‘টিনের তলোয়ার' তাৎপর্য [মান—১০ নম্বর, শব্দ সংখ্যা – ১০০টি ]

১। “কলকাতার গরিবদের বিষ্ঠা বাবুর গায়ে দিলাম।”

উঃ নাট্যকার উৎপল দত্তের 'টিনের তলোয়ার' নাটকের প্রথমাংশে বেণীমাধবকে লক্ষ্য করে মেথর মথুর এই কথা বলেছে।

দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার নতুন নাটক—'ময়ূরবাহনের রিহার্সাল পর্ব শেষ, এবং মঞ্চস্থ হতে চলেছে। তারই উপলক্ষ্যে দলের নির্দেশক ও অভিনেতা বেণীমাধব তার দলের জনাকয়েককে নিয়ে ভোর না হতেই এসেছে যাত্রার পোস্টার সাঁটতে রাস্তায় রাস্তায়। সবাই মদের ঘোরে বেসামাল। এই সময় রাস্তার এক ম্যানহোল থেকে এক মেথর ময়লা তুলতে ব্যস্ত। প্রায় ইচ্ছা করেই সে বালতি ভর্তি ময়লা বেণীমাধবের পায়ের ওপর ঢেলে দেয়। বেণীমাধব চমকে উঠলে মেথর মাপ চেয়ে নিয়ে উক্ত কথাগুলি বলেছে। এ কথাগুলির মধ্যে একথাই প্রমাণ করে বেণীমাধব যে সমাজের বাবু তাতে মেথরের সঙ্গে তাদের ব্যবধান খোঁজা দুরূহ। অবশ্য বেণীমাধবও এই নিয়ে তেমন বিবাদ বিসম্বাদে অবতীর্ণ হয়নি।


২। “দুই বৎসর হয়, আমাদের সকলকে শোক সাগরে নিমজ্জিত করে তিনি মহাপ্রয়াণ করেছেন।” 

উঃ এই শ্রেণির প্রতিটি প্রশ্নের প্রথমে পূর্বোক্ত নাটকের ও নাট্যকারের নাম দিয়ে তবে উত্তর লিখতে শুরু করবে। এ উক্তি বেণীমাধবের। নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন সম্পর্কে এমন কথা বলা হয়েছে। মেথর প্রায় ইচ্ছা করেই ম্যানহোল থেকে নোংরা তুলে বেণীমাধবের পায়ের ওপর ফেললেও তিনি রাগেননি, কারণ নতুন নাটক নিয়ে এখন মশগুল। এসব ভাববার তাঁর সময় নেই। মেথরকে জিজ্ঞাসা করেন সে নাটক দেখেন কিনা? যখন শুনলেন সে নাটক সম্পর্কে কিছু বোঝেন না, অতঃপর বেণীমাধব মাইকেল মধুসূদন সম্পর্কে জানতে চাইলে মেথর বেমালুম বলে ফেলে সে মাইকেলকে চেনে না জানে না। এরই প্রত্যুত্তরে বেণীমাধব উক্ত কথাগুলি বলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ‘মেঘনাদবধ' কাব্য থেকে কয়েক ছত্র পাঠ করেও শোনাতে ভোলেন না। এও বলেন তিনি বেঙ্গল অপেরার ক্যাপ্তেনবাবু অর্থাৎ মাস্টার। এমনিভাবে বেণীমাধব মেথরের নিকট আত্মপ্রচার চালায়।


৩। “বামুন আর বাবু, দুই ভাঙা চণ্ডী।” 

উঃ এ উক্তি মেথরের, বেণীমাধবের প্রতি।

ভোরবেলা নতুন যাত্রাপালা 'ময়ূরবাহন' নাটকের পোস্টার সাঁটতে এসে বেণীমাধব এক মেথরের সম্মুখীন হন পথের মাঝে। বেণীমাধব যত বড়ো মাপের অভিনেতা হোক না কেন, মেথরের নিকট তাঁর কোনো দাম নেই, তাইতো ম্যানহোল থেকে নোংরা বালতি করে তুলে তাঁর পায়ের ওপর ঢেলে দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না। শুধু তাই নয় বেণীমাধব নিজেকে বাংলার গ্যারিক এবং বেঙ্গল অপেরার ক্যাপ্তেনবাবু রূপে আখ্যাত করলেও মেথর তাঁকে কোনো গুরুত্বই দেয় না। এমনকি যখন শুনল বেণী চাটুয্যে বামুন, তখন আরও এক বালতি নোংরা তাঁর পায়ের উপর ঢেলে দিয়ে বলে—'বামুন বলে আর একটু দিলাম। কারণ বামুন তার নিকট ভাঙামঙ্গল চণ্ডীর সমান, সমাজের চোখে তারা উচ্চ বংশজাত রূপে আখ্যাত হলেও নিচু জাত মেথরের নিকট তাদের কোনো দামই নেই। তারা যে খেটে খেকো মানুষ, বড়ো কিছু ভাববার অবকাশ তাদের কোথায়?


৪। “আমার জাত হচ্ছে থিয়েটারওয়ালা, অভিনয় বেচে খাই।” 

উঃ এ উক্তি বেণীমাধবের।

গ্রেট বেঙ্গল অপেরার ক্যাপটেনবাবু বেণীমাধব নতুন পালা ময়ূরবাহন নাটকের পোস্টার সাঁটতে এসে ভোরেরবেলা ম্যানহোল পরিষ্কারের কাজে ব্যাপৃত মেথরের সঙ্গে দেখা। নানান কথাবার্তার ফাঁকে বেনিমাধব নিজের পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি, মেথর সমস্ত পরিচয় জেনেও দু'দুবার ম্যানহোল থেকে নোংরা বিষ্ঠা বালতি করে তুলে বেণীমাধবের পায়ের ওপর ফেলে দেয়। বেণীমাধব অবশ্য তাতে বিব্রতবোধ করেন না। অকপটে নিজের নাট্যাভিনয় সম্পর্কে বিস্তর বলে যান, মেথর তাঁকে বামুনের ছেলের সঙ্গে ভাঙা চণ্ডীর তুলনা করে হোয় প্রতিপন্ন করলেও বেণীমাধব ক্ষণিকের তরেও রুষ্ট হয় না, বরং আরও নিবিড়ভাবে মেথরের সঙ্গে আলাপ জমাতে সমর্থ হয়। অবশেষে মেথরের কৌতুক ভাঙাতে বেণী স্বীকারও করেন তিনি শুধু বামন হয়েই গঠিত নয়। তাঁর আসল জাত থিয়েটারওয়ালা রূপে, অর্থাৎ অভিনয় বেচে খাওয়া তাঁর নেশা মাত্র।


৫। “এত নেকাপড়া করে টিনের তলোয়ার বেঁধে ছেলেমানুষী করা কেন?”

উঃ উক্তিটি মেথরের। গ্রি গ্রেট বেঙ্গল অপেরায় নতুন পালা ‘ময়ূরবাহন' নাটক ধরা হয়েছে। তা নিয়ে পোস্টার সাঁটতে এসেছে অপেরার ক্যাপ্তেনবাবু। বেণীমাধবের সঙ্গে আলাপ হয়ে যায় ম্যানহোল পরিষ্কারে রত মেথরের। বেণীমাধব নিজের পরিচয় দিয়ে মেথরকে উত্তেজিত করতে চাইলেও সে কোনো আকর্ষণবোধই করে না। বরং বেণীকে হেয় প্রতিপন্ন করতে বিষ্ঠার বালতি নিয়ে বেণীর পানের ওপর উপুড় করে দেয়। একার্থে রং মেখে সং সেজে স্টেজের ওপর হেলে দুলে অভিনয় করাকে মেথরের মোটেই পছন্দের নয়। এর চেয়ে সে বাঈজির খেমটা নাচ, কিংবা বস্তিতে রামলীলা বেশি ভালোবাসে। কারণ তাদের যা গান বাজনা তার মধ্যে কোনোরকম বাবুদের বোয়াবিভাব নেই। লাল, নীল শাড়ি ছত্রি ইত্যাদি পরে রাজা উজির সাজাকে মেথর বড়ো ঘৃণা করে। অবশ্য সে যে শ্রেণির মানুষ, এই ভাবনাটা তার স্বাভাবিক। ফলত বেণীর আগ্রহকে অবদমিত করতে মেথর কোনোরকম কপটতার আশ্রয় না নিয়ে উক্ত কথাগুলি বলতে বাধ্য হয়েছিল।


৬। “এ কার কণ্ঠস্বর? এ স্বরের কলকল্লোলে অলিকুল উঠিল গুঞ্জরি....জগতে নামিল বসন্ত হরষে....।” 

উঃ এ উক্তি বেণীমাধবের, ময়নার সুরেলা কণ্ঠের গান শুনে। নতুনযাত্রা পালা ‘ময়ূরবাহন’ নাটকের পোস্টার মারতে এসে ভোরবেলা রাস্তার মাঝে বেণীর সঙ্গে এক মেথরের সাক্ষাৎ হয়ে যায়। যে মেথর সর্বদা বেণীর প্রাপ্য মর্যাদা না দিয়ে হোয় প্রতিপন্ন করতে ব্যস্ত। তথাপি দলের ক্যাপ্তেনবাবু বেণীমাধব ক্ষণিকের জন্য ও বিব্রতবোধ না করেও মেথরের সঙ্গে সাগ্রহে আলাপ জমিয়ে নেয়। কারণ তিনি শিল্পী মানুষ, কোনোরকম লজ্জা ঘৃণা ভয়, তাঁর মধ্যে থাকা উচিত নয়। সকল মানুষ সক্ষম তাঁর কাছে, প্রত্যেককে যথাযথ সম্মানে ভূষিত করাই হল আর্টের ধর্ম, মেথরের সঙ্গে আলাপ চলাকালীন হঠাৎ ময়নার কণ্ঠের সুরেলা সংগীত—‘ছেড়ে কলকাতা কেন হবো পগার পার....।” শুনে তিনি আত্মহারা হয়ে পড়েন, মর্মে মর্মে অনুভব করেন, ময়না অটুট প্রতিভার অধিকারিণী, তাই বিস্মিত কণ্ঠে তিনি উক্ত কথাগুলি বলেছেন।


৭। “কুঠার বৃথা কেন উৎকণ্ঠিত মন?.... কীসব লেখে আজকাল কোনো মানে হয় না।” 

উঃ গ্রেট বেঙ্গল অপেরার অন্যতম অভিনেতা যদুর এ উক্তি।

অপেরাতে জোর কদমে চলেছে ‘ময়ূরবাহন' নাটকের মহড়া । প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যের মহড়া চলাকালীন। এখন বিশ্রামের সময় সারা রাত্রি রিহার্সালের ফলে সবাই ক্লান্ত অবসন্ন কেউ কাগজ পড়ছে, কেউ নিদ্রা মগ্ন। যদু আপন মনে তার পার্ট পড়ছে। এক স্থানে সে আবিষ্কার করে লেখা আছে “কুঠার বৃথা কেন উৎকণ্ঠিত মন ?" এ বাক্যের কোনো অর্থ হয় না দেখে বিব্রত বোধ করলে অভিনেতা নটবর তার ভুল সংশোধন করে দেন—'কুমার, বৃথা কেন উৎকণ্ঠিত মন। অর্থাৎ হাতে লেখা যাত্রাপালার সংলাপগুলি বিস্তর ত্রুটিপূর্ণ। আর এই সামান্য ত্রুটির কারণে তার আমূল অর্থের পরিবর্তন ঘটে। এখানে গ্রেট বেঙ্গল অপেরার রিহার্সাল রুমে তেমনি এক দৃষ্টাস্তের নিদর্শন মেলে।


৮। "আজি কালি অভিনেতারা বেশ্যা সহযোগে জাতি ও ধর্মের যে অচিন্ত্যপূর্ব ক্ষতি করিতেছেন তাহা স্মরণ করিলে শয্যাকন্টকী হয়।”

উঃ কোনো এক নামকরা খবরের কাগজের এই বিবৃতি। বেঙ্গল অপরাতে রমণীর ভূমিকায় রমণীকে নিয়োজিত করার ফলে সমগ্র কলকাতা জুড়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। তাই কোনো এক দৈনিক পত্রিকাতে ‘বেঙ্গল অপেরার বেশ্যার নাচ' হেডলাইন দিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। স্মরণীয়, পূর্বে থিয়েটারে রমণীর ভূমিকায় পুরুষরা অভিনয় করত। মাহামান্য গিরিশ ঘোষের আমল থেকে সর্বপ্রথম থিয়েটারে রমণীকে আনা শুরু হয়, এবং তা রামবাগান, সোনাগাছি রূপাগাছি প্রভৃতি বেশ্যালয় থেকে। বিনোদিনী তার দৃষ্টান্ত, কোনো ভদ্রঘরের মহিলা বদনামের ভয়ে থিয়েটারে নাম লেখাতো না, সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে চিৎপুরের দলগুলিতে পতিতা পল্লির মেয়েরা এসে ভিড় জমাতে শুরু করে। রক্ষণশীল সমাজের মানুষরা এটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। এর বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদে নেমে পড়ে। প্রথমে পত্রিক র মাধ্যমে তারা জনগণকে এর কুফল সম্পর্কে বোঝাতে সচেষ্ট হয়। তারই একটা দৃষ্টান্ত রিহার্সাল রুমে অভিনেতা জলদ সবাইকে পড়ে শোনাচ্ছে।


৯। “জানো তুমি মনোলোভা প্রকৃতির শোভাদানে আভা হৃদয়ে আমার।” 

উঃ এটি যাত্রাপালার একটি সংলাপ, জলদ মুখস্থ করছে রিহাসাল রুমে বসে।

দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরায় নতুন পালা ধরা হয়েছে ‘ময়ূরবাহন'। তার জন্য চারিদিকে পোস্টার কাজ প্রায় সমাপ্ত। এখন জোর কদমে শুধু মহড়া চলছে। দলের অন্যতম অভিনেত্রী, বসুন্ধরা যে প্রথম জীবনে ছিল বেশ্যা, এখন পাকা অভিনেত্রী তারই ওপর বর্তেছে সমস্ত দলের লোকেদের রান্নার দায় ভার। রান্নার কাজ সমাপ্ত করে যখন খাওয়ার জন্য সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছে, তখন দলের অন্যতম অভিনেতা জলদ নিজে পার্ট মুখস্থ করায় ব্যস্ত, সে বসুন্ধরাণ আহ্বানে সাড়া না দিয়ে অনবরত নাটকের সংলাপ বলে যায়, বসুন্ধরার কথায় কোনো কর্ণপাত করে না। এমনকি সে নটবরকেও ছাড়তে চায় না। বসুন্ধরা বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলে—“জলদবাবু, মহলা দিতে হলে ওপরে যা না, পাঁচ ভূতের মধ্যে কী করে হয়?” আসলে এইরকম পরিবেশ সৃষ্টি করে প্রাজ্ঞবান নাট্যকার বোঝাতে চেয়েছে প্রত্যেকটি থিয়েটার দলের পরিবেশ পরিস্থিতি এমনই।


১০। “তুমি শেষকালে যুবরাজ ময়ূরবাহনকে নাগা সন্নিসি করে এণ্টেজে পাঠাবে।” 

উঃ এ উক্তি জলদবাবুর।

গ্রেট বেঙ্গল অপেরার অন্যতম অভিনেত্রী বসুন্ধরা হলেও দলের সমস্ত লোকের রান্না করে খাওয়ানোর দায়িত্ব তারই ওপর ন্যস্ত। এককথায় সেইই দলের কর্তৃক স্বরূপ। কিন্তু সম্প্রতি গ্রেট বেঙ্গল দলের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না, অভাবের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, নতুন পালা, ময়ূরবাহনের নাটক যদি ভালো হয় তবেই তাদের অবস্থা ফিরবে। তারই প্রচেষ্টায় অভিনেতারা কোমর বেঁধে নেমেছে। একতিলও ফুরুসৎ নেই সবই যেযার পার্ট মুখস্থতে রত। জলদও তাই। জলদ নিজেই সাজবে কাশ্মীরী যুবরাজ ময়ূরবাহন। তবে নিষ্ঠার সীমা নেই। এমন সময় মহলা কক্ষে বসুন্ধরা এসে জানায়—“ঘরে একটা পয়সা নেই। বেচবার মতন আর বিশেষ কিছু নেই....।” এ উদ্ভিতে বিব্রত হয়ে জলদ উক্ত কথাগুলি বলে স্পষ্ট করেছিল গ্রেট বেঙ্গল অপেরার বর্তমান অবস্থা কী?


১১। “এইতো শ্মশান, মানবের চরম বিশ্রাম স্থান। কত জীব তাসে, পুনঃপুনঃ পশে অসীম অনন্ত কালগ্রাসে।” 

উঃ জ্বলদের কণ্ঠে এই বাক্য উচ্চারিত হয়।

দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরা অত্যন্ত দুর্দশার মধ্য দিয়ে কালযাপন করছে। প্রায় দেনা করেই খেতে হচ্ছে। যাবতীয় রান্নার দায়িত্ব বর্তেছে বসুন্ধরার ওপর তাই তার দুশ্চিন্তার সীমা নেই। নতুন নাটকের সংলাপ নিয়ে জলদ নটবর যখন মহলা কক্ষে মুখস্থ করতে ব্যস্ত, তখনই দুর্দশার কথা তাদের শোনাতে বসুন্ধরার আগমন ঘটে। কিন্তু তাতেও নটবরের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এর দলে নাট্যকার রূপে অবতীর্ণ হতে, প্রিয়নাথ সেনের আবির্ভাব ঘটে ক্যাপ্তেনবাবু বেণীমাধবের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে, তথাপি জলদের বিভোরতা কাটে না। আপন মনে যুবরাজের সংলাপ আওড়ে যায়। উক্ত সংলাপটি তারই নিদর্শন। আসলে সংলাপটি বিশেষ তাৎপর্যময়। ঊনবিংশ শতকের উদীয়মান থিয়েটার দলের কর্মীদের জীবন ছিল সংলাপটির অনুরূপ। বোধকরি যথাস্থানে লেখক সংলাপটি দিয়ে মূল উদ্দেশ্য সাধনে জয়ী হয়েছেন।


১২। “আপনার সামনে বাংলার শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী পুণ্যশ্লোক অর্ধেন্দু শেখরের শিষ্যা বসুন্ধরা দেবী।” 

উঃ এ উক্তি জলদের, কোনো এক মুদির প্রতি।

দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার দীর্ঘদিন অভিনয় বন্ধ। কাজেই তাদের প্রচণ্ড আর্থিক দুর্গতির মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করতে হচ্ছে। নতুন নাটক ময়ূরবাহন পালা ভালোভাবে মঞ্চস্থ হলে তবেই তাদের অবস্থা ফিরবে। কিন্তু বর্তমানের দুরবস্থাকে কাটিয়ে ওঠা দুরূহ হয়ে উঠল। দলের অভিনেত্রী বসুন্ধরা কর্তী স্বরূপ। সকলের রান্না-বান্নার দায়ভার তার ওপর ন্যস্ত। কাজেই তাকেই ছুটতে হয় দোকান থেকে বাকি করে চাল ডাল নিয়ে এসে সবার মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য। দোকানে প্রচুর বাকি পড়েছে। চেয়ে ও না পেয়ে স্বয়ং মুদী মহড়া রুমে এসে বসুন্ধরাকে বেশ্যা বলে গালাগালি শুরু করলে জলদ এমনভাবে বসুন্ধরার অতীত ইতিহাস ব্যক্ত করে। কিন্তু মুদির তাতে কিছু আসে যায় না। আঙুর বেশ্যা থেকে সে আজ যতই শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী বসুন্ধরাতে পরিণত হোক না কেন তার পাওনাগণ্ডা মিটলেই হল।


১৩। পয়সা না থাকলে ক্ষুধা কি থাকবে না? ....রাতের পর রাত আমরা গান করি—খেতে হবে না ? 

উঃ এ উক্তি বসুন্ধরার, মুদির প্রতি। যতই আর্থিক দুরবস্থা থাকুক পেটের অন্ন যথা সময়ে— জোগান দিতেই হবে প্রত্যেক মানুষকে। গ্রেট বেঙ্গল অপেরার তেমনি আর্থিক দুর্গতি গাঢ়ভাবে ঘনীভূত হলে নারীত্বে পূর্ণ প্রতিমূর্তি অভিনেত্রী বসুন্ধরা তা লাঘব করতে সবার দায়ভার নিজে কাঁধে তুলে নিয়ে মুদির দোকান থেকে চাল ডাল বাকি করে এনে সবার মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলতে পারে? টাকা চেয়ে ও না পেয়ে মুদি স্বয়ং রিহার্সাল রুমে চড়াও হয়ে যখন বসুন্ধুরাকে কসবী, বেশ্যা বলে গালিগালাজ করতে থাকে তা শুনে জলদ উত্যক্ত হলেও বসুন্ধরা তা নীরবে মুখ বুজে সহ্য করে। বরং মাতৃত্বের স্নেহমাখা সুর কণ্ঠে এনে সে মুদিকে উক্ত কথাগুলি বলে প্রমাণ করল তারা শুধু বেশ্যা বা অভিনেত্রী বলে একেবারে সমাজের ঘৃণ্য কৃমিকীটের অধম নয়, তারাও আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো।


১৪। “এই তো দেশের অবস্থা। দেশের শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী একটা নিরক্ষর মুদির কাছে হাত জোড় করছে।”

উঃ এ উক্তি জলদের। 

ঊনবিংশ শতকের পাদলগ্নে কলকাতার চিৎপুর রাজাবাজার অঞ্চলে সে কয়টি থিয়েটার দল চরম দুরবস্থার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠতে সমর্থ হয়েছিল আলোচ্য গ্রেট বেঙ্গল অপেরা তারই প্রতিরূপ। অর্থের অভাবে ভালোভাবে দল চালানো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তবুও নতুন পালার মহড়ার বিরাম নেই। দলের অভিনেত্রী বসুন্ধরা মাতৃত্বের পূর্ণ প্রতিমূর্তি সকল দুর্দশা মাথায় নিয়ে মুদির দোকান থেকে যাবতীয় আহার্য বাকি করে এনে সবার মুখে আহার জোগাতে থাকে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হতেই মুদি নিজেই তাগাদা করতে এসে বসুন্ধরাকে যার পর নাই বেশ্যা কসবী গালাগালি করলেও ক্ষণিকের জন্য বসুন্ধরা ক্রুদ্ধ না হয়ে মুদির রোষকে প্রশমিত করতে হাত জোড় করে আরও কিছুদিন সময় ভিক্ষা করে। এই দৃশ্য দেখে অভিনেতা জলদ উক্ত কথাগুলি বলে প্রমাণ করতে চাইল কীরূপ দুরবস্থার মধ্য দিয়ে তাদের দল চালিয়ে যেতে হচ্ছে।


১৫। “এ কাপ্তেনবাবু শালা মিথ্যেবাদী। আমাকে বললে থিয়েটারে রানি করে দেবে। আর এখন হাঁকিয়ে দিচ্ছে দেখ।”

উঃ এ উক্তি ময়নার। বেণীমাধবের প্রতি।

ভোরেই দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার নতুন নাটক ময়ূরবাহনের পোস্টার মারতে বেরিয়েছিলেন দলের কাপ্তেনবাবু, বেণীমাধব সেখানে রাস্তার মাঝে এক মেথরের সঙ্গে কথাবার্তা চলাকালীন বেণীমাধব শুনতে পান এক সুরেলা নারীকণ্ঠের গান। তিনি ক্ষণিকের জন্য মোহিত হয়ে যান। সুদক্ষ অভিনেতা ও নির্দেশক বেণীর দৃষ্টি এড়ায়নি এই সুরেলা কণ্ঠের অধিকারিণী অটুট প্রতিভাময়ী। একে দিয়ে আগামী দিনে দলের শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রীর কাজ চালিয়ে নেওয়া দুরূহ নয় জেনে তিনি ময়নার পরিচয় নিয়ে তাকে গ্রেট বেঙ্গল অপরায় এসে দেখা করতে বলেন। তাই বাজারওয়ালী অভিনেত্রী হতে ময়না এসেছে বেণীর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু বেণী তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন, জাগরণে ময়নাকে চিনতে পারে না। এমনই এক অবস্থায় তাড়িয়ে দিতে চাইলে ময়না উক্ত কথাগুলি বেণীকে লক্ষ্য করে বলেছিল।


১৬। “এটা থিয়েটার” রাগ লজ্জা ভয় তিন থাকতে নয়।”

উঃ উক্তিটি ক্যাপ্টেনবাবু বেণীমাধবের। দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার নতুন পালা ‘ময়ূরবাহন' নাটকের পোস্টার মারতে গিয়ে বেণীমাধবের সঙ্গে আলাপ হয়ে যায় বেগুনওয়ালী ময়নার সঙ্গে। ময়নার সুরেলা কণ্ঠস্বর বেণীকে মুগ্ধ করে। জুহুরি আসল সোনাকে চিনতে ভুল করে না। সুদক্ষ অভিনেতা নির্দেশক বেণীমাধবও ভুল করেনি ময়নাকে চিনতে, আগামীদিনে ওকে বড়ো অভিনেত্রী করবে এই আশায় ময়নাকে অপেরার ঘরে এসে দেখা করতে বলে। ময়নাও কথা রেখেছে। প্রথমে ময়নাকে না চিনতে পারলেও বেণী পরে চিনতে ভুল করেনি। তারই নির্দেশে ময়নার অপরিচ্ছন্ন পোষাক ত্যাগ করে ভদ্রস্থ পোশাক পরতে যখন স্নান ঘরে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়, তখন ময়না লজ্জাবশত চিত্তে বলেছিল—“অন্য লোক চান করালে আমার লজ্জা করবে।” কিন্তু অভিনয় জায়গাটা আলাদা। লজ্জা ভয় থাকলে এখানে কিছু করা যাবে না, সেকথা স্মরণ করাতে বেণীমাধব এই কথাগুলি বলেছেন।


১৭। “ওই ভিখিরিটা হবে আমার হিরোইন ?” 

উঃ উক্তিটা অভিনেতা জলদের, ময়নাকে লক্ষ্য করে।

ময়নার প্রতিভাগুণে প্রমুগ্ধ হয়ে দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার ক্যাপ্তেনবাবু বেণীমাধব ভোরবেলা নতুন নাটকের পোস্টার সাঁটতে গিয়ে ফেরার সময় ময়নাকে অপেরার ঘরে এসে দেখা করতে বলে। ঘৃণিতা জীবন থেকে উত্তরণের স্বপ্ন নিয়ে ময়নার আগমন ঘটে বেণীমাধবের কাছে। কিন্তু বেগুনওয়ালী ময়নার অপরিচ্ছন্ন সাজ পোষাক দলের সবাইকে চমকিত করে, কিন্তু বেণীমাধব চমকিত না হয়ে কামিনীকে নির্দেশ দেয় অবিলম্বে স্নান ঘরে নিয়ে গিয়ে ময়নাকে যেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয় এবং সাথে সাথে ঘোষণাও করে দেয় ময়না হবে নতুন পালা অর্থাৎ ময়ূরবাহন নাটকের নায়িকা। আগে থেকেই ঠিক ছিল নায়ক হবে জলদ, সংলাপও মুখস্থ করতে শুরু করে দিয়েছিল। সে অবাক না হয়ে পারে না, ময়নার মতো হত দরিদ্র রমণী হবে তার নায়িকা। সেই বিস্ময়ের অভিপ্রকাশ হল উক্ত কথাটি।


১৮। “আমি শিক্ষক। আমি স্রষ্টা, আমি তাল তাল মাটি দিয়ে জীবন্ত প্রতিমা গড়ি। 

উঃ উক্তিটি বেণীমাধবের।

বেণীমাধবের আহ্বানে বাজারের বেগুনওয়ালী ময়না যখন অভিনেত্রী হতে গ্রেট বেঙ্গল অপেরার ঘরে পদার্পণ করে তখন তাকে দেখে ঘরের সকল অভিনেতা অভিনেত্রী বিস্মিত না হয়ে পারেনি। এ যাবৎ যে সকল অভিনেত্রী এসেছে তারা সবাই পতিতালয়ের হলেও রুচিসম্মত পোষকে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, কিন্তু ময়নার সারা শরীর জুড়ে হত দারিদ্র্যের ছাপ সুস্পষ্ট, কেউই চায় না ময়না অভিনয়তে নাম লিখুক। কিন্তু দলের ক্যাপ্তেনবাবু সুদক্ষ অভিনেতা বেণীমাধব বুঝেছিল চিনেছিল ময়নাকে দিয়ে অবশ্যই হবে। তাই অবিলম্বে তাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোষাকে বিরাজ করতে কামিনী স্নান ঘরে পাঠালে দলের মধ্যে থেকে কেউ কেউ এ সম্পর্কে মৃদু প্রতিবাদ জানালে সোৎসাহে বেণীমাধব জানিয়ে দেয় ময়নার যাবতীয় দায়ভার তারই। সেই তাকে অভিনয় শিখিয়ে নেবে, এমনই পরিপ্রেক্ষিতে বেণী উক্ত কথাগুলি বলেছিল।


১৯। “মহাশয় বাংলার গ্যারিককে নাটক শেখাবেন? মহাশয় কি বাংলার শেক্ষপীর ?” 

উঃ উক্তিটি বেণীমাধবের, প্রিয়নাথের প্রতি।

নবীন উদীয়মান নাট্যকার প্রিয়নাথ সেনের আবির্ভাব ঘটে দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার ক্যাপ্তেনবাবু বেণীমাধবের নিকট। উদ্দেশ্য তার নতুন নাটক অপেরাতে ধরাতেন এবং নতুন কায়দায় এই দলের অভিনেতাদের অভিনয় শিক্ষাদান করবেন। কারণ, তিনি অভিনয় শিখেছেন হিন্দু কলেজের ক্যাপটেন পেন্ডেল বেরির কাছে। কিন্তু ইতিপূর্বে বেণীমাধব তাঁর অভিনয় গুণে জনসমক্ষে নিজের গ্রহণ যোগ্যতা অর্জন করেছেন। এমনকি ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা তাঁকে বাংলার গ্যারিকরূপে আখ্যাত করেছেন। এহেন অভিনেতাকে অভিনয় শিক্ষা দান করা কতখানি মূর্খামি তর স্মরণ করাতে বেণীমাধব প্রিয়নাথকে এমন কথা বলেছেন। তবে প্রিয়নাথ আসলে চেয়েছিলেন গতানুগতিক নাটক ছেড়ে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করা। বেণীমাধব তা বুঝতে চাননি।


২০। “আমার নাটকটা ছিল পলাশীর যুদ্ধ, ব্রিটিশ দস্যু জালিয়াৎ ক্লাইভের মুখোশ উন্মোচন।”

উঃ উক্তিটি প্রিয়নাথ সেনের।

পূর্বে গ্রেট বেঙ্গল অপেরার প্রিয়নাথের একদিন আগমন ঘটেছিল তার পলাশীর যুদ্ধ নাটকখানি নিয়ে। এ নাটকটি সে মঞ্চস্থ করাতে চায়। পুনরায় তার ওখানে আগমন ঘটেছে নাটকটির বর্তমান অবস্থা কী তা জানতে। কিন্তু ক্যাপ্তেনবাবু বেণীমাধব সে নাটকটি মঞ্চস্থ করাতে কোনোরূপ আগ্রহ প্রকাশ করেনি। কারণ স্বত্ত্বাধিকারী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ ইংরাজদের পা চাটা গোলামি করে। তারই দলে যদি কোনো ইংরাজ বিরোধী নাটক মঞ্চস্থ হয় তাহলে ইংরাজরা ক্ষেপে যেতে পারে এই অছিলায়। প্রথমে বেণীমাধব স্মরণ করতে পারেন প্রিয়নাথ কোনো নাটকটি নিয়ে গেছে। অতঃপর প্রিয়নাথ উক্ত কথাগুলি বলে বেণীকে স্মরণ করাতে সচেষ্ট হল। বিষয়টি স্মরণে এলে বেণীমাধব স্বীকার করে, ইংরাজ বিরোধিতাকে এড়িয়ে চলার জন্য মূলত প্রিয়নাথের পলাশীর যুদ্ধ নাটকখানি মঞ্চস্থ করা হয়নি।


২১। “তিন বৎসরাধিক কাল দেহের রক্ত জল করে ইতিহাসের স্থূল গ্রন্থাদি ঘেঁটে লিখলাম। সেটা আস্তাকুঁড়ে ফেলেছে.... " 

উঃ উক্তিটি উদীয়মান নাট্যকার প্রিয়নাথ সেনের।

একদা গ্রেট বেঙ্গল অপেরায় ক্যাপ্তেনবাবুর নিটক তাঁর আগমন ঘটেছিল নতুন লেখা নাটক পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে। সম্প্রতি তাঁর পুনরায় আগমন ঘটেছে নাটকটির বর্তমান অবস্থা জানতে। বেণীমাধর প্রথমে স্মরণে আনতে পারেনি, পরে প্রিয়নাথের বর্ণনা শুনে অকপটে স্বীকার করেন ইংরাজ বিরোধিতার কারণে সে নাটক মঞ্চস্থ করা হয়নি। কাজেই নাটকটির পাণ্ডুলিপিটির আশ্রয় হয়েছে আসুকুঁড়ে, এমনকি যেই খাতার পৃষ্ঠায় দলের লোকেরা মাঝে মধ্যে তেল মাখানো মুড়ি খেয়ে ফেলে দিয়েছে। এ কাহিনি একজন স্রষ্টার নিকট কতখানি মর্মান্তিক তা শুনলে শিহরিত হতে হয়। প্রিয়নাথও মর্মজ্বালায় পীড়িত হয়ে তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে খেদোরি করেন—উক্ত কথাগুলি দিয়ে। এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত তৎকালে লেখকদের অবস্থা কীরূপ ছিল, অবশ্য বর্তমানে বিজ্ঞানের লেখকদের অবস্থা বেশ ভালোর দিকেই।


২২। “এমন হীরের টুকরো ছেলে সায়েবদের কলেজে পাশ দিয়ে বেরিয়েছে....তাকে খেতে দেয় না।”

উঃ উক্তিটি অভিনেত্রী বসুন্ধরার।

সুপ্রতিষ্ঠিত নাট্যকার হওয়ার বাসনায় প্রিয়নাথ উন্মত্তের ন্যায় ঘরছেড়ে পথে নেমেছে। এসে আশ্রয় নিয়েছে গ্রেট বেঙ্গল অপরায়। ইতিপূর্বে তার একখানি নাটক ‘পলাশীর যুদ্ধ' এখানে দিয়ে গিয়েছিল। সেটি মঞ্চস্থ হবে কিনা জানতে এসে এবারে প্রিয়নাথ একেবারে হতবাক হয়ে গেছে। ক্যাপ্তেনবাবুর কথা মারফৎ জানতে পারে ইংরাজ বিরোধিতা থেকে সরে আসতে সে নাটকটি মঞ্চস্থ করা হয়নি, এবং এখন তার ঠাঁই হয়েছে আস্তাকুঁড়ে তেলমাখানো মুড়ির ঠোঙা হিসাবে। নিজের সৃষ্টির এমন অবস্থা অবগত হওয়ার পর প্রিয়নাথ মর্মে মর্মে বেশ ভেঙেই পড়েছিল। দীর্ঘ অনাহারে আবার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। দলে অভিনেত্রী কর্তীরূপী মাতৃস্বরূপা বসুন্ধরার তা দৃষ্টি এড়ায়নি। মর্মে ব্যথিত হয়ে প্রিয়নাথের মতো গুণধর ব্যক্তির প্রতি সহমর্মিতা পোষণ করতে উক্ত কথাগুলি বলেছে, এতে বসুন্ধরার মহত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।


২৩। "মদ খেয়ে পতিতা লইয়া বাগড়া বাগড়ি করিয়া তোমারা চিৎপুরকে নরক পঙ্কে নিমজ্জিত করেছ।”

উঃ এ উক্তি নদের চাঁদ বাচস্পতি মহাশয়ের। বাংলা থিয়েটারের সূচনা লগ্নে নারীর ভূমিকায় পুরুষরা অভিনয় করত। কিন্তু পরবর্তীকালে সময়ের বিবর্তনে মঞ্চে যথাযথ অভিনয় ফুটিয়ে তুলতে পতিতা পল্লি থেকে পতিতাদের এনে প্রথম অভিনেত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করতে নিয়োগ করা হয়। কারণ রক্ষণশীলা হিন্দু সমাজে কোনো মানুষ এই বিষয়কে ভালো চোখে দেখত না, কাজেই কোনো ভদ্র ঘরের রমণী এই কাজে এগিয়ে আসত না, অনুরূপভাবে গ্রেট বেঙ্গল অপেরায় আঙুর বেশ্যা বসুন্ধরা নাম নিয়ে অভিনয় করতে শুরু করে এরই পথ ধরে বেগুনওয়ালী ময়না বেণীমাধবের নির্দেশে এসে অভিনয়ে যোগ দেয়। চিৎপুরের আশেপাশের লোক এই বেলেল্লাপনাকে মেনে নিতে না পেরে দল উঠিয়ে দিতে তাদের ওপর চড়াও হয়। সেই দলেরই নেতা বাচস্পতি মশাই, এমনই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এই উক্তি করে বুঝিয়ে দেন–ভদ্রসমাজে থেকে এমনটি করলে তারা সহ্য করবে না।


২৪। “ভীম নির্ভয় নয় ও টিনের তলোয়ার।”

উঃ উক্তিটি বাচস্পতি মহাশয়ের।

চিৎপুরে গ্রেট বেঙ্গল অপেরার রিহার্সাল রুমে মেয়েছেলেকে নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করাকে তার আশে-পাশের লোকজন মেনে নিতে পারেনি। ইতিমধ্যে তারা অনেকবার এসে নিষেধ করে গেছে। দলের লোকেরা তা কানে তোলেনি। আজ অতীষ্ট হয়ে তাদেরই কর্ণধার বাচস্পতি মহাশয় তাঁর দলবল নিয়ে এসেছেন বলপূর্বক অপেরাটি উঠিয়ে দিতে। এদেরই মধ্যে একজনের নাম ভীম। প্রথমে কথা কাটাকাটি তারপর হাতাহাতি, ক্রমেই খণ্ডযুদ্ধের আকার নিলে অভিনেতা জলদ মুখোমুখি মোকাবিলা করতে যাত্রাদলে ব্যবহৃত বাজারে টিনের তলোয়ার তুললে বাচস্পতি মশাই ভীমকে আস্বস্ত করে উক্ত কথাগুলি বলেন। তিনি বোঝাতে চাইলেন টিনের তলোয়ার পলকা, ওকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সত্যিকারের তলোয়ার হলে কথা ছিল। মূলত এই বাক্যটির মধ্য দিয়ে একার্থে নাটকটির নামকরণের প্রতি ও বিশেষ অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে।


২৫। “থিয়েটার কাকে বলে বোঝো, তারপর নাটক লেখো।” 

উঃ উক্তিটি বেণীমাধবের, প্রিয়নাথের প্রতি।

নবীন উদীয়মান নাট্যকার প্রিয়নাথ নাটক লেখার বাসনায় প্রমত্ত হয়ে বাড়ি ঘর ছেড়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরায়। দলের ক্যাপ্তেনবাবু বেণীমাধবের স্মরণাপন্ন হয়েছে তাঁর নতুন লেখা নাটক ‘তীতুমীর' মঞ্চস্থ করাবেন। ইতিমধ্যে তাঁর 'পলাশীর যুদ্ধ' অপেরাতে দিয়ে গেলেও ইংরাজ বিরোধিতার ভয়ে সে নাটক মঞ্চস্থ করা হয়নি। তার আশ্রয় হয়েছে আস্তাকুঁড়ে আর তেল মাখানো মুড়ির ঠোঙা হিসাবে। মনে ব্যথিত প্রিয়নাথ এবার সেসব ভুলে তাঁর নতুন নাটকটি অভিনয় করতে আবেদন জানালে বেণীমাধব উক্ত কথাগুলি বলেন। কারণ, ইংরাজ রাজত্বে বাস করে ইংরাজের বিরোধিতা মূলক নাটক রচনা করা মুর্খামীর নামান্তর। তাছাড়া একজন নাট্যকার হিসাবে দর্শকদের রুচি সম্পর্কে আরও সম্যক ধারণা করা বাঞ্ছনীয়। নতুবা বিফলে পর্যবসিত।


২৬। এবার হুজুর নিজে যদি কলম না ধরেন তবে নাট্যশালা অলীক কুনাট্যে মজে থাকবে।

উঃ উক্তিটি বেণীমাধবের স্বত্ত্বাধিকারী বীরেন্দ্রকৃষ্ণের প্রতি।

নবীন নাট্যকার প্রিয়নাথের দেশাত্মবোধক নাটক গ্রেট বেঙ্গল অপেরাতে মঞ্চস্থ না করার কারণ বেণীমাধব সবিস্তারে বর্ণনা করছিল তখন প্রিয়নাথ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ-কে না গালাগালি দিয়ে পারেনি, কারণ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ইংরাজের তাঁবেদারি করে ধনী হয়েছে, তারই দাক্ষিণ্যে গ্রেট বেঙ্গল অপেরা আজ সচল, তাই সে চায় না ইংরাজ বিরোধিতা মূলক নাটক দলে মঞ্চস্থ হোক। ফলে আজে বাজে নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার ফলে অভিনয়ের মান ক্রমেই নেমে যাচ্ছে। অথচ দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী' নাটককে নিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ব্যঙ্গ করতে ছাড়ে না। গ্রেট ন্যাশানাল দিনে দিনে খুব নাম করছে দেখে সে মনে মনে শঙ্কিতও বটে। তাই ক্যাপ্তেনবাবুকে নির্দেশ দেয় ইংরাজদের প্রশংসা কুড়াবে এমন নাটক ধরতে, তাই বিষয়টিকে ব্যঙ্গ করে বেণীমাধব উক্ত কথাগুলি বলে বোঝাতে চাইলেন টাকার জোরে উঠতি বাবুশ্রেণির লোকেরাও সাহিত্য গুণে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে দ্বিধা করে না। অথচ সে গুণ ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত।


২৭। “দেখবেন লোকটা আবার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট তো, গুলিটুলি করে না বসে।”

উঃ উক্তিটি বেণীমাধবের, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ-র প্রতি। গ্রেট বেঙ্গল অপেরার স্বত্ত্বাধিকারী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ, যিনি ঊনবিংশ শতকের বাবুশ্রেণির একজন । তাঁর ধারণা আজেবাজে নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার দরুণ গ্রেট বেঙ্গলের মান ক্রমেই অবনতির দিকে। দলকে সুনাম করতে হলে ভালো নাটক ধরতে হবে, নাট্যকার দীনবন্ধুকে দিয়ে হবে না। তাঁর সধবার একাদশীকে দিয়ে কাজ নেই। একদা কৃষ্ণকান্তের উইল পড়ে তার স্রষ্টাকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ভালো লেগেছিল। এখন তাঁর আশা টাকা দিয়ে লেখকটাকে কিনে নিয়ে অপেরার জন্য নাটক লেখোনো। স্রষ্টা যেহেতু বঙ্কিমচন্দ্র, তিনি সাহিত্যিক, নাটক লেখেন না, এবোধ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের নেই দেখে কৌতুক করতে বেণীমাধব উক্ত কথাগুলি বলেছিলেন এবং ব্যক্তিজীবনে তিনি যে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তাও কথাচ্ছলে বুঝিয়ে দিলেন।


২৮। “আর কতক্ষণ এখানে দাঁইড়ে দাঁইড়ে শিবরাত্রির সলতের মতন জ্বলতে থাকবো লা ?”

উঃ উক্তিটি নবীন অভিনেত্রী ময়নার।

বেঙ্গল অপেরার ক্যাপ্তেনবাবু। বেণীমাধব বেগুন বিক্রেতা ময়নাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে অপেরায় ঠাঁই দিয়েছেন, তাঁকে মনের মতন শিক্ষা দিয়ে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বানাবেন। ময়না ভদ্রঘরের মেয়ে, ইতিপূর্বে থিয়েটারে দলে পতিতারা ছাড়া ভদ্রঘরের কোনো মহিলা আসেনি, আজ ময়না এসেছে শুনে দলপতি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ-র ভারি সখ হল ময়নাকে চোখের দেখা দেখে যেতে। তৎকালে বাবুশ্রেণির যেমন উপপত্নী রাখার একটা সখ ছিল, বীরেন্দ্রকৃষ্ণেরও সেই সখের বাহানা ছিল। ইচ্ছা আছে যদি ময়নাকে মনে ধরে তাকেও বাধা রাখবে। বেণীর নির্দেশে ময়না পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাকে যখন শংকরী নাম নিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সম্মুখে অভিনয়ের সংলাপ আওড়াতে শুরু করেছে এবং উচ্চারণে ভূল হলে বেণীমাধব সংশোধনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তখন অতিষ্ট হয়ে ময়না উক্ত কথাগুলি বলেছে এবং তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে ব্যঙ্গ করেছে।


২৯। “থেটার মানে ভেবেছিলুম অনাথবো, সুন্দর একটা সাজবো....এযে শালা ইস্কুলের মতন।”

উঃ উক্তিটি ময়নার।

বেগুনওয়ালী ময়না তার সুরেলা কণ্ঠের সংগীতে বেণীমাধবকে মোহিত করেছিল। তাকে নররূপে অভিনেত্রী করে গড়ে তুলতে বেঙ্গল অপেরায় এনে হাজির করেছিল। নব্যোদ্যমে ময়না ও বেণীমাধবের ডাকে সাড়া দিয়েছিল—যদি ঘৃণীত জীবন থেকে কোনো মতে নিস্কৃতি পেয়ে জনগণেশের দরবারে হাজির হওয়া যায়। ময়না আসতে বেণীমাধবের নির্দেশে তার পূর্বের অপরিষ্কার পোষাক পরিচ্ছদ ত্যাগ করে নতুন ভদ্রসাজে সাজানো হল। তারপর শুরু হল রিহার্সাল, কিন্তু বাজারওয়ালী হিসাবে তার জীবন অতিবাহিত হওয়ার কারণে সে ‘শ'টাকে কোনে মতে ‘শ’ উচ্চারণ করতে না পেরে বারে বারে ‘স’ উচ্চারণ করে বহু বকুনী খায় অতঃপর উচ্চারণের ত্রুটি থেকে মুক্ত হয়ে রিহার্সাল শেষে তাকে যখন পোষাক বদলাতে নির্দেশ দেওয়া হয় তখনই ময়না উক্ত কথাগুলি সকাতরে বলে নিজের অতীত জীবনকে প্রকট করেছে।


৩০। “তুমি তো মুচির কুকুরের মতো ফুলে উঠছ দেখছি?” 

উঃ উক্তিটি মেথরের, ময়নার প্রতি।

বাজারওয়ালীর কাজ ছেড়ে বেণীমাধবের নির্দেশে বেঙ্গল অপেরাতে অভিনেত্রীর কাজে যোগ দেওয়ার পর ময়না বিশেষ উন্নতি হয়েছে। পূর্বের নোংরা পোষাক-পরিচ্ছদ ত্যাগ করে এখন সে ভদ্র পোষাকে ভদ্রঘরের রমণীর মতো ঘুরে বেড়ায়। অভিনেত্রী হিসাবে বিশেষ নামও হয়েছে। অভিনয়ের অবসরে এখন মাঝে মধ্যে কলকাতার শহরখানাকে ঘুরে দেখে, একদা বৌবাজারের রাজপথে ঘুড়ে বেড়াবার সময় সাক্ষাৎ হয়ে যায় ম্যানহোল সাফকারী মেথরের সঙ্গে। মেথর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না পূর্বের ময়নার সঙ্গে আজকের ময়নার মধ্যে কি বস্তুর ব্যবধান। চলনে-বলনে কথায়-বার্তায় ময়নার মধ্যে আজ এসে গেছে চটুলতা, আভিজাত্য। সে মেথরের সঙ্গে অতি সাধারণ ভাষায় যেকথা বলত আজ কথার মধ্যে বাহারি রং ছাপিয়ে কথা বলা দেখে মেথর বিস্ময় বিষ্ট হয়ে উক্ত কথাগুলি বলে বোঝাতে চেয়েছিল— পরের বাড়ির মরা গোরু খেয়ে যেমন মুচির কুকুরের শরীর সারে ময়নার বর্তমান অবস্থা অনুরূপ।


৩১। “জীবন থেকে কিছুই পেলি নারে।” 

উঃ উক্তিটি ময়নার।

বেণীমাধবের সাহচর্যে ময়না এখন আর বাজারওয়ালী নয়, বর্তমানে দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার বিখ্যাত নায়িকা। সাজে পোষাকে তার মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন এসেছে। কথায় বার্তায়, চাল-চলনে দেখা দিয়েছে চমক, শহর কলকাতার রূপ পিয়াসী যুবকরা তার জন্য পাগল। অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকে সে বেরিয়ে পড়ে কলকাতা শহরটাকে ঘুরে দেখতে। আজ বেরিয়েছে হাটখোলার দত্তবাবুদের বুলবুলির সঙ্গে পোস্তার রাজার বুলবুলিদের লড়াই দেখতে, পথে মেথর মথুরের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। মথুরের ধারণা যারা যাত্রা দলে অভিনেত্রীর কাজ করে প্রত্যেকেই পতিতা, প্রথমে ময়নাকে দেখে চমকিত হলেও পরে যখন পতিতারূপে আখ্যাত করে, ময়না মথুরের ভুল ভাঙাতে বর্তমানের সুখী জীবনের স্বরূপ বর্ণনা দিয়ে তাকেও জানাতে ভোলে না সে অভিনয় জগতে এসে অনেক কিছু পেয়েছে কিন্তু মথুর কী পেল? মথুর কিছুই পায়নি কারণ, সে যে কলকাতার তলায় থাকে।


৩২। “নীতিবোধ নিয়ে চললে আর থিয়েটার করতে হত না এদেশে।”

উঃ উক্তিটি বেণীমাধবের। 

বাজারওয়ালী ময়নাকে পথ থেকে কুড়িয়ে এনে বেণী তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী বানিয়েছে এখন ময়নার কত নাম-ডাক কত কদর, কিন্তু কপাল তার বড়োই খারাপ, দলের স্বত্ত্বাধিকারী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁর মনে ধরেছে ময়নাকে, সে যদি ময়নাকে পায় তবেই দল চালাবে এবং বেণীকে সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করবে, নতুবা এই মুহূর্তে থিয়েটার সে বন্ধ করে দেবে। নিরুপায় বেণীমাধব তিল তিল করে গড়ে তোলা তিলোত্তমা ময়নাকে বাধ্য হয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁর রক্ষিতা করে পাঠায়। এটা তার কাছে হয়তো বিগহিত কর্ম। কিন্তু একটা থিয়েটার দল গড়ে তুলতে গেলে কতখানি অস্তিত্ব বিসর্জন দিতে হয় সেকথা তার জানা ছিল বলেই নাট্যকার প্রিয়নাথ ময়নার ব্যাপারটি নিতে ন্যায় নীতিবোধের প্রশ্ন তুললে সবিনয়ে বেণীমাধব এই কথাগুলি বলতে বাধ্য হয়েছিল।


৩৩। “এমন ভদ্রমহিলা বানিয়েছ যে খেটে খাওয়ার উপায় পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছি।”

উঃ উক্তিটি ময়নার, বসুন্ধরার প্রতি।

বেণীমাধব বেঙ্গল অপেরার স্বত্ত্বাধিকারী পাওয়ার লোভে তিলতিল করে গড়ে তোলা মানস প্রতিমা ময়নাকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ-র নিকট বেচে দিতে চলেছে। এটি দলের কেউ মেনে নিতে পারেনি, প্রায় সবাই এই গর্হিত কর্মের প্রতিবাদ জানিয়েছিল, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। বেণীমাধবের কথাই শেষ কথা। উপায়ান্তর না দেখে মাতৃসমা বসুন্ধরা ময়নাকে বলেছিল বেণীর এ সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে সে যেন চলে যায় অবিলম্বে তার পূর্ব জীবনে। আবার যে সবজি বিক্রি করে তার সংসার চালায়, কিন্তু ময়না তাতে কোনো সাহস পায়নি, কারণ অভিনয় জগতে এসে এখানে শেকড় তার গভীরে চলেছে। পূর্বের অবস্থায় তার আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। অভিনয় ছেড়ে সবজি বিক্রি করতে গেলে লোকে তাকে দেখে হাসবে মজা লুটবে। তাই ইচ্ছা না থাকলেও এই ঘৃণীত জীবন নিয়ে তাকে বয়ে বেড়াতে হবে। এই দুরূহ বিষয়টি প্রতিপন্ন করতে ময়না এমন কথাগুলো বলেছিল।


৩৪। “যতক্ষণ এক ফিরিঙ্গি শয়তান দেশের পবিত্র বুকে পা রেইখে দাঁড়গে থাকবে, ততক্ষণ ওই ওয়াহাবি তিতুমীরের তলোয়ার কোষবদ্ধ হবে সে কখনো।” 

উঃ উক্তিটি তিতুমীর বেশি বেণীমাধবের।

গ্রেট বেঙ্গল অপেরার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ-র নির্দেশে প্রিয়নাথের তিতুমীর নাটকের পরিবর্তে দীনবন্ধু মিত্রের সধবার একাদশী মন্থস্থ হচ্ছে বটে কিন্তু অভিনেতা অভিনেত্রীদের মনে তিতুমীরের সংলাপগুলি আগুনের মতো জ্বল জ্বল করছে। অভিনয় মঞ্চ থেকে নিমচাঁদবেশী দর্শকাসনে অত্যাচারী ল্যাম্বার্ট সায়েবকে দেখে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে পার্শ্বে অটলবিহারীবেশী জ্বলদকে ল্যাম্বার্ট ভেবে বেণীবাধব তিতুমীরের সংলাপ আওড়াতে থাকে এবং তাকে তলোয়ারের আঘাতে ধরাশায়ী করে তৃপ্তি হাসি হাসতে থাকে, এমনই এক পরিপ্রেক্ষিতে বেণীমাধব তিতুমের উক্ত সংলাপটি পাঠ করেছিলেন। আসলে ভয়ে ভয়ে থাকলেও বেণীমাধবদের মনে ইংরাজ বিদ্বেষ গোপনে প্রাধান্বিত ছিল। তারই বহিঃপ্রকাশ এমনভাবে হঠাৎ হয়েছিল। এতে প্রমাণিত হয় দেশাত্মবোধ তাঁদের মজ্জাগত।