কথাসাহিত্য : উপন্যাস ও ছোটগল্পে সমরেশ বসু (১৯২৪ খ্ৰীঃ–১৯৮৮ খ্ৰীঃ)

উপন্যাস ও ছোটগল্পে সমরেশ বসু


‘সমরেশ বসু’ বাংলা উপন্যাস পাঠকের কাছে আজ এক সুপরিচিত নাম। ঢাকার রাজনগরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে তাঁকে বহু বিচিত্র পেশায় যুক্ত হতে হয়—ফেরিওয়ালা, ডিম-বিক্রেতা থেকে শুরু করে জুটমিলের কর্মী পর্যন্ত। সেই বিচিত্র জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। নিছক সংখ্যাধিক্যেই তাঁর উপন্যাস-তালিকা হয়ত বিস্ময় জাগাতে পারে। কিন্তু কেবল রচনার প্রাচুর্যে নয়, অভিজ্ঞতার ব্যাপকতায়, সৃষ্টিক্ষমতার নৈপুণ্যে, সামাজিক তথা রাজনৈতিক বক্তব্যের সুতীব্র উপস্থাপনায় সম্ভবতঃ আধুনিক বাংলা উপন্যাসে তিনি সব চাইতে বিতর্কিত লেখক।


সমরেশ বসুর রচনাসমূহ:

[সমরেশ বসুর স্বনামে ও ছদ্মনামে (কালকূট ও ভ্রমর) লিখিত গ্রন্থের তালিকা। এই তালিকাটি ডঃ নিতাই বসুর ‘কালকূট সমরেশ’ গ্রন্থ উৎসঃ]


(ক) সমরেশ বসুর উপন্যাস সমূহ : 'উত্তর।' (১৯৫১), 'বি. টি. রোডের ধারে’ (১৯৫২), 'নয়নপুরের মাটি' (১৯৫২), 'শ্রীমতী কাফে’ (১৯৫৩), 'গঙ্গা' (১৯৫৭), ‘বাঘিনী’ (১৯৬০), ‘ছিন্নবাধা’ (১৯৬২), ‘দুরন্ত চড়াই’ (১৯৬২), ‘শেষ দরবার’ (১৯৬৩), 'দুই অরণ্য' (১৯৬৪), 'ফেরাই' (১৯৬৪), 'ধূসর আয়না' (১৯৬৪), ‘স্বর্ণপিঞ্জর' (১৯৬৫), 'বিবর' (১৯৬৫), 'তিনভূবনের পারে' (১৯৬৬), ‘জগদ্দল’ (১৯৬৬), 'স্বীকারোক্তি' (১৯৬৭), 'অগ্নিবিন্দু' (১৯৬৭), 'প্রজাপতি' (১৯৬৭), ‘আত্মজ' (১৯৬৭), 'চতুর্ধারা' (১৯৬৮), 'অপরিচিত' (১৯৬৮), ‘পদক্ষেপ' (১৯৬৮), ‘এপার ওপার' (১৯৬৮), ‘বান্দা’ (১৯৬৮), 'অচিনপুর' (১৯৬৯), 'অলিন্দ' (১৯৬৯), 'পাতক' (১৯৬৯), 'ভানুমতীর নবরঙ্গ' (১৯৬৯), 'মিছিমিছি’ (১৯৬৯), ‘সুচঁাদের স্বদেশযাত্রা' (১৯৬৯), 'যাত্রিক' (১৯৭০), 'যার যা ভূমিকা' (১৯৭০), ‘বিষের স্বাদ’ (১৯৭০), 'ছুটির ফাঁদে' (১৯৭০), 'অবচেতন' (১৯৭০), ‘অলকা সংবাদ' (১৯৭০), ‘মুখোমুখি ঘর' (১৯৭১), 'বিশ্বাস' (১৯৭১), 'সওদাগর' (১৯৭১), নতুন সংস্করণ, ‘রক্তিম বসম্ভ' (১৯৭১), 'তরাই' (১৯৭১), 'বন্ধ দুয়ার' (১৯৭১), ‘ছায়া ঢাকা মন' (১৯৭২), “বিকালে ভোরের ফুল' (১৯৭২), একটি অস্পষ্ট স্বর’ (১৯৭২), 'নিঠুর দরদী' (১৯৭২), 'রূপায়ণ' (১৯৭২), 'ওদের বলতে দাও' (১৯৭২), ‘অন্ধকার গভীর গভীরতর’ (১৯৭৩), 'পরম রতন' (১৯৭৩), ‘অশ্লীল’ (১৯৭৩), 'পথিক' (১৯৭৩), ‘স্বর্ণচঞ্চু' (১৯৭৩), 'রামনাম কেবলম' (১৯৭৩), ‘ত্রিধারা’ (১৯৭৩), ‘হৃদয়ের মুখ' (১৯৭৪), 'মানুষ শক্তির উৎস' (১৯৭৪), ‘লগ্নপতি’ (১৯৭৪), ‘প্রাচীর' (১৯৭৪), 'অবশেষে’ (১৯৭৪), ‘আমার আয়নার মুখ' (১৯৭৪), 'প্রাণপ্রতিমা' (১৯৭৫), ‘নাটের গুরু' (১৯৭৫), 'অবরোধ' (১৯৭৮), ‘ঝিলে নগর’ (১৯৭৫), ‘সবুজ বনে আগুন' (১৯৭৫), ‘হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ (১৯৭৫), ‘বিজড়িত' (১৯৭৫), '‘সূর্যতৃষ্ণা’ (১৯৭৬), ‘পরের ঘরে আপন বাসা' (১৯৭৬), ‘সংকট’ (১৯৭৬), 'বারোবিলাসিনী' (১৯৭৬), ‘চৈতি' (১৯৭৭), 'আম মাহাতো’ (১৯৭৭), ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ (১৯৭৭), ‘ম্যাকবেথ রঙ্গমঞ্চ কলকাতা’ (১৯৭৭), 'হারিয়ে পাওয়া' (১৯৭৭), 'গন্তব্য' (১৯৭৮), ‘আঁখির আলোয়’ (১৯৭৮) ‘আনন্দধারা’ (১৯৭৮), 'মরীচিকা' (১৯৭৮), ‘অপদার্থ’ (১৯৭৯), ‘পুতুলের প্রাণ’ (১৯৭৯), 'শেষ অধ্যায়' (১৯৭৯), টানাপোড়েন' (১৯৮০), ‘দু'মুখো সাপ’ (১৯৮০), ‘বিপর্যস্ত’ (১৯৮০), 'জীবন যখন একটাই’ (১৯৮০), ‘অস্বীকার’ (১৯৮১), ‘অন্ধকারে আলোর রেখা’ (১৯৮১), 'ভানুমতী' (নব সংস্করণ) (১৯৮১), ‘যুগ যুগ জিয়ে’ (১৯৮১), 'রাজধানী এক্সপ্রেসে' (১৯৮১), ‘হত্যারহস্য' (১৯৮১), ‘দিগন্ত’ (১ম পর্ব) (১৯৮২), ‘পুনর্যাত্রা’ (১৯৮২), ‘মাতৃতান্ত্রিক’ (১৯৮২), ‘বিজন বিভুঁই’ (১৯৮৩), ‘আকাঙক্ষা’ (১৯৮৩), ‘অভিজ্ঞান' (১৯৮৪), 'শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’ (১৯৮৪), ‘বাথান’ (১৯৮৫), ‘তিন পুরুষ’ (১৯৮৬), ‘দশ দিন পরে’ (১৯৮৬), ‘জবাব’ (১৯৮৬), ‘খণ্ডিতা’ (১৯৮৭), ‘আদি মধ্য অন্ত’ (১৯৮৭), ‘প্রকৃতি’ (১৯৮৭), 'উদ্ধার' (১৯৮৭), 'মোহমায়া' (১৯৮৮)।


(খ) সমরেশ বসুর গল্পগ্রন্থ : ‘মরশুমের একদিন’ (১৯৫৩), 'অকালবৃষ্টি' (১৯৫৩), ষষ্ঠ ঋতু’ (১৯৫৬), ‘মনোমুকুর' (১৯৫৮), ‘উজান’ (১৯৬৬), ‘বনলতা’ (১৯৬৭), ‘পাপপুণ্য' (১৯৬৭), 'শ্রেষ্ঠ গল্প' (১৯৬৭), 'মানুষ' (১৯৭০), 'ছেঁড়া তমসুক’ (১৯৭১), 'চেতনার অন্ধকার' (১৯৭২), ‘ধর্ষিতা’ (১৯৭২), কামনা বাসনা' (১৯৭২), 'হ্রেষাধ্বনি' (১৯৭৩), 'বিদ্যুল্লতা’ (১৯৭৩), 'রজকিনী প্রেম' (১৯৭৪), ‘বিপরীত র।' (১৯৭৫), 'নাচঘর' (১৯৭৬), 'কীর্তিনাশিনী' (১৯৭৬), 'কুন্তী সংবাদ’ (১৯৭৬), 'গল্পসংগ্রহ' (১ম) (১৯৭৮), 'গল্পসংগ্রহ' (২য়) (১৯৭৮), মাসের প্রথম রবিবার’ (১৯৭৮), ‘অন্ধকারের গান' (১৯৮০), ও আপনার কাছে গেছে' (১৯৮০), ‘গল্পসংগ্রহ' (৩য়) (১৯৮০), 'গল্পসংগ্রহ' (৪র্থ) (১৯৮০), 'গল্পসংগ্রহ' (৫ম) (১৯৮১) ‘কে নেবে মোরে’ (১৯৮২), 'গল্পসংগ্রহ (৬ষ্ঠ) (১৯৮৩), 'ছায়াচারিণী (ন. সংস্করণ) (১৯৮৩), ‘বাছাই গল্প' (১৯৮৫), 'বিবেকবান/ভীরু’ (১৯৮৬), “আমি তোমাদেরই লোক’ (১৯৮৬), ‘স্বনির্বাচিত শ্রেষ্ঠ গল্প’ (১৯৮৮)।


(গ) সমরেশ বসুর কিশোর সাহিত্য : ‘মোক্তার দাদুর কেতুবধ’ (১৯৭৫), ‘বন্ধ ঘরের আওয়াজ' (১৯৭৯), 'গোগোল চিকুস নাগাল্যাণ্ডে' (১৯৮৩), 'সেই গাড়ির খোঁজে' (১৯৮৪), ‘শিমুলগড়ের খুনে ভূত' (১৯৮৫), 'ভুল বাড়িতে ঢুকে' (১৯৮৬), ‘জঙ্গলমহলে গোগোল' (১৯৮৭), 'বিদেশী গাড়িতে বিপদ' (১৯৮৮)।


(ঘ) সমরেশ বসুর ভ্রমণ-সাহিত্য : কালকূট ছদ্মনামে রচিত : অমৃতকুম্ভের সন্ধানে' (১৯৫৪), 'স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে' (১৯৬৫), ‘কোথায় পাবো তারে' (১৯৬৮), ‘বাণীধ্বনি বেণুবনে' (১৯৭১), 'আরব সাগরের জল লোনা' (১৯৭২), 'নির্জন সৈকতে’ (১৯৭২) ‘মন চল বনে’ (১৯৭৩), 'বনের সঙ্গে খেলা' (১৯৭৪), 'প্রেম নামে বন’ (১৯৭৫), ‘অমাবস্যায় চাঁদের উদয়' (১৯৭৫), 'কালকূট রচনা সমগ্র' (১ম) (১৯৭৫), 'হারায়ে সেই মানুষ’ (১৯৭৫), ‘বাঁশীর তিন সুরে' (১৯৭৬), ‘মিটে নাই তৃষ্ণা’ (১৯৭৬), তৃষার সিংহের পদতলে’ (১৯৭৬), 'কালকূট রচনা সমগ্র' (২য়) (১৯৭৬), ‘কালকূট রচনা সমগ্র’ (৩য়) (১৯৭৬), 'কালকূট রচনা সমগ্র' (৪র্থ) (১৯৭৭), 'কালকূট রচনা সমগ্র' (৫ম) (১৯৭৮), ‘শাম্ব’ (১৯৭৮), ‘ঘরের কাছে আরশিনগর' (১৯৭৯), 'মনভাসির টানে' (১৯৮০), ‘কালকূট রচনা সমগ্র (৬ষ্ঠ) (১৯৮১), ‘মুক্তবেণীর উজানে’ (১৯৮১), চিল মন রূপনগরে’ (১৯৮২), ‘পিঞ্জরে অচিন পাখি’ (১৯৮২), ‘কালকূট রচনা সমগ্র' (৭ম) (১৯৮৩), ‘কোথায় সে জন আছে’ (১৯৮৩), ‘প্রাচেতস' (১৯৮৪), যুদ্ধের শেষ সেনাপতি’ (১৯৮৪), ‘পৃথা’ (১৯৮৬), ‘ধ্যান জ্ঞান প্রেম' (১৯৮৬), ‘যে খোঁজে আপন ঘরে’ (১৯৮৭), ‘জ্যোতির্ময় শ্রীচৈতন্য’ (১৯৮৭), 'পণ্যভূমে পুণ্যস্নান' (১৯৮৭), 'এক যে ছিলেন রাজা' (১৯৮৮)।


সমরেশ বসুর ভ্রমর : ‘জনক’ (১৯৭৫), 'বাসন্তীর সংসার’ (১৯৭৬), '‘অস্তিম প্ৰণয়' (১৯৮৭)।


সমরেশ বসুর উপন্যাস : অয়নান্ত, পঞ্চবহ্নি, পুতুলের খেলা, শালঘেরির সীমানায়, রানীর বাজার।


সমরেশ বসুর গল্প : আইন নেই, আলোর বৃত্তে, এখানে সেখানে, ছোট ছোট ঢেউ, দেওয়াললিপি, পসারিণী, পাহাড়ী ঢল, ফুলবর্ষিয়া, বিকেলে শোনা, বিবরমুক্ত, যৌবন, সুবর্ণা।


সমরেশ বসুর কিশোর : সোনালী পাড়ের রহস্য।


সমরেশ বসুর কর্মজীবন : রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ:

লেখক রূপে আত্মপ্রকাশের আগে সমরেশ বসু (প্রকৃত নাম—সুরথ বসু) বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। প্রসঙ্গ ভারতীয় কমিউনিস্ট (অখণ্ড) পার্টি ও আমি' শীর্ষক রচনায় তিনি জানিয়েছেন : “কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসার পরেই আমার চারপাশের জগৎ ও মানুষ সম্পর্কে দৃষ্টি সজাগ হয়। আমার অভিজ্ঞতার প্রসার ঘটে”।


এই অভিজ্ঞতা ব্যারাকপুর জুট-বেল্টে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ক্ষেত্রে, ইছাপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে কাজের সূত্রে, কখনও বা বস্তিতে বসবাসের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছিল। ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পান, তখন থেকে ‘পার্টি নেতৃত্বের প্রতি, পার্টির প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। তার নিজের ভাষায়, “পার্টির প্রতি কেবল বিশ্বস্ততা নয়, জীবন ও সংসার সবই আমরা উৎসর্গ করেছিলুম। শিখেছিলুম কাকে বলে ডিসিপ্লিন। প্রাণ থেকে শুরু করে, পার্টিকে অদেয় কিছুই ছিল না”।


কিন্তু, ১৯৪৮-৪৯ সালে রণদিভের নেতৃত্বের আমলে নিজের এলাকায় পার্টির মধ্যে কিছু অদ্ভুত আচরণ দেখে তিনি পার্টির কাজকর্ম সম্পর্কে সংশয়ী হয়ে পড়েন। পার্টির প্রতি বিশ্বস্ততা সত্ত্বেও তার মনে কিছু মৌলিক প্রশ্ন জেগে ওঠে। সেই সব প্রশ্ন পরে তার মনে পার্টি সম্পর্কে মোহভঙ্গ ঘটায়। পার্টির পক্ষ থেকে সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলা হয়, আঞ্চলিক কর্মীদের উপর কলকাতার পার্টি নেতৃত্বের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। তারপর কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী ঘোষিত হলে সমরেশের মতো পার্টিকর্মীদের একাংশের সঙ্গে আঞ্চলিক নেতাদের মতাম্ভর তীব্র হয়ে ওঠে, অনেকে ধরা পড়ে এবং সমরেশের বিশ্বাস দলীয় কারণে তাঁকে ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্রেসিডেন্সী জেলে এক বছর (১৯৪৯-৫০) থাকাকালীন তিনি কমিউনিস্ট পার্টির তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বের শিকার হন। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর তাঁর চাকরি যায়, সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মের অবসান ঘটে। অবশেষে তাঁর কথামত, ১৯৫৫ সালে ‘নিষ্ক্রিয়তার কারণে পার্টির সদস্যপদ খারিজ dropped হয়ে যায়'।


সক্রিয় রাজনীতির পথ পরিত্যাগ করলেও সমরেশ বসু তাঁর মনোজগৎকে রাজনৈতিক চেতনাপ্রবাহের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করেন নি। কারণ কোন সচেতন মানুষের পক্ষে রাজনীতির জগৎ থেকে দূরে সরে থাকা সম্ভব নয়। তিনি নিজেও জানেন, “যে শিশু ফুটপাতের উপর না খেতে পেয়ে মরে থাকে রাজনীতির নামাবলী ওর শবের গায়েও ঠিক জড়িয়ে থাকে।” তাই তাঁকে বলতে শুনি“আমি এখনও বিশ্বাস করি, কোনো রাজনৈতিক দলভুক্ত হই বা না হই, রাজনীতি সম্পর্কে সব মানুষেরই সচেতন ও অবহিত থাকা উচিত। এই বোধ আমি কমিউনিস্ট পার্টি থেকেই পেয়েছিলুম।”


অবশ্য এই রাজনীতিবোধ শাসন-শোষণ-অবিচারের বিরুদ্ধে শ্রেণীসংগ্রামের রাজনীতি না, পার্টি-ভিত্তিক দলীয় চক্রান্ত উদঘাটনের সংকীর্ণ রাজনীতি রূপে তাঁর লেখায় উপস্থিত, সে সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনায় যাব। কিন্তু তাঁর লেখা বিপুল সংখ্যক গল্প উপন্যাসগুলির মধ্যে বার বার রাজনীতিমূলক প্রসঙ্গ উত্থাপনের প্রচেষ্টাটি নিশ্চয় লক্ষ্য করবার। এমন কি, রাজনীতি-বিনির্ভর বিষয় নিয়ে সজ্জিত তাঁর কালকূট রচনাবলীর প্রথম রচনা ‘ভোটদর্পণ’ লেখার মধ্যেও এই রাজনীতি সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়।


সমরেশের অনেক উপন্যাসের মধ্যে রাজনীতির বিষয় কোথাও এককভাবে, কোথাও প্রেম, যৌনকামনা প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে মিশ্রিতভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই রাজনীতির দ্বন্দ্ব, কিন্তু ভারতীয় সামন্তবাদ ও কৃষকশ্রেণীর দ্বন্দ্ব’ বা মালিক-শ্রমিকের বিরোধ-উদ্ভূত কোন শ্রেণীসংঘর্ষমূলক চিত্র নয়, তা অধিকাংশ সময়েই পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টি নির্ভর দলীয় চক্রান্তের সমালোচনায় পরিব্যাপ্ত। রাজনীতি-নির্ভর সমরেশের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে স্মরণ করা যায় : ‘স্বীকারোক্তি’, ‘প্রজাপতি’, ‘পদক্ষেপ’, ‘পাতক', ‘মানুষ’, ‘বিশ্বাস’, ‘ওদের বলতে দাও', 'মানুষ শক্তির উৎস’, ‘মহাকালের রথের ঘোড়া', ‘গন্তব্য’ প্রভৃতি।


পূর্বসূত্র : ‘শ্রীমতী কাফে’ ও ‘বিবর’ : সমরেশ বসুর রাজনীতি-নির্ভর উপন্যাস রচনার খ্যাতি সাধারণভাবে ‘স্বীকারোক্তি' ছোটোগল্প বা ঐ নামে লেখা উপন্যাস থেকেই লক্ষণীয় হয়। তার প্রথম কারণ, আত্মকথনে নায়কের বিদ্রোহী মনোভাব। দ্বিতীয় কারণ, এই উপন্যাস থেকেই সমরেশ বসু শুরু করেন কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে তাঁর বিশ্বাসভঙ্গের দৃষ্টাত্তস্থাপনে। কিন্তু মনে রাখা উচিত, 'স্বীকারোক্তি' উপন্যাস তার রাজনীতি সচেতনতার প্রথম নিদর্শন নয়, এর অনেক আগে 'শ্রীমতী কাফে' (১৯৫৩) উপন্যাসে তিনি ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় জীবনের এক অস্থির দামাল সময়কে মূর্ত করে তুলেছিলেন। আবার পার্টি-ভিত্তিক রাজনীতি সম্পর্কে সমালোচনা তার রাজনীতি-বিনির্ভর ভিন্ন ধরনের রচনা ‘বিবর’ (১৯৬৫) উপন্যাসেও দেখা যায়। এই উপন্যাসের অনামা নায়ক কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী না হয়েও বলেছেঃ “আমাদের চাকরির চক্রের মতো, পার্টিরও চক্র আছে, এবং চাকরির চক্রে যেমন ঘুষ খাওয়া অপরাধ নয়, তেমনি পার্টিচক্রের মধ্যেও কোনো পাপই পাপ নয়, যদি পার্টির প্রয়োজনে হয়—তোমার পরিচয় ‘মানুষ’ নয়, ‘পার্টিম্যান’—যন্ত্রের মতো এগিয়ে চলো, পোষা কুকুরের মতো লয়াল হও, স্বাধীনতাকে ভয় পায় না, এমন পার্টি আমি কোথাও দেখিনি”। অথচ এই উপন্যাসের বক্তব্য-বিষয় মোটেই রাজনীতি-নির্ভর নয়। কিন্তু নায়কের অন্তরালে লেখকের পার্টি-ভিত্তিক রাজনীতি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই যেন এখানে ফুটে উঠেছে। তাই সমগ্র উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে অস্বাভাবিক মনে হলেও একথা সত্য, “বিবরেই রয়ে গেছে বিশ্বাসভঙ্গের সামগ্রিক ছবির মধ্যে রাজনীতি বিষয়ে ভগ্নবিশ্বাসের বীজ”।


“স্বীকারোক্তি’ উপন্যাসের ঘটনাবলীর অনেকখানি লেখকের বন্দী জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত। অবশ্য প্রথম পর্যায়ে এটি ছিল ছোটগল্প। এক কমিউনিস্ট বন্দী স্পেশাল ব্রাঞ্চের বাঘা ইনভেস্টিগেটরের কাছে বলেছে : “সত্যের স্বীকারোক্তি দেওয়া কখনও সম্ভব হয় নি বাল্যে পিতামাতার কাছে, যৌবনে স্ত্রী বা প্রেমিকার কাছে, কর্মে পার্টির কাছে এবং এখন পুলিশের কাছে।” আর উপন্যাসেও সেই নায়ক সদ্যচেনা একজনের কাছে নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছে“আমার পাপগুলো আমার কাছে ধরা পড়তে আরম্ভ করেছে এবং তার জন্যেই আপনাকে এই কথাগুলো বলতে পারলাম।”


এই ‘পাপ’ অর্থ–আত্মপ্রতারণা, পরিবেশ পরিজন ও সমাজের ছলনা ও নিষ্ঠুরতা মেনে নেওয়া, প্রতি পদক্ষেপে অন্যায়ের কাছে হার মানা। তাই সে স্বীকার করে : “একথা ঠিক, এখন তো বুঝতে পারছি, আমার কোন্ বিষয়টাই বা ফেয়ার ছিল। আনফেয়ার সবখানে, সবকিছুতে আনফেয়ার এবং এখন বুঝতে পারি সমস্ত জীবনটাই তাই।” আর সেই আত্মযন্ত্রণার বশে সে তার বস ল্যাসকে, নিজের স্ত্রীকে, একজন নিরপরাধ বৃদ্ধ পথচারীকে, এমন-কি প্রেমিকা কুঁড়িকে পর্যন্ত খুন করে। অবশ্য উপন্যাসের শেষে ‘অস্বীকার’ অংশ থেকে জানা যায় এই খুনের ক্রিয়াকর্ম সবটাই ঘটে শেষ পর্যন্ত কল্পনায়। আসলে মানুষ সম্পর্কে অবিশ্বাস, ঘৃণা, বিবমিষাই তার মধ্যে জাগিয়ে দিয়েছিল এই হননের ইচ্ছা। এই অবিশ্বাসের সঙ্গে রাজনীতি বিষয়ে পরিপূর্ণ আস্থাহীন মনোভাবও তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তার মতে ‘পাটি’ মানে কেবল মুক্তিসন্ধানী সংগঠন নয়, এর মধ্যে আছে দলীয় স্বার্থ ও সন্দেহে ঘেরা একাধিক চক্র যেখানে আদর্শের দ্বন্দ্বকে শেষপর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করে জেগে ওঠে নেতৃত্বের বিরোধঙ্গ তাই পার্টি বা দলের মধ্যে উপদলের ষড়যন্ত্র বা চক্রের কথায় সে সোচ্চার হয়ে ওঠে: “এই চক্রগুলো সবসময়েই নিজেদের মধ্যে লড়ে, সুযোগ পেলেই একটা আর একটাকে এলিমিনেট করে...।”


শুধু তাই নয়, সংসদীয় রাজনীতির পথে ভোটের লড়াইয়ে জেতা কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠায় পার্টির ঘোষিত পূর্বতন আদর্শ ও নীতির সঙ্গে রাজনৈতিক কার্যকলাপের দুস্তর ব্যবধান গড়ে ওঠে। এমন কি, পার্টির প্রতি আনুগত্যে অনেক সময় মানবধর্মকে হত্যা করা হয়। 'রাজনীতি' আর 'রাজনৈতিক দল’, ‘দলের রাজনীতি’ আর ‘রাজনৈতিক আদর্শে’র মধ্যে দূরত্ব এর ফলে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাজনীতির প্রতি অনাস্থায় যৌনতার বিকল্প পথ সে অবলম্বন করে। কারণ 'জন্তু'র মতো যৌনতাতেই অন্ততঃ সাময়িক স্বস্তি। অন্য সব কিছুতে তার আস্থা আজ বিচলিত, যৌনতাই খানিকক্ষণ ভুলিয়ে রাখে। আবার এই জাস্তব যৌনতা হয়তো সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যৌন-আক্রমণ যেন সমাজকেই আক্রমণ'। স্বভাবতই এক্ষেত্রে নায়কের রাজনৈতিক সততা এবং দলীয় সমালোচনার নৈতিক অধিকারবোধ সম্পর্কে পাঠক মনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। কারণ নায়ক-চরিত্রের আধারে যৌনতা অবাধে আত্মপ্রকাশ করে। 'প্রজাপতিতে’ দেখা যায় ‘স্বীকারোক্তি’র নায়কের মতো সুখচঁাদ বা সুখেন গুণ্ডার আত্মভাষণ। একটি প্রজাপতিকে হত্যা, তার জীবনের সমস্ত পবিত্রতাবোধকে হত্যারই যেন বহিঃপ্রকাশ। আর এই সব কিছুর মূলে আছে পরিবেশের চাপ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তার বিপুল প্রভাব। সুখেনের নিজের ভাষায় : “এই গোটা মফস্বল টাউনটা আমার হাতের কব্জায়। ..... তাই ভয়ে ভক্তি, ভরসাও।”


ফলে কারখানার মালিকেরা তাকে নিজের কাজে ব্যবহারের জন্য সদাই ব্যস্ত। অথচ এককালে ছাত্র-রাজনীতি করা ভদ্রবংশের সন্তান সুখচঁাদের কাছে আজ সকলেই ঘৃণা ও অশ্রদ্ধার পাত্র। স্কুলমাস্টার নিরাপদবাবু, বাড়ির চাকর শুলাদা আর গঙ্গাপদ ডাক্তার ছাড়া সর্বত্র সে দেখে মানুষের মধ্যে লোভ, যৌনতা ও স্বার্থপর স্বভাবের বিকৃতি। তার দুই দাদা দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা—একজন বিরাট সম্পত্তির মালিক, আর একজন বিনা যোগ্যতায় বড় চাকরি পায়। এদের ব্যক্তিগত জীবন এবং রাজনীতির মধ্যে আছে বিরাট ফারাক। তারা মুখে গরীবের কথা বলে, কিন্তু গরীবের জীবনযাপন রীতি এড়িয়ে চলে, এমন কি নীতির বাঁধন তুচ্ছ করে একজন অবৈধ সন্তানের জনক হয়ে ওঠে। তারা দুজনেই শহর-ত্রাস ভাইকে দলে টানতে চায়, দলে না পেয়ে 'গুণ্ডা' বলে। আর এধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করে সুখচঁাদ রাজনৈতিক দল আর তার কুচো নেতাদের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে: “রাজনীতির দল না হয় একটা মন্দিরের মতো ... কিন্তু পূজারীগুলো যেমন ভাব দেখায়, দেবতারা সব ওদের হাতধরা... ওরা ঘণ্টা নাড়লেই ঠাকুর চোখ মেলে তাকাবে।” ঘটনার শেষ পরিণতি রূপে দেখা যায়, দুই প্রতিপক্ষ দলকে শত্রু করে .তুলে সুখেন নিজে শেষে খুন হয়।


‘পদক্ষেপ’ উপন্যাসে রাজনীতি, দল ও নেতৃত্বের সমালোচনা অনেক সজীব, সুস্থ ও স্বাভাবিক। এখানে ১৯৪৫-এর পটভূমিতে পরাধীন ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের আইন অমান্য আন্দোলনের বর্ণনা দিয়ে কাহিনী শুরু হয়। এই আন্দোলনে জড়িয়ে যায় তরুণ মহিমঙ্গ পুলিশের গুলিতে জখম মহিমকে বাঁচায় অনিল। পরে উদ্ধারকর্তা অনিলের সাহচর্য ও প্রভাবে সে যুক্ত হয় পাটকলের শ্রমিক সংগঠনের কাজে। এখানে সে বামপন্থী অনিলের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে মুগ্ধ হয়। অন্যদিকে তার ছোটকাকা প্রাণতোষ এবং অলোকের অনিলের বিরুদ্ধে ঈর্ষা এবং 'টিলার্স এ্যাণ্ড ওয়ার্কার্স পার্টির মধ্যে উপদল গঠনের প্রচেষ্টায় বিতৃষ্ণাবোধ করে। পার্টির সভ্য হলেই তাকে যান্ত্রিক ভাবে ব্যবহার করা যে যথার্থ কাজ নয়, একথা বোঝাতে চেয়ে অনিল বলে “পার্টির সভ্য মানে, পার্টির ঠিক সে রকম যন্ত্র নয় যে, নাটবোল্টের মতো তাদের কাজে লাগানো যায়। আগে মনে করতে হবে তারাও মানুষ। সহৃদয় এবং শক্তিশালী মানুষ ছাড়া কখনো একটা বড় সংগ্রামী পার্টি তৈরি করা যায় না। সভ্যপদের পরীক্ষা তো সেখানেই। তাকে আমি যন্ত্র হিসাবে ভাবব কেন?” কিন্তু অনিলের এই সদিচ্ছা সার্থক হয় না। পার্টিতে আঞ্চলিক কমিটির নব নির্বাচিত নেতা রূপে বহিরাগত অলোক ও প্রাণতোষ তাদের জঙ্গী মনোভাবের জন্য প্রধান হয়ে ওঠে। এদের ষড়যন্ত্রে পার্টির লোকাল কমিটির সেক্রেটারীর পদ থেকে বিচ্যুত হয়ে অনিলের প্রথমে সাধারণ কর্মী পর্যায়ে স্থান হয়, পরে তাকে ‘দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী’ ব’লে নিষ্ক্রিয় সদস্য করে রেখে গ্রেপ্তার করানো হয়। বলা বাহুল্য, এর মধ্য দিয়ে সমরেশের রাজনৈতিক জীবনের পূর্বস্মৃতিই উদ্ভাসিত হয়। উগ্র বামপন্থী মনোভাবের দ্বারা টিলার্স এ্যাণ্ড ওয়ার্কার্স পার্টির সভ্যদের পরিচালিত করে অনিল ও তার সমর্থকদের অভিযুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে বলা হয় : “দক্ষিণপন্থী ভাবনা পার্টিকে চালিত করেছে। এটা চলতে পারে না। আপোষের মনোভাব টের পেলেই ধিক্কার দিতে হবে। ভিতরে যা কিছু দোটানা ভাব, তাকে তীব্র আক্রমণ করতে হবে।” এই ঘটনার পরিণামে অকারণে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু ধর্মঘটে শ্রমিকদের অনিচ্ছা দেখে শেষে কারখানার গেটে বোমা মেরে তাদের ভীত ও উত্তেজিত করে তোলার চেষ্টা চলে। আর সেই কাজে অনিলের সমর্থক সন্দেহে মহিম এবং আরও কয়েকজনকে জড়িয়ে দিয়ে তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কেবল অলোক ও প্রাণতোষ থাকে নির্দোষ। এক সময় বন্দীরা সকলেই ছাড়া পায় এবং নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। এর পর মহিম ব্যতীত অন্য সকলের জীবনে দেখা যায় এক অভাবিত পরিবর্তন: প্রাণতোষ অর্থাৎ মহিমের ছোটকাকা তার বড় ভাইয়ের বউ ষোড়শীর গর্ভে অবৈধ সন্তানের জন্ম দিয়ে শেষে স্টেনগানওয়ালা একটা ডাকাত দলে যোগ দেয়। অলোক অনিলের বোন নীলিমার বিপ্লবের নামে দেওয়া হাজার তিনেক টাকা আত্মসাৎ করে বর্ধমানে এক বিরাট প্রেস খুলে বসে, নীলিমা একসময় তার দাদার বিরুদ্ধে 'দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতির অভিযোগে মুখর হলেও শেষে নিজেই এক বড় কারখানার লেবার অফিসারকে বিয়ে করতে যায়, অনিল বাংলাদেশের বাইরে একটা কলেজে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে চলে যেতে প্রস্তুত হয়। কিন্তু সকলে চলে গেলেও মহিম বোঝে পার্টি যাদের প্রাণ, সেই শ্রমিক জনগণ এখনও সকলের অজ্ঞাতসারে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেঙ্গ তাদের সঙ্গে একাত্মতায় সে উপলব্ধি করে যথার্থ শ্রেণী-চেতনা বা শ্রেণী-স্বাতন্ত্র্যের গুরুত্ব : “আস্তে আস্তে সে দেখল, আছে, অনেকেই আছে। এত আছে যে, মহিম ভাল করে কোনদিন চেয়েই দেখে নি। তারা অনিল অলোক প্রাণতোষ নয়। তারা কেউ, সময় বিশেষে চলে যাবার লোক নয় বা সুযোগের সন্ধানী নয়। তারা ছিল, আছে, থাকবেও। কারণ তাদের কাছে লড়াই আর জীবন অচ্ছেদ্য। দুদিনের জন্য কেউ কেউ এসে হয়ত ঝলক দেবে। সেটা কিছু নয়। ওরকম ওপর ওপর এসে, কয়েকটা বুলি আওড়ানো, বেশী দিন চলে না। ঠিক সময়ে ওরা পালিয়ে যাবে। কারণ ওরাও জানে, এটা ওদের জায়গা নয়।” কলকাতা বা শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত কমরেডদের সঙ্গে শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের এই মানসিক দূরত্ব অনুভব করে মহিম এই আত্মচেতনা ও পরিণামী দৃঢ়তায় পৌঁছয় “লড়ার মতো পরিস্থিতিটা নিজেদের, অবস্থার সঙ্গে নিতে হবে। ঠাটে বসে, বাম দক্ষিণের ফতোয়া জারি করলে, আর কেউ মানবে না। মহিম নতুন উদ্যমে কাজে লাগল।” এই উপন্যাসে এককালের কমিউনিস্ট পার্টির অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ লেখকরূপে সমরেশের কৃতিত্ব এখানেই যে, তিনি নিছক নঙর্থক রাজনীতির নৈরাশ্যময় বিবরণ দিয়ে কর্তব্য শেষ করেন নি। সাধারণ পার্টি-কর্মীর মনে শ্রেণী চেতনার উন্মেষ ও সংগ্রামী মনোবলের এক সফল চিত্র তুলে ধরেছেন যা তার পরবর্তী পর্যায়ের উপন্যাসগুলির ক্ষেত্রে দুর্লভ হয়ে ওঠে। 'পাতক' উপন্যাসে অজ্ঞাতনামা নায়কের স্বগতোক্তিতে রাজনীতি ও যৌনকামনা একাত্মভাবে প্রকাশিত হয়। তার কাছে রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম আর নারী-সংসর্গ যেন একই চেতনার দুই রূপ। এখানে দেখানো হয় ছাত্রনেতা রুদ্রের মতো ঘৃণ্য চরিত্রকে কমিউনিস্টপন্থী দলীয় নেতার প্রতিভূ রূপে, যে আসলে পুলিশের গুপ্তচর। প্রকাশ পায় ‘বিপ্লব’ নামে একজনের আন্দোলনের দিনে পুলিশ সার্জেন্টের চাকরিতে ইন্টারভিউ দেওয়ার সংবাদ। নায়কের কণ্ঠে শোনা যায় মধ্যবিত্তের ‘বিপ্লব-কামনার’ প্রতি ব্যঙ্গঃ “বিপ্লব আমরা কোনো দিনই করি নাই, ইচ্ছা আছে করিব, তবে সত্তানগণের নাম তো রাখিতেছি।” এই ব্য। অসংলগ্ন ও যুক্তিহীন। এমন কি, এই আক্রমণে জোসেফ কনরাডের (Joseph Conrad) মতো বিপ্লবের ব্যাখ্যা অথবা বিপ্লব বিলাসীদের দ্বারা বিপ্লব-ধ্বংস হওয়ার কারণ নির্ণয়েরও কোন সদিচ্ছা নেই। অনুরূপভাবে যৌনতার উপস্থাপনাও রাজনীতির অবিকল্প প্রয়োজনে উদ্ভূত নয়।


‘মানুষ’ ক্ষুদ্ৰাকায় উপন্যাস বা উপন্যাসোপম বড় গল্পঙ্গ কাহিনীর প্রথমে আছে একটি সভার বক্তৃতা শেষে প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক কমিউনিস্ট নেতা ধীরেশকে সুজিত রিভলবার দেখিয়ে নিজের তল্লাটে নিয়ে যায় বিচারের জন্যঙ্গ তার কারণ ১৯৪৮-৪৯ সালে সংকীর্ণ অতিবামপন্থী আন্দোলনের সময় ধীরেশ হয়ে উঠেছিল তার অঞ্চলের প্রধান ব্যক্তি। শিশু রাষ্ট্রের অজুহাতে দক্ষিণপন্থী সরকারের দমননীতির এক ভয়ংকর সময়ে এই ধীরেশের চক্রান্তে একে একে তার দলের সবাই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, পড়ে না শুধু ধীরেশ আর তার সঙ্গী নিখিল। আসলে পার্টির বিশ্বাসভাজন বিপ্লবী নেতা রূপে স্বীকৃত এই ধীরেশের বিগত অতীত ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তাক্ত দিনগুলিতে সে ছিল বহু গুপ্ত হত্যার নায়ক। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক, ‘পার্টির নীতি এবং পার্টিযন্ত্রের কাজের মধ্যে কোথাও ফাক' থাকার সুযোগে একসময়ে সে সাধারণ কর্মী হওয়ার পরিবর্তে জঙ্গী নেতা হয়ে ওঠে। পার্টির প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও আদর্শকে উপেক্ষা করে সে সাধারণ সভ্যদের উপর চালায় ‘পার্টির নির্দেশ’ ব’লে স্ব-ইচ্ছার হুকুম। এইভাবে তারই নির্ধারিত পথে মিছিল করতে গিয়ে নিমাই চৌধুরী গ্রেপ্তার হয়। ঈর্ষার বশে সে সর্বজনপ্রিয় সংগ্রামী কমরেড ধ্রুবকে বোমা বিস্ফোরণে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হত্যা করে পার্টির নির্দেশে সব কাজ সংঘটিত ব’লে প্রচার করে। তাই দলের পুরনো কর্মী, সদ্য জেল থেকে ছাড়া পাওয়া সুজিত সেই প্রতারণা ধরিয়ে দিয়ে আজ তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। ধীরেশের পার্টির নাম করে আত্মপক্ষ সমর্থনের জবাবে সে জানায়“পার্টির নাম করলেই ন্যায় অন্যায় বদমাইশি ইতরতা একাকার হয়ে যায় না”। ভগবতী বলে “ও ধরেই নিয়েছে, রাজনীতি আর বিপ্লব করতে হলে, মনুষ্যত্বের কোনো দরকার নেই।”


আর শেষ পর্যন্ত এই মনুষ্যত্বের সীমানা লঙ্ঘন করতে না পেরেই সুজিতরা ধীরেশকে অপরাধের তুষানলে দগ্ধ করে মৃত্যুর চরম দণ্ড থেকে অব্যাহতি দেয়, প্রমাণ করে ‘মানুষের বিবেকই পার্টি তৈরি করেছে। এই গল্পের চরিত্রেরা লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রসূত, যেমন—ধ্রুব-চরিত্র নির্মাণে সমরেশকে কমিউনিস্ট মতবাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর উদ্যোক্তা সত্যপ্রসন্ন দাসগুপ্ত বা সত্য মাস্টারের ভাবকল্পনা বর্তমান। ধ্রুবর মতো তাকেও একসময় সহযোদ্ধাদের ষড়যন্ত্রে ছিন্নভিন্ন হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়। অনুরূপভাবে যার নেতৃত্বের অত্যাচারে সমরেশের মতো পার্টি-কর্মীরা বিপদগ্রস্ত হয়েছিলেন, সেই হঠকারী নেতা শাস্তি মুখার্জীর আদলেই ধীরেশ চরিত্র রূপায়িত হয়। ‘বিশ্বাস’ উপন্যাসের নায়ক নীরেন প্রথম থেকেই এক প্রতারক সরলতার দ্বারা চালিত হয়ঙ্গ তার ব্যক্তিগত জীবন এবং রাজনৈতিক জীবনে প্রেম এবং রাজনীতির প্রতি বিশ্বাসহীনতার সংকট দেখা যায়। সে প্রথমে দক্ষিণপন্থী 'সংশোধনবাদী' কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিল, পরে অন্য কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে সেখানেও সুবিধাবাদী মানসিকতা লক্ষ্য করে। সে দেখে পার্টির ছেলেরা পার্টির তত্ত্ব-নীতি-কৌশল কিছুই জানে না, কিন্তু পার্টির দৌলতে চাকরি পাওয়ার সুবিধা নিতে বাধে না। আবার দিগা বা দিগন্তের মতো মস্তান বা সমাজবিরোধীদের পার্টিতে জায়গা পাওয়ার ব্যাপারেও সে বিস্মিত হয়। তাই সামগ্রিকভাবে পার্টির নীতি ও আদর্শকে সে কদর্য ভাষায় গাল দেয়। শোষিত মানুষের শ্রেণী-বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে বিপ্লবের লক্ষ সফল করা, কিংবা পার্টির মধ্যে নীতি বা তত্ত্বগত বিরোধ থেকে রাজনৈতিক সংগ্রামের অবিকল্প প্রয়োজন অনুভব না করে কেবল বাকচাতুর্যে পার্টি নেতাদের দুর্বলতা গোপনের প্রচেষ্টা তীব্র ভাবে তার ভাষায় সমালোচিত হয় “খড়ের গাদা তেতেই আছে। একটা দেশলাইয়ের কাঠি ঘষে ছুঁড়ে দেওয়ার অপেক্ষা। কিন্তু নীতি বা তত্ত্বগত দিক দিয়ে রাজনৈতিক সংগ্রামের ছবি বা তাৎপর্য যে কিছু আছে, তা প্রায় চোখেই পড়ে না, যা দিয়ে জয়পরাজয়—যাকে বলে বাকতাল্লার উপরে থাকবে, অত্যন্ত ক্ষীণ আর অস্পষ্ট”। আবার সংসদীয় রাজনীতির পথে ভোটের লড়াইয়ে জেতা কমিউনিস্ট পার্টিগুলির প্রধান লক্ষ হয়ে ওঠায় পার্টির ঘোষিত পূর্বতন আদর্শ ও নীতির সঙ্গে রাজনৈতিক কার্যকলাপের দুস্তর ব্যবধান তার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। পার্টির সংগ্রামী লক্ষ্যপূরণের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার বিশ্বাস বিচলিত হয়, মনে হয় “বিশ্বাসটাই তো চোর, অবিশ্বাসটাই দারোগা, চোগা চাপকান পড়ে গলাবাজী আর ডাণ্ডাবাজী করছে।” কিন্তু তবু সমগ্র উপন্যাসে কোথাও ন্যায়ের প্রবক্তা নীরেনের সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী রূপে পার্টির প্রতি আনুগত্যের কোন চিহ্ন নেই। ফলে প্রেমিকা লিপিকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার বদনামে ও সমালোচনার কারণে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত নীরেনের মুখে ঐ ধরনের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ কোনমতেই চরিত্রটির নিরপেক্ষ রাজনীতিজ্ঞান ও গণসংগ্রামের প্রতি তার আস্থা বা বিশ্বাসবোধকে সুপ্রমাণিত করে না। পার্টিতে তত্ত্ব ও আদর্শের অভাব দেখে সমালোচনায় মুখর হলেও সে নিজে কিন্তু পার্টিতে থাকাকালীন ঐসব বিষয়ে কোনরকম অনুরাগ বা উদ্যোগ দেখায় নি। আবার নেতাদের কথায় ও কাজে অসংগতি দেখে সৎ পার্টি ক্যাডারের মনে যে দ্বন্দ্বময় যন্ত্রণা প্রত্যাশিত, নীরেনের মধ্যে তা বিরলদৃষ্ট। নকশালপন্থী কয়েকজন যুবকের অকারণ বিরূপতায় শৌভিক নামে এক ভাবুক শিল্পীর নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে সমরেশ বসু লেখেন 'ওদের বলতে দাও' উপন্যাস। শৌভিকের ছবি আঁকার গুণে অথবা তার গান-বাজনার প্রভাবে মুগ্ধ বাঁশি পুতুল-কৃষ্ণা-শ্রী-কেতকী-রুবির দল যত নান্দনিক ভাবানুভূতিতে আবিষ্ট হয়, ততই তাদের স্লোগান লেখা ‘দেওয়ালগুলোর দিকে তাকাতে ঘেন্না করে'। শৌভিক বাদে সারা শহর জুড়ে এরা শুধু অসুস্থ লোক দেখে। তাই শ্রীর বাবা বলেন : “নকশাল করার থেকে প্রেম করা ভালো”। শৌভিক মাঝে মাঝে ভাবাবেগে বলে ওঠে: “ওরা বলে। ওরা কী বলে? ওদের বলতে দাও।” শৌভিকের কাছে আসে অনিল আর গোরাঙ্গ তাদের সঙ্গে শৌভিকের কথা হয় শেষে অনিল-গোরার মতো তথাকথিত নকশাল ছেলেরা তার কথায় মুগ্ধ হয়ে ‘তোমার কথা সব সত্যি, তুমি আমাদের গুরু’ বলে স্বীকার করে চলে যায়। অথচ এই শৌভিক অকারণে কারোর বিদ্বেষভাজন না হয়েও হঠাৎ একদিন খুন হয়ে যায়। তারপর তার মৃতদেহ মর্গ থেকে পেলে সকলে মিলে হাত ধরাধরি করে শোভাযাত্রা বের করে। কাহিনী শেষে মনে হয়, অনেকগুলি অসুস্থ, আত্মসর্বস্ব, মানুষের মধ্যে সুস্থ, উদারচেতা শৌভিকের মৃত্যুবরণ আপাতদৃষ্টিতে যেন ওদের কথা বলার গণতান্ত্রিক অধিকারকেই স্বীকৃতিদান, যদিও ‘ওরা’ কারা, ওরা কী বলতে চায়—সমরেশ সে-সম্পর্কে কিছুমাত্র আলোকপাত করেন নি। অথচ গোরার মতো তরুণের বাঁশির সঙ্গে অনবরত যৌন-সম্পর্ক স্থাপনের ইঙ্গিত দিয়ে লেখক ইচ্ছাকৃতভাবেই যেন নকশালপন্থী তরুণদের চরিত্রস্খলন দেখিয়েছেন।


‘মানুষ শক্তির উৎস' উপন্যাসে ষাটের দশকে অস্থির রাজনীতি, নকশালপন্থীদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও হত্যার নীতির বিভ্রান্ত যুবসমাজের পরিণতি লক্ষ্য করা যায়। এক অ-রাজনৈতিক চরিত্র যমুনা ওরফে বিন্দুর আত্মকথনের মধ্য দিয়ে সমগ্র কাহিনীর বিস্তারলাভ। গ্রাম থেকে কলকাতায় আসা তেরো বছরের একটি দুঃস্থা মেয়ে তার ছাব্বিশ বছরের বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উচ্চ মধ্যবিত্ত জীবনযাপনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়। প্রেমিক সজলের সঙ্গে পরিচয়সূত্রে প্রৌঢ় বামপন্থী নেতা হরিশদা, নীরেন, ‘একস্ট্রমিস্ট’ সুবীর, হিরণ প্রভৃতি দলীয় কর্মীদের দেখে। শোনে ‘খুন এখন রাজনীতির মুখ্য অঙ্গ’। তাই তার চোখে ‘সুবীরকে যেন ক্রমেই খাঁচায় বন্দী বাঘের মত অস্থির’ মনে হয়, হিরণের চোখে হিংস্রতা দেখে। সুবীরের সঙ্গে সজলের পার্টির মধ্যে খুন করার ‘পদ্ধতিটা ঠিক কিনা’, পার্টিতে ‘লুমপেন প্রলেটারিয়েট'-দের ভূমিকা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে একাধিকবার বিতর্ক দেখা দেয়। হিরণ উত্তেজিত হয় এবং দিন কয়েক পর সুবীরের প্ররোচনায় হিরণের হাতে সজল খুন হয়। শেষে সকলে সিদ্ধান্ত নিয়ে হিরণকে হত্যা করে। এইসব হত্যার মধ্য দিয়ে মৃত প্রেমিক সজলের শেষ চিঠির সত্য যমুনা উপলব্ধি করে“মানুষই সব কিছুর স্রষ্টা, সব কিছুর থেকে মানুষই বড়। .... মানুষ যে সব থেকে বড় শক্তির উৎস, তার প্রমাণ, সে যুগে যুগেই তার অসহায়তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, করবে।” এই উপলব্ধি কতখানি স্বাভাবিক, গ্রন্থ শেষে সে সম্পর্কে কিন্তু কিছু সংশয় থেকে যায় ঃ ‘মানুষ শক্তির উৎস’ এই নামকরণে নকশালবাড়ি আন্দোলনে মাও সে তুঙের উদ্ধৃত ‘বন্দুকের নলই শক্তির উৎস' তত্ত্বকে আক্রমণ করেছেন লেখক। এই আক্রমণ নিশ্চয় অসংগত নয়। কিন্তু বন্দুকের ব্যবহার যে হত্যা এবং মুক্তির দুই বিপরীত প্রয়োজনেই দেখা দিতে পারে পাঠক সে সত্য জানার সুযোগ পায় না।


নকশালবাড়ি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এক আদিবাসী নেতার রাজনীতি ও জীবনকে কেন্দ্র করে সম্ভবতঃ ‘মহাকালের রথের ঘোড়া' উপন্যাস লেখা হয়। রুহিতন কুরমি এই কাহিনীর অন্যতম নায়ক। রুহিতনের বিপ্লবের স্বপ্ন, আন্দোলনের অন্তর্বর্তী পর্যায় ও ব্যর্থতার পর্যালোচনাই এর অন্যতম বিষয়বস্তু। এই রুহিতন কুরমির সঙ্গী শ্রমিক নেতা ভাদুয়া মুণ্ডা, কৃষক নেতা দিবা বাগচি, খেলু চৌধুরী ও কারাগারের বিভিন্ন রাজনৈতিক বন্দীদের প্রসঙ্গে এবং দলীয় কলহ ও চক্রান্তের ঘটনাবলী উপন্যাসের রাজনৈতিক বক্তব্যের অন্যতম আশ্রয়। নকশালবাড়ি, খৈরিবাড়ি, ফাসিদেওয়া, বিজনবাড়ি ইত্যাদি ষাট দশকের কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত প্রসিদ্ধ আঞ্চলিক নামগুলির উল্লেখ এখানে দেখা যায়। (তবে লেখক কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন পার্বত্য অঞ্চল রূপে তার পরিচয়দানেই নিযুক্ত। যেমন—রুহিতনের বাবা পশুপতি কুরমির বিবাহ ও পায়রা খাওয়ার ঘটনা বর্ণনায় ‘নকশালবাড়ি’র বিখ্যাত নামটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই গ্রন্থে ঐ নাম কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোন পটভূমিগত মর্যাদা পায় না।)


কাহিনীর প্রথমদিকে দেখা যায়, ‘তরাইয়ের ভয়ংকর দাঁতাল' রুহিতন কুরমিকে পুলিশ গোপনে এক জেল থেকে আর এক জেলে নিয়ে যাচ্ছে। তার স্মৃতিচারণা সূত্রে জানা যায়, ভাদুয়া মুণ্ডার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে সে এর আগে আর একবার তরাইয়ের চা-বাগানের শ্রমিক আর ভূমিহীন কৃষকদের নিয়ে কলকাতায় এসেছিল। কিন্তু সভার মেলা ভাঙতে কেউ খোঁজ নিল না, খাবার দিল না, ভেবে মনটা কেমন হতাশায় ভরে ওঠে। এই হতাশার অবসান হয়, যখন দিবা বাগচির (কৃষক নেতা কমরেড চারু মজুমদারের প্রতীকরূপ) ‘একটা শোলক’, ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরতে হবে’ বাণী রুহিতনদের জীবনে নতুন স্বপ্ন নিয়ে আসে। সে কিরকম স্বপ্ন? ...সেই সফল স্বপ্নে, অন্ধ দৃষ্টি ফিরে পায়। বোবায় কথা কয়। বন্ধ্যা নারীর সন্তান হয়। ভূমিহীনে ভূমি পায়। জনমজুরে রাজ্য চালায়'। এখানে নকশালবাড়ি আন্দোলনের তত্ত্বভিত্তি রূপে মার্কস লেনিন মাওয়ের মতাদর্শকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উপেক্ষা করে অথবা একটি ‘শোলকে’র (শ্লোগানের ব্যঙ্গ রূপ?) আবরণে অলৌকিক ধর্মীয় এক গ্রাম্য বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত করে ব্যাখ্যার চেষ্টায় পাঠকমনে ব্যঙ্গের ধাক্কা দেয়। রুহিতনকে দলে এনেছিলেন ‘শিলিগুড়ির ধনে মানে বড় মানুষ’, ‘মোহন ছেত্রীর থেকেও বড় জোতদার’ দীনু বাগচির ছেলে দিবা বাগচি। অনেক আগেই পাঠকমনে এঁর সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কারণ প্রথমেই এদেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা মহাত্মা গান্ধীর অনশনরীতি সম্পর্কে তিনি কদর্য এক অশ্লীল মন্তব্য করেন, অথচ তাঁর নিজস্ব আন্দোলনের ধারাটিও সমাজের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে বা নকশালবাড়ির ঐতিহাসিক ঘটনাসত্যের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠকের কাছে কোনমতেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। দিবা বাগচি জোতদারের ছেলে প্রকাশ হয়ে পড়াতেই যে পার্টিতে ভাঙন দেখা দেয়—খেলু চৌধুরী ও তার দলের এ অভিযোগও সত্য নয়। পার্টির তরফে দিবা বাগচি বা চারু মজুমদারের সমালোচনার মূলে ধনাভিজাত্য নয়, সুস্পষ্টভাবে সংগ্রামের পদ্ধতি সম্পর্কে মতভেদ তথা পার্বতীপুরম মামলার আসামী ছ'জন নেতার স্বাক্ষরিত চিঠির রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল। সমরেশ তা সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। কাহিনীর উপসংহারে দেখা যায়, কুন্ঠরোগাক্রান্ত বিপ্লবী রুহিতন কুরমি সকলের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে মাটি খুঁড়ে তার পুরনো রাইফেল বার করে ক্ষয়প্রাপ্ত তর্জনী দিয়ে ট্রিগারে চাপ দিয়েছে। বন্দুক-টোটা পূর্বাবস্থায় নেই। দেহও শক্তিহীন, তবু, তার মনে এখন একটি মাত্র সান্ত্বনা, সে অপমান আর অভিশপ্ত আশ্রয় থেকে নিজের যথার্থ জায়গায় ফিরে এসেছে, সে বুঝতে পারছে, গভীর ঘুম আসছে তার'। এই ‘ঘুম’ শ্রান্তি না আত্মহত্যার ইঙ্গিত, তা শেষপর্যন্ত বোঝা যায় না।


‘মহাকালের রথের ঘোড়া' উপন্যাসে রুহিতন কুরমির অন্তিম পরিণতি পরবর্তীকালে অনেক সমালোচকের কাছেই আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। পার্টি ও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন তার ব্যক্তি-রূপের মধ্যে কেউ ‘মর্ডানিস্টে’র প্রবণতা, কেউ 'সমাজের মুক্তির প্রশ্ন’-কে লঘু ভাবে দেখা, 'বিচ্ছিন্ন’ একা লড়াইয়ের চেষ্টা, এমন কি নকশাল আন্দোলনকে এই সঙ্গে 'বাল্যখিল্য ব্যাপার' ব’লে উপেক্ষার কথাও কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এই উপন্যাসের বক্তব্য সংশয় জাগায়।


‘গন্তব্য’ উপন্যাসে শহরাঞ্চলে নকশালপন্থীদের সঙ্গে মতাদর্শগত দূরত্ব এবং সেইসঙ্গে পুলিশের ভয়ে বিপন্ন এক যুবকের বিষণ্ণ পরিণতি দেখা যায়। এই যুবক কলকাতা থেকে দীঘা যাওয়ার দূরপাল্লার বাসে তেরো নম্বর সিটের এক রহস্যময় যাত্রী, নাম কমল। এই সিটে সহযাত্রিনী ফুল্লরা, তার পূর্ব প্রেমিকা। একসময় এই ফুল্লরার কাছ থেকে কমল সরে গিয়ে সশস্ত্র আন্দোলন সংগঠন করার কাজে গ্রামে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে ‘মত আর পথ নিয়ে তার পুরনো বন্ধু শ্যামল ও তার দলের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। কমল বলে: “বিপ্লবী সরকারে আমার বিশ্বাস নেই, তারা কোনো লোকায়ত্ত রাষ্ট্রও গঠন করতে পারবে না। সেই জন্যই মার্কসবাদকে আমি আর ঠিক আগের চোখে দেখছি না। .....আমাদের পথ ভুল হয়েছে। ভুল কোথায়, সেটা আলোচনার বিষয়। আমরা নিজেরাই তা ঠিক করবো। তবে বিপ্লবী সরকার নয়। লোকায়ত্ত রাষ্ট্র চাই। পৃথিবীতে নিরাজসমাজবাদীরাই তার রূপরেখা ঠিক করে দিয়ে গেছেন”।


এইসব আলোচনার কিছু পরেই দেখা যায়, ভুবনেশ্বরে বাস থামলে পুলিশ কমলকে নামিয়ে নেয়। শেষে কমল পালাবার চেষ্টা করলে গুলি খেয়ে মরে। কিন্তু বাসযাত্রীদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় না। এই উপন্যাসের কাহিনীতে লক্ষ করা যায়, রাজনৈতিক প্রসঙ্গ শুধুমাত্র শেষ দুটি অধ্যায়ে (সতেরো এবং আঠারো) উল্লিখিত, পূর্ব অধ্যায়গুলিতে তা অনুপস্থিত। এই রাজনীতি কমিউনিস্ট পার্টি তথা নকশালবাড়ি রাজনীতির বৈপ্লবিক কার্যকলাপের ব্যর্থতার সমালোচনা। এখানে রাজনীতির বক্তব্য নামমাত্র রেখে তার সঙ্গে নর-নারীর দৈহিক উপাদান মিশ্রিত করার ঘটনাসজ্জা অপ্রাসঙ্গিক রূপে প্রাধান্য পায়। অনুরূপভাবে, সুন্দরী যুবতী ফুল্লরাকে লক্ষ্য করে বাসের মধ্যে কয়েকজন তরুণের ‘আদরির গান’ গাওয়ার রীতি ভদ্র রুচির শেষ সীমানা লঙ্ঘন করে, যা অন্ততঃ কোন ‘রাজনৈতিক উপন্যাসে’র মধ্যে প্রত্যাশা করা যায় না।


কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে সমরেশ বসুর সমালোচনা : সাধারণ লক্ষণ

সমরেশ বসুর রাজনীতি-নির্ভর উপন্যাসগুলির মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে বিরতিহীন সমালোচনা লেখকের রাজনীতিবোধের এক সাধারণ লক্ষণ রূপে উপস্থিত। এই সমালোচনাকালে লেখকের রূপকারী বিবেক কতখানি নিরপেক্ষ দায়বৃত্ত পালন করেছে, সে সম্পর্কে তাঁর গল্প-উপন্যাস নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে একাধিক সমালোচক অভিযোগ করেছিলেন, যেমন শ্রী অশ্রুকুমার সিকদার বলেছেন.... “সমরেশ কম্যুনিস্ট আন্দোলন ও দলের নেতিমূলক কার্যকলাপের যে পুনরুক্তিময় সমালোচনা তিরিশ বছর ধরে উপন্যাসগুলির মধ্যে করে চলেছেন, তাতে তাঁর উপন্যাস বিপরীত ধরনে প্রচারধর্মী হয়ে উঠেছে বলা যেতে পারে। কাল, পটভূমি গল্পে ব্যবহৃত বিশেষ কম্যুনিস্ট দলের পরিবর্তন হয়—কিন্তু ব্যক্তিগত বিশ্বাসভঙ্গের কাহিনীকে উপন্যাসের মধ্যে তিনি সাকার করে তুলতে থাকেন অনর্গল নিষ্ঠায়।”


সমরেশ বসু সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীরূপে পার্টিতে থাকাকালীন দলীয় ষড়যন্ত্রের বলি হয়েছিলেন, একথা তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিতে দলীয় সদস্যের প্রতি অবিচারের ঘটনা কোন অভিনব ব্যাপার নয়। খোদ রাশিয়াতেই ১৯৩৪ সালে রাষ্ট্রীয় সাহিত্যাদর্শের ধারক রূপে সোস্যালিস্ট রিয়ালিজম' শিল্পচর্চার অন্যতম মানদণ্ড হয়ে ওঠায় আমলাতান্ত্রিক নির্দেশে বহু শিল্পীকে প্রাণহানি, নির্বাসন ও কণ্ঠরোধের নিয়তিকে নির্বিচারে মেনে নিতে হয়েছিল। এঁদের মধ্যে ছিলেন—মায়াকভস্কি, জেমিয়াটিন, পিলনিয়াক, ম্যানডেলস্টাম, বাবেল, বুনিন, পস্তেরনাক, বেলি, মিরস্কি, স্বেতায়েভা প্রমুখ একাধিক ব্যক্তি। এঁদের মধ্যে একটি বিষয় লক্ষ্য করবার : এঁরা একসময় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা নিগৃহীত হলেও কোনক্রমেই এঁদের কমিউনিস্ট মতাদর্শ-নির্ভর রাজনৈতিক বিশ্বাস বিনষ্ট হয় নি। বাংলাদেশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা সুকান্ত ভট্টাচার্যও শেষ জীবনে পার্টির কোন কোন আচরণে আহত হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। কিন্তু সেইজন্য তাঁদের পূর্বাশ্রিত রাজনৈতিক বিশ্বাস নষ্ট হয় নি অথচ প্রায় এক দশক (১৯৪৪-১৯৫৫) পার্টির সঙ্গে যুক্ত থেকে সমরেশের মনে হয়, 'যা আমার বিশ্বাস ছিল’ সেই বিশ্বাসে আঘাত লেগেছে, ‘প্রত্যাশাকে ভেঙে খান খান করা হচ্ছে এবং ‘সমস্ত বিশ্বাসকে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। আর সেই বিশ্বাসভঙ্গের জন্য তিনি রচনা করেছিলেন একের পর এক রাজনীতি-আশ্রিত উপন্যাস। কিন্তু তাঁর গল্প-উপন্যাস পড়ে এই বিশ্বাসভঙ্গের ঔচিত্য সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়


(ক) সমরেশ বসু কমিউনিস্ট পার্টি না মার্কসীয় মতাদর্শ কার দ্বারা উদ্দীপিত হয়ে রাজনৈতিক বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন? যদি সেই বিশ্বাস পার্টির জন্য বিপর্যস্ত হয়, তবে তা কি শুধুমাত্র আঞ্চলিক ক্ষেত্রে পার্টির তার প্রতি অবিচার-ই মূল কারণ? লেখক নিজে বলেছেন : “অখণ্ড কমিউনিস্ট পার্টি আমাকে কোনোদিনই কোনোকালেই পার্টিবিরোধী কাজের জন্য দায়ী করেনি।” লক্ষ্য করা যায়, সমরেশের খুব কম উপন্যাসেই কমিউনিস্ট পার্টির দলীয় ষড়যন্ত্র-উদঘাটনের দৃশ্য পশ্চিমবঙ্গ অতিক্রম করে সর্বভারতীয় বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে। অথচ সমরেশের নায়কেরা কিন্তু সামগ্রিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টি ও ভাবাদর্শকেই আক্রমণ করেছে। কেন এই অকারণ বিরূপতা?


(খ) লেখকমনে সত্যই ‘বিপ্লব’ সম্পর্কে প্রত্যাশাভঙ্গ হলে, ১৯৬৭ সালে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ‘সংশোধনবাদ’ ও ‘বিপ্লবী' নীতির বিরোধে দ্বিধা-বিভক্ত হওয়ার পর, বিপ্লব-প্রত্যাশী লেখকের শেষোক্ত পার্টির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করাই স্বাভাবিক ছিল নয় কী? কারণ সংসদীয় রাজনীতির পথ পরিত্যাগ করে শ্রেণী-সংগ্রামের বৈপ্লবিক সমাধানের দাবিতেই ঐ পার্টি নতুন নীতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু কার্যতঃ, সমরেশের উপন্যাসের মধ্যে নকশালপন্থীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব সব চাইতে তীব্রভাবে লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে বিশ্বাসে আঘাত লাগলেও সমালোচনাকালে সৎ, আদর্শনিষ্ঠ পার্টিকর্মী একথা মনে রাখে, “Both morally and logically the Party was infallible ; morally, because its aims were right, that is, in accordance with the Dialectic of History, and these aims justified all means logically, be cause the Party was the vanguard of the Proletariat"।


(গ) সমরেশের নায়কেরা কমিউনিস্ট পার্টিতে দলীয় কর্মীর ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণের অভিযোগ তীব্রভাবে উত্থাপন করে বামপন্থী বিশ্বাস সম্পর্কে মোহভঙ্গের স্বীকারোক্তি শুনিয়েছে কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, বিশ্বাসভঙ্গের পূর্বে কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে তাদের অনুরাগের বা আত্মত্যাগের দিকটি আমাদের অজানা থেকে যায়।


(ঘ) সমরেশ বসুর উপ্যনাসগুলিতে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির স্বরূপ ব্যাখ্যানে আধা-সামন্ততন্ত্র ও আধা-ধনতন্ত্রের সমাজকাঠামোর মধ্যে ব্যক্তির অস্তিত্ববাদের সংকট, সমাজের মুক্তির পরিবর্তে ব্যক্তির মুক্তিকে বড় করে তোলার সীমাবদ্ধতাও অনেকের চোখে পড়েছে, যেমন লেখকের মৃত্যুর পর শ্রী সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেনঃ “... থেকে শেষ পর্যন্ত লক্ষ করি, সমরেশ ব্যক্তির প্রশ্নটাকে যতটা সামনে রেখেছিল, সমাজের ...... প্রথম মুক্তির প্রশ্নটাকে ততটা সামনে রাখেনি। এটা তার প্রধান সীমাবদ্ধতা। 'বিবর' থেকে যে পর্যায়ের সূচনা হল সেখানে প্রধান হয়ে উঠেছে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতার প্রশ্ন, সেই বিচ্ছিন্নতা সমাজতান্ত্রিক দেশে সম্ভব নয়। সেই বিচ্ছিন্নতার সমস্যা ধনতান্ত্রিক সমাজের সমস্যা।” একথা অনস্বীকার্য, ব্যক্তিমুক্তির নামে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা, মূল্যবোধে বিশ্বাসহীন নীতিহীনতাই সমরেশের নায়কদের মধ্যে অনেক সময় পরিলক্ষিত হয়। সেক্ষেত্রে ‘কম্যুনিস্ট’ না ব’লে এদের 'মর্ডানিস্ট হিরো' রূপে চিহ্নিত করাটা কি অসঙ্গত হবে?


উপরন্তু, ‘রাজনৈতিক উপন্যাস' রচনার জন্য যে মতাদর্শের গভীর অনুশীলন ও মূল্যবোধে আস্থা বাঞ্ছনীয়, সমরেশ বসু সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন কিনা সন্দেহ। কারণ এই সচেতনতা থাকলে তিনি বুঝতেন, মার্কসবাদের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে কোন বুদ্ধিজীবীকে তার ভূমিকা পালন করার সময় এ সম্ভাবনা মেনে নিতেই হয় যে, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায়, তার বাধ্যতামূলক নীতি ও অভ্যাসের প্রভাবে সে-ও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর শুধুমাত্র সচেতন প্রচেষ্টায় সর্বক্ষণ সংগ্রামের দ্বারা পরিবেশ-উদ্ভূত সেইসব বাধাগুলি অতিক্রম করা সম্ভব।


প্রকাশন সংস্থার প্রভাব

আধুনিক সাহিত্য কেবল শিল্পসামগ্রী নয়, তা অনেকাংশে ভোগ্যপণ্যে পরিণত আধুনিক সাহিত্যশাখার মধ্যে উপন্যাসের পাঠক-আকর্ষণের ক্ষমতা সব চাইতে বেশি। তাই বিভিন্ন রকম উপন্যাস বিক্রি করে বৃহৎ প্রকাশন সংস্থাগুলির মুনাফা অর্জনের প্রবণতা সহজেই লক্ষ্যগোচর হয়। এই প্রবণতার দাবি মেটাতে বৃহৎ ঐ প্রতিষ্ঠানগুলির অনুগত হয়ে কিছু লেখক যেন যান্ত্রিক ফর্মূলায় উপন্যাস উৎপাদনের কাজে নিযুক্ত হন। সমালোচক টেরি ঈগলটন (Terry Eagleton) তাঁর গ্রন্থে এ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন : “Literature may be an artefact, a product of social consciousness, a world vision; but it is also an industry. Books are not just structures of meaning, they are also commodities produced by publishers and sold on the market at a profit....Writers are not just transposers of trans-individual mental structures, they are also workers hired by publishing houses to produce commodities which will sell."


দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সমরেশ বসুর মতো শক্তিশালী ঔপন্যাসিকও ‘রাজনৈতিক উপন্যাস’ লিখতে গিয়ে বিশেষ প্রকাশন সংস্থার অভিপ্রায় অনুসারে পরিকল্পনা মাফিক উপন্যাস লিখেছেন। কমিউনিস্ট আদর্শ, কমিউনিস্ট পার্টি, সমাজতান্ত্রিক সমাজ-রাষ্ট্র ইত্যাদি ধ্যান-ধারণার প্রতি তাঁর তীব্র আক্রমণের অন্তরালে তিনি যে বিশ্বাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁর কোন কোন রচনার অন্তরালে সেই পুঁজিবাদী ভাবাদর্শই যেন প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। সেইজন্য দেখা যায়, এককালের সক্রিয় কমিউনিস্ট কর্মী হয়েও ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গে বর্গাদার বিপ্লব, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, ছোট ও বড় চাষীর সম্পর্ক, শিল্পায়ন ও চাষী জীবনের সংঘাত, জোতদার মহাজনের অত্যাচার ইত্যাদি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ রূপায়ণে তিনি নিস্পৃহ। অথচ সত্তরের দশকে নকশালবাড়ির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সারা দেশব্যাপী তরুণ-যুবগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কার্যকলাপ যখন ছড়িয়ে পড়েছে, তখন লেখক প্রকৃত তথ্য না জেনে অথবা উপেক্ষা করে, কখনও বা কাল্পনিক ও যৌন উত্তেজনাময় গল্প ফেঁদে ঐ আন্দোলনের বিকৃত ব্যাখ্যায় উদ্যোগী হন। এই উদ্যোগ কোন অর্থেই একজন প্রাক্তন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে, কি মহৎ লেখক রূপে সমগ্র মানবসমাজের কাছে তার ‘কমিটেড’ থাকার স্বীকারোক্তিকে প্রমাণ করতে সাহায্য করে না। তাই বৃহৎ প্রকাশন সংস্থার প্রভাবে রচিত উপরোক্ত উপন্যাসগুলিতে লেখক সমকালের রাজনীতিমূলক বাস্তব ঘটনাগুলিকে কল্পনার মাধ্যমে প্রকাশের ভান করেছেন মাত্র। তবু বলা যায়, এই বিতর্কিত লেখক আধুনিক বাংলা উপন্যাস এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব।