্তু সম্পূর্ণ নিজেরও নয়। এইভাবে কবি যখন কাব্যের ভাবকে রসের মূর্তিতে রূপান্তর করেন, তখন তিনি ভাবের লৌকিক পরিমিতত্বকে ছাড়িয়ে ওঠেন। লৌকিক গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ ও অভিভূত থাকলে যেমন কাব্যরসের আস্বাদ হয় না, তেমনি কাব্যরসের সৃষ্টিও হয় না।


বর্তমান যুগ লিরিক কাব্যের যুগ, যখন কবির নিজের মনের ভাবই কাব্যের উপাদান তখন মনে হতে পারে যে, কবির হৃদয়ের ভাবকে পাঠকের হৃদয়ে সঞ্চারিত করাই বুঝি কাব্যের লক্ষ্য। এবং যে কবির ভাব যত তীব্র ও আবেগময় তাঁর কাব্যরচনাও তত সার্থক। কিন্তু ভাব যদি কবির মনে রসের মূর্তি পরিগ্রহ না করে তবে কবি কখনও তাকে সেইরূপ বিভাব ও অনুভাবে প্রকাশ করতে পারেন না, যা পাঠকের মনেও সেই রসের রূপ ফুটিয়ে তোলে। অর্থাৎ পাঠকের মনে ভাব সঞ্চারিত করা নয়, সেইভাবের রসের মূর্তি ফুটিয়ে তোলাই কবির কাজ। মনে যাতে ভাব উদ্বুদ্ধ হয় তাই যদি কাব্য হত তাহলে খবরের কাগজের সংবাদ ও প্রবন্ধ যা এক সম্প্রদায়ের ওপরে অন্য সম্প্রদায়ের ক্রোধ জাগিয়ে তোলে, তাই হত প্রথম শ্রেণির কাব্য। তথাপি ভাবোবেল কবির আবেগময় কাব্য যে কাব্যরস থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত নয় তার কারণ 'ভাব' শব্দে সমর্পিত হলেই ব্যক্তিগত লৌকিকত্বের গণ্ডি থেকে কতকটা মুক্ত হয়। কারণ ভাষা জিনিয়টাই সামাজিক। কিন্তু লিরিক যত ভাব- ঘেঁষা হয় ততই যে শ্রেষ্ঠ হয় না এবং কাব্যে রস ও ভাবের উচ্ছ্বাসের মধ্যে যে প্রভেদ আছে সে কথা মনে রাখা একান্ত প্রয়োজন।


আলংকারিকগণ বিভাব অনুভাব ছাড়াও ব্যভিচারী বা সঞ্চারী ভাব নামক কাব্যনির্মাণ কৌশলের তৃতীয় একটি কলার কথা বলেছেন। মানুষের মনে নয়টি স্থায়ী চিত্তবৃত্তি বা ভাব আছে। এরা হচ্ছে রতি, হাস, শোক, ক্রোধ, উৎসাহ, ভয়, জুগুপ্সা, বিস্ময় ও শম। এই নয়টি ভাব কাব্যের বিভাব অনুভাবের সংস্পর্শে নয়টি রসে পরিণত হয় যথাক্রমে শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত ও শান্ত। কিন্তু এই নয়টি ছাড়াও মানুষের মনে নির্বেদ, হর্ষ, অসুয়া, লজ্জা, বিষাদ প্রভৃতি আরও তেত্রিশটি ভাব আছে। এদেরই আলংকারিকরা বলেছেন সঞ্চারী বা ব্যভিচারী ভাব। তাঁরা বলেন, এইসব ভাব মনে স্বতন্ত্র থাকে না, কোনো-না-কোনো স্থায়ী ভাবের সম্পর্কেই মনে যাতায়াত ক'রে সেই স্থায়ী ভাবের অভিমুখে মনকে চালিত করে। এইজন্য এদের নাম সঞ্চারী বা ব্যভিচারী। কাব্যে সঞ্চারী ভাবের স্বতন্ত্র রসমূর্তি নেই, তারা নয়টি রসকেই নানা রকমে পরিপুষ্টি দান করে মাত্র। অভিনবগুপ্ত বলেছেন, স্থায়ী ভাবের পরিণতিই রস, বাকিগুলিকে বলে সঞ্চারী। রসের মধ্যে আবার স্থায়ী ও সঞ্চারী রস এইভাবে অঙ্গী ও অঙ্গের বিভাগ যুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু কোনো কোনো আলংকারিক সঞ্চারীকেও রস বলেছেন কেবল রসের পুরিপুষ্টি সাধক নয়। কখনও কখনও এমনও হয় যে এক কাব্য প্রবন্ধে নানা রস একত্র থাকলেও কবির কাব্যের উৎকর্ষের জন্য তার মধ্যে একটি রসকেই প্রধান করেন এবং বাকি রসগুলি তার পরিপোষক বা সঞ্চারী। এই সঞ্চারী কাব্যের এতটা স্থান জুড়ে থাকে যে আলংকারিকদের মধ্যে এ মতও প্রচলিত হয়েছিল যে সঞ্চারী দিয়ে পরিপুষ্ট না হলে রসের রসত্বই হয় না।


বিশ্বনাথ কবিরাজ ‘সাহিত্যদর্পণে' যে কারিকায় রসের উৎপত্তির বর্ণনা দিয়েছেন সেটির অনুবাদ উদ্ধৃত করে এখন এই আলোচনা শেষ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন ‘চিত্তের রতি প্রভৃতি স্থায়ীভাব (কাব্যের) বিভাব, অনুভাব ও সঞ্চারীর সংযোগ রূপান্তর প্রাপ্ত হয়ে রস পরিণত হয়।