ট্র্যাজেডিমূলক নাটক রচনায় নাট্যকার শেকসপিয়রের অবদান নির্ণয় করো।

শেকসপিয়র তাঁর দীর্ঘদিনের সাধনার ফলে জীবনের গভীর রহস্যগুলি উপলব্ধি করতে শিখেছিলেন। ট্র্যাজেডি মূলত বিয়োগন্তক পরিণতি হলেও তাঁর পরিণত বয়সের এই ফসল পাঠকেরা এর মধ্যে নৈরাশ্যের সুরের বদলে মনুষ্যত্বের সুর শুনতে পান। গ্রিক ট্র্যাজেডিতে মানুষ ছিল ভাগ্যের হাতের পুতুল। কিন্তু শেকসপিয়র-এর ট্র্যাজেডিতে নায়কেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের ভাগ্য নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। নায়কেরা উচ্চ বংশজাত, কারণ তাঁদের জীবন এবং মৃত্যু সমগ্র রাষ্ট্র বা সমাজকে প্রভাবিত করে। নায়কেরা হয়তো সবসময় দেবচরিত্র নয়, কিন্তু তবু তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যে সুপ্ত বা প্রকাশিত মহত্ত্বের বীজ রয়েছে। তাঁর নায়কেরা কোথাও কোথাও অদৃষ্টের কাছে মার খেয়েছেন সত্য, কিন্তু তবু তাঁরা অদৃষ্টবাদের চেয়ে পুরুষকারে বিশ্বাসী। মূলত শেকসপিয়র মধ্যযুগীয় মনীষীদের কাছ থেকে একটি সুশৃংখল বিশ্বচেতনা লাভ করেছিলেন। সেই বিশ্বের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ, সে মানুষ ঈশ্বরাভিমুখী। তাঁর চিরন্তন নীতিবোধ ও বিরুদ্ধ শক্তির বিকৃত রুচির দোটানায় পড়ে তিনি যখন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন তখন রচিত হয় তাঁর বিখ্যাত ট্র্যাজেডিগুলি।


ট্র্যাজেডিসমূহ :

(১) টাইটাস অ্যান্ড্রোনিকাস (1595) : হত্যা, পালটা হত্যা, বীভৎস হিংসার দ্বারা এই নাটকের অবয়ব গঠিত। রোমান সেনাধ্যক্ষ টাইটাস এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। গথদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে বাদী এবং প্রতিবাদী দুই পক্ষের পুত্রদের নৃশংস হত্যার পর, টাইটাস লজ্জার হাত থেকে নিজ কন্যা ল্যাভিসিয়াকে নিজেই হত্যা করেন। এইভাবে এক ভয়ানক রক্তস্নান শেষ করে টাইটাস। মূলত এই শ্বাসরোধকারী আবেগ মথন ট্র্যাজেডির মূল লক্ষণ হয়ে দাঁড়ায়।


(২) রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট (1594) : নিয়তি লাঞ্ছিত রোমান্টিক প্রেমের কাহিনি এ নাটকের মূল উপজীব্য। ভেরোনা শহরের দুই চিরশত্রু পরিবার হল মন্টেগু ও ক্যাপুলেট। মন্টেগু পরিবারের তরুণ রোমিও ও ক্যাপুলেট কন্যা জুলিয়েট প্রথমে প্রেমে পড়ে এবং পরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু দুই পরিবারের শত্রুতার ফলে তাদের বিবাহ সার্থক হয় না। তাদের অকালে প্রাণ বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে উভয় পরিবারের শত্রুতার অবসান ঘটে। ঘটনাচক্রে দুটি তরুণ প্রাণের অকৃত্রিম ও অপ্রেমের প্রেমের করুণ পরিণতি নিয়ে এই নাটক।


(৩) হ্যামলেট (1601) : ডেনমার্কের যুবরাজ তরুণ হ্যামলেট তাঁর পিতৃহন্তারক খুল্লতাত ক্লডিয়াস এবং বিশ্বাসঘাতিনী মাতা গারট্রডের উপযুক্ত শাস্তি বিধানে যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ঘটে তা এ নাটকের মূল উপজীব্য। অবশেষে হ্যামলেট ক্লডিয়াস ও গারট্রডের আকস্মিক ছুরিকাঘাত ও বিষপানে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ নাটকের পরিসমাপ্তি ঘোষিত হয়। সিংক্ষণ লিপ্সা, চক্রান্ত, হত্যা, প্রতিহিংসা, অপ্রকৃতিস্থতা, অবৈধ প্রেমসম্পর্ক, প্রেতের উপস্থিতি, নায়ক চরিত্রের তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব সব মিলিয়ে অত্যন্ত জটিল শেকসপিয়রের এই বহু বিতর্কিত ট্র্যাজেডির এই নাট্যকাহিনি।


(8) ওথেলো (1604) : প্রেম, ঈর্ষা, ও ভাগ্যবিড়ম্বনার এক চিরস্মরণীয় কাহিনি এই ট্র্যাজেডির বিষয়বস্তু। কৃষ্ণকায় বীর সেনানায়ক ওথেলোকে স্বামীত্বে বরণ করেছিল সুন্দরী তরুণী দেসদিমোনা। কিন্তু উভয়ের দাম্পত্য সুখের মধ্যে সর্বনাশের ঝড় আনলে প্রতিপক্ষ ইয়াগো। তাঁরই প্ররোচনায় একদা দেসদিমোনাকে কলঙ্কিনী রূপে সন্দেহ করে ওথেলো নিজ হাতে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। মূলত ওথেলো রোমান্টিক প্রেমিক যে ইয়াগোর প্ররোচনায় বিসর্জন দিয়ে বসে তার বিচার ক্ষমতা। দেসদিমোনা সারল্য ও সৌন্দর্য্যের প্রতিমূর্তি, তাই তার অকারণ মৃত্যুতে ঘটে যায় এ নাটকের চরম পরিণতি।


(৫) কিং লিয়ার (1605): অশীতিপর রাজা লীয়ারের ট্র্যাজেডি অশাসিত আবেগ ও অদূরদর্শিতা প্রসূত। ভাগ্য বিড়াম্বিত অপুত্রক রাজা লিয়ার তাঁর তিন কন্যা গনেরিল, বেগম ও কনিষ্ঠা কার্ডেলিয়াকে রাজত্ব ভাগ বাঁটোয়ারা করতে গিয়ে যে চরম দুর্দশায় কবলিত হয়েছিল এ নাটক তারই উপজীব্য, অবশেষে অন্যান্য কন্যা ও জামাতার ষড়যন্ত্রে প্রিয়তমা কনিষ্ঠা কন্যাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হলে তার প্রাণহীন দেহ নিয়ে হাহাকারে ফেটে পড়েন রাজা লিয়ার। তীব্র মনোবেদনায় মৃত্যু হয় তাঁর। ঐশ্বর্য ও রাজগরিমার দম্ভ কীভাবে লীয়ারকে পতনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল তা শেকসপিয়রের সর্বকালীন ট্র্যাজেডি রূপেই আখ্যা পেল।


(৬) ম্যাকবেথ (1606) : অমিতবীর্য সেনানায়ক ম্যাকবেথের নির্মম ঘাতকে রূপান্তরিত হওয়ার এক অসামান্য ট্র্যাজেডি। নিজের দুরন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অতিপ্রাকৃত শক্তির সমর্থন এবং পত্নী লেডি ম্যাকবেথের প্ররোচনা কীভাবে এক সর্বজনবন্দিত বীর সামন্ত নায়ককে পরিণত করল সর্বজননিন্দিত, চক্রান্তকারী রক্তলোলুপ শাসকে এটি তারই নাট্যায়ন। অন্যায় উচ্চাশার বশবর্তী হয়ে যে আকাশচুম্বী ব্যক্তিত্ব তা থেকে উৎসারিত ভয়ভীতিকে কণ্ঠরুদ্ধ করে তার শোচনীয় বেদনা ও করুণ পরিণতি এ নাটককে উত্তীর্ণ করে এক প্রগাঢ় বিশ্ববিক্ষার স্তরে।


(৭) অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা (1606-07) : রানি ক্লিওপেট্রার সম্মোহক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট জগদ্বিখ্যাত রোমক বীর মার্ক অ্যান্টানির মর্মান্তিক পরিণতি এ নাটকের বিষয়বস্তু। ক্লিওপেট্রার প্রতি আসক্তিবশত সমাজ সংস্কার, রাজ্য শাসন সমস্ত কিছুই যখন অ্যান্টনি ভুলতে বসেছে তখন অ্যাকটিয়ামের যুদ্ধে মিশরীয় নৌবহরের কাছে পরাস্ত হয় অ্যান্টনি। ভুলক্রমে ক্লিওপেট্রার মৃত্যু সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছলে নিজ তরবারিতে বিদ্ধ হয় অ্যান্টনি, ক্লিওপেট্রার বাহু বন্ধনেই অ্যান্টনির মৃত্যু হয়। ক্লিওপেট্রাও মৃত প্রেমিকের অনুসরণে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এই হল এ নাটকের করুণ পরিণতি। গোত্রের বিচারে শেকসপিয়রের এটি প্রধান ট্র্যাজেডি।


বৈশিষ্ট্য :

  • (১) শেকসপিয়রের নায়ক-নায়িকারা সকলেই খ্যাতিমান ও অভিজাত । 

  • (২) ট্র্যাজেডি রচনায় তিনি শেকসপিয়র নির্দেশ মানেননি।

  • (৩) নাট্যদ্বন্দ্ব নাটকের বিশেষত তাঁর ট্র্যাজেডির প্রাণ।

  • (৪) পেশাদার বিদষক ও বিদূষকধর্মী অন্যান্য চরিত্র শেকসপিয়রের নাট্য সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। 

  • (৫) সর্বোপরি, ভাষাতাত্ত্বিকদের নিরন্তর গবেষণার বিষয় শেকসপিয়রের ভাষাশৈলী, ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় শেকসপিয়রের ট্র্যাজেডি পাঠে।


জীবন দেবতার সার্থক পূজারি শেকসপিয়র জীবনের পূতিগন্ধময় দিককে যেরূপ সহজ শান্ত মনে নিয়েছিলেন, জীবনের শুভ্র সুরভিত দিক থেকেও নিজেকে বঞ্চিত করেননি। মানুষের জীবনের মেঘ আছে, ঝঞ্ঝা আছে, সেই সঙ্গে ইন্দ্রধনু ও সূর্যকিরণের সমারোহ দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর মায়ামুকুরে মানুষের বিরাট সত্তার প্রতিবিম্ব ধরা দিয়েছে, তাই শেকসপিয়র সর্বযুগের সকল দেশের নাট্যকার। তাঁর মৃত্যুর পর তিনশো বছর কেটে গেল। এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রে কত সংঘাত দেখা দিল। মানুষের চিন্তায়, সমাজে, সাহিত্যে রাজনীতিতে কত বিরাট পরিবর্তন দেখা দিল কিন্তু শেকসপিয়র এখনো উত্তুঙ্গ হিমাচলের মতো চিরজীবীর জয়টীকা পরে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছেন।