শোক হচ্ছে দুঃখদায়ক, কিন্তু শোকাদ্ভূত করুণ রসে মনে যে অপূর্ব সুখ জন্মায়—তার কারণ কী | রসের সাধারণীকরণ বলতে কী বোঝ?

রসের সাধারণীকরণ বলতে কী বোঝ?


অভিনবগুপ্ত প্রমুখ আলংকারিকেরা বলেন যে স্থায়ীভাবে সমানভাবে সকলের মনেই আছে—আর আছে বলেই বিভাব এবং অনুভাবও থাকে। দুঃখের ব্যাপারে তাই সকলেই ব্যথিত হন, ভয়ের বস্তু দেখে সবাই অল্পবিস্তর ভীত হন, আশ্চর্য বস্তু দেখে প্রায় বিস্মিত হয়ে থাকেন।


এই বিভাব এবং অনুভাব—এরা লৌকিক এবং প্রত্যক্ষগম্য। এদেরকেই কবি অলৌকিক করে রসমূর্তি দান করেন, অনুভূতিগম্য করে তোলেন। ভয়ের বিভাব ও অনুভাব সম্পর্কে সর্বসাধারণের জ্ঞান আছে। তাই কবি যখন তাঁর অপূর্ব নির্মাণক্ষমতার দ্বারা সেই সাধারণগম্য বিভাব-অনুভাবের সাহায্যে সেই ভয়ের অনির্বচনীয় রসমূর্তি রচনা করেন তখন রসের যথার্থ সাধারণীকরণ ঘটে।


নাটকের ক্ষেত্রে এই সাধারণীকরণ সবচেয়ে বেশি ঘটে। চেনা নাটকে জানি, কিন্তু বিশেষ বেশভূষার জন্যে আবার কিছুটা অচেনাও বোধ হয়। তিনি যে বিভাব এবং অনুভাবের মধ্যে দিয়ে দর্শকদের মনে ভাব গেঁথে দেন—তা কোনো ব্যক্তি বিশেষের নয়, সাধারণ চিত্তবৃত্তির রূপমাত্র—বাস্তব কোনো কারণের সঙ্গে সে ভাব সম্পর্কিত নয়। তখন দর্শকের অন্তরে স্থায়ীভাব উদ্বুদ্ধ হয়, এবং তার মনে আনন্দের সৃষ্টি হয়। রসাস্বাদ একটা মানসিক ব্যাপার মাত্র, জিভ দিয়ে যেমন টক ঝাল কী লোনা স্বাদ বুঝি—রসের আস্বাদ তেমন কোনো ইন্দ্ৰিয়জ ব্যাপার নয়। এইভাবে বিভাব-অনুভাব রসসৃষ্টির কাজে সাহায্য করে। সর্বক্ষেত্রে তা করে বলেই সাধারণীকৃত রূপ একটা আছে বলা চলে।



শোক হচ্ছে দুঃখদায়ক, কিন্তু শোকাদ্ভূত করুণ রসে মনে যে অপূর্ব সুখ জন্মায়—তার কারণ কী?

শোক হল ব্যক্তিগত মনোভাব ; লৌকিক জগতে বাহ্যিক কারণে মনে শোক উপজাত হলে মানুষ শোকার্ত হয়। একের কাছে যা শোকের বস্তু সবসময় সকলের মনে সেই বস্তু সমান শোকের উদ্রেক ঘটায় না; এই লৌকিক শোক যখন মানুষের মনে জাগে- তখন সেই শোক তার কাছে রসমূর্তি লাভ করে না। শোকের কারণও কাব্য বলে গণ্য হয় না। কবি যখন তাঁর প্রতিভার মায়াবলে এই লৌকিক শোক ও তার লৌকিক কারণের এক অলৌকিক চিত্র কাব্যে ফুটিয়ে তোলেন, তখনই পাঠকের মনে রসের উদয় হয়—যার নাম করুণ রস। এই করুণ রস শোকের ভাব নেয়। শোক নিশ্চয়ই দুঃখদায়ক, কিন্তু কবির কাব্যে মনে যে করুণ রসের সঞ্চার হয়, তা চোখে জল আনলেও মনকে অপূর্ব আনন্দে পূর্ণ করে।


করুণরস শোকের লৌকিক মূর্তি ত্যাগ করে কবির মনের মাধুরীর সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে কাব্যে এক অলৌকিক রসে পর্যবসতি হয়। হৃদয়বান কাব্যপাঠক ওই করুণরস সম্বলিত কাব্যপাঠ করে মনে অপূর্ব সুখ অনুভব করেন। লৌকিক শোক তখন অলৌকিক করুণ রস হয়ে দাঁড়ায়। এই জন্যে শোক দুঃখজনক হলেও করুণরস—যার কোনো লৌকিক রূপ নেই ; অলৌকিক মায়ার জগতে যার অস্তিত্ব, সেই করুণ রস মনে অপার আনন্দের উপলব্ধি জাগায়।